উচ্ছৃঙ্খলতা প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
মানবজীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার অন্যতম শর্ত উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, শৃঙ্খলাপরায়ণতা। শৃঙ্খলাহীন মানবজীবন মানে চালকহীন গাড়ির মতো দিকশূন্য হয়ে পড়া। বস্তুত, এ বিশ্বজগৎ নিয়মের বাঁধনে আবদ্ধ। আর মানুষ প্রকৃতির একটি অংশমাত্র। সুতরাং, প্রত্যেক মানুষকে নিয়মের অধীন থাকতে হবে। যে জাতি উচ্ছৃঙ্খল তার অগ্রগতি স্তব্ধ হয়ে যায়। উচ্ছৃঙ্খল জীবন দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। তাই ছাত্রজীবন থেকেই এ বিষয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, আজ যে চারাগাছ রোপণ করা হচ্ছে আগামীকাল সেটি বড়ো বটবৃক্ষে পরিণত হবে। সুতরাং, মানবজীবনকে নিয়ম মেনে সুশৃঙ্খলভাবে চলতে হবে। তাহলেই জীবন হবে সুন্দর ও আনন্দময়।
শৃঙ্খলা কী?
শৃঙ্খলা বলতে মানুষের নিয়ম মেনে চলার অনুশীলনকে বোঝায়। শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতার মর্মকথা হল আনুগত্য। আর এর প্রেরণার মূলে সক্রিয় আছে মূল্যবোধ। মানবসমাজের উন্নতি, অগ্রগতি বা সভ্যতার বিকাশ-সবকিছুর মূলে আছে মানুষের সুশৃঙ্খল কর্মোদ্যোগ। যেখানে শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা নেই সেখানে শ্রী নেই, কল্যাণ নেই, নেই কোনো আনন্দ।
শৃঙ্খলার উপকারিতা
শৃঙ্খলা মানুষকে দক্ষতার সঙ্গে এবং কার্যকরভাবে তাদের জীবনযাপন করার জন্য নিয়মানুবর্তী হওয়ার শিক্ষা দেয়। শৃঙ্খলা ছাড়া জীবন ঠিক রাডার ছাড়া জাহাজের মতো। শৃঙ্খলার মূল্য হল যা করা দরকার তা করার উপায়। শৃঙ্খলাবোধ একজনকে শুধুমাত্র ইতিবাচক কর্ম প্রতিষ্ঠায় সহায়তাই করে না, এটি আমাদের মন এবং শরীরকে প্রশিক্ষিত করতে সাহায্য করে। সেইসঙ্গে আমাদের লক্ষ্যগুলিতে কেন্দ্রবিন্দু সৃষ্টি করতে এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম করে। এটি সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করে।
উচ্ছৃঙ্খলতা কী?
‘উচ্ছৃঙ্খলতা’-র আক্ষরিক অর্থ হল অভদ্র আচরণ। যে ব্যক্তির মানবজীবনে, সমাজে বা জাতীয় পর্যায়ে ইতিবাচক রীতিনীতি, নিয়মকানুন সচারুভাবে মেনে চলার মানসিকতা থাকে না তাকেই আমরা উচ্ছৃঙ্খল বলে গণ্য করি। নিয়মশৃঙ্খলার অভাব হলে, পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা লক্ষিত হলে, স্নেহ ও সম্মান না থাকলে সর্বত্র দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা। এর ফলে ব্যক্তি, সমাজ তথা জাতীয় জীবনের সুখ-শান্তি, নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটে, উন্নতি ও অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়ে।
উচ্ছৃঙ্খলতার অপকারিতা
শৃঙ্খলাবোধ না থাকলে জীবন বিষময় হয়ে ওঠে। নিয়মশৃঙ্খলা ছাড়া কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। উচ্ছৃঙ্খলতার ফলে অশান্তি, অরাজকতা দেখা দেয় এবং পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বন্ধন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনের উন্নতি ব্যাহত হয়। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য যদি নিজ ইচ্ছানুযায়ী চলে তবে পরিবারটির ঐক্য বিঘ্নিত হয়। যদি শিশুদেরকে তাদের ইচ্ছামাফিক চলতে দেওয়া হয় তবে তারা সঙ্গদোষে নষ্ট হয়ে পড়ে।
ছাত্রজীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা
ছাত্রসমাজের উচ্ছৃঙ্খলতা বড়ো বেদনাদায়ক। তাদের ওপরই নির্ভর করে দেশ ও জাতির গৌরব ও ভবিষ্যৎ। ছাত্রসমাজ দেশের অগ্রগতির বাহক। কিন্তু তাদের এই অগ্রগতি আজ নানা কারণে বুদ্ধ। হতাশা আর নৈরাশ্য যুবশক্তিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ছাত্রসমাজ আজ বিভিন্ন দলে বিভক্ত। নৈরাশ্য, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, চরম দারিদ্রতা, সামাজিক মাধ্যমের কুরুচিকর চর্চা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি ছাত্রসমাজকে বিশৃঙ্খলার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে ছাত্রসমাজের সংহত শক্তির মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই উচ্ছৃঙ্খলতা প্রতিরোধের প্রতিষেধক।
কর্মজীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা
শৃঙ্খলা আর কর্মজীবন-জীবনের এই দুই দিকের মাঝে ভারসাম্য বা সমন্বয় বজায় রাখতে না পারলে মনের শান্তি আর কাজের স্বস্তি দুই-ই বিগড়ে যায়। এ দুটির মিশেলে কর্মক্ষেত্রে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কিছু কিছু ব্যক্তি তার কর্মপ্রতিষ্ঠানে নানারকম উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে থাকে। এগুলির মধ্যে রয়েছে অবাধ্যতা, কাজে হইচই সৃষ্টি, সহকর্মীদের সঙ্গে বিবাদ, কর্মক্ষেত্রে মদ্যপান, কাজে নিয়ম না মানা, যথাসময়ে কাজ শেষ না করা, ঘুস নেওয়া প্রভৃতি। যেহেতু এ সমস্ত শৃঙ্খলাভঙ্গকারী আচরণ কর্মজীবনে গ্রহণযোগ্য নয়, সেহেতু এর জন্য কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
বর্তমানে সর্বত্র উচ্ছৃঙ্খলতার দৃষ্টান্ত
বর্তমান সমাজে আমরা নিজেকে আধুনিক বলে পরিচয় দিতে সবসময় ব্যস্ত। কিন্তু আধুনিক হতে গিয়ে আমরা অনেক অশ্লীল আচরণ, পোশাক পরিধান বা কার্যকলাপ করে থাকি, যা অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটু। আমরা প্রতিনিয়ত অনুকরণ করে চলেছি বিদেশি সভ্যতা ও সংস্কৃতির। এমন অনেক অনুকরণ আমরা করছি যা বাঙালির ঐতিহ্য বা সংস্কৃতিতে কখনোই ছিল না। আবার, আধুনিক হতে গিয়ে তরুণ সমাজের একাংশকে দেখা যায় রাস্তায় বিশাল সাউন্ডবক্স নিয়ে -উদ্দাম নৃত্য করছে। অনেক তরুণ-তরুণী আবার এমন ধাঁচের পোশাক পরছে যা আমাদের বাঙালি সমাজে সত্যিই কুরুচিকর। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনেকেই ধূমপান, মদ্যপান ইত্যাদিকে আধুনিকতা বলে মনে করছে। এই আধুনিকতা আমাদের সমাজে অনেকক্ষেত্রে এক ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতার রূপ নিয়েছে।
পরিণতি
শৃঙ্খলা জীবনকে সফল এবং জীবনযাপনের যোগ্য করে তোলে। শৃঙ্খলা ছাড়া ব্যক্তি লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ে এবং শীঘ্রই তার জীবনকে বিরক্তিকর এবং দিশাহীন মনে করে। শৃঙ্খলাহীন ব্যক্তি সময়ানুবর্তিতার মূল্য বুঝতে পারে না এবং তাই জীবনের অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যে সমাজ শৃঙ্খলাবর্জিত সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। শৃঙ্খলা নেই এমন সমাজে যে কেউ আইনকে তার নিজের হাতে তুলে নিতেও দ্বিধাবোধ করে না।
করণীয়
ক্রমবর্ধমান উচ্ছৃঙ্খলতা সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার পরিপন্থী। এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার আবশ্যক। সমাজে উচ্ছৃঙ্খলতা দমনের ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিরও দায়বদ্ধতা আছে। কেবলমাত্র আইনশৃঙ্খলার দ্বারা এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সংঘবদ্ধভাবে উচ্ছৃঙ্খলকারীর কাজকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। পুলিশি তৎপরতা বাড়িয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খলকারীকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করতে হবে।
উপসংহার
নিয়মশৃঙ্খলা জীবনে সর্বময় সাফল্যের মূল কথা। আমরা যদি জীবনে সাফল্যের স্বাদ পেতে চাই তাহলে সর্বক্ষেত্রে নিয়মশৃঙ্খলার চর্চা করতে হবে। বিশেষ করে ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতার চর্চা করা অবশ্য-কর্তব্য। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে জাতীয় জীবনের সর্বত্র আমাদের সুষ্ঠু শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় দিতে হবে। নাহলে আমরা সুসভ্য ও উন্নত জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।
আরও পড়ুন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা