আজব শহর কলকেতা প্রশ্ন উত্তর একাদশ শ্রেণি 2nd সেমেস্টার
সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাশৈলী ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ অবলম্বনে আলোচনা করো।
বাংলা সাহিত্যে আড্ডার ভঙ্গিতে পরিবেশিত রম্যরচনার অনন্য রূপকার সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর রচনাশৈলী ‘আজব শহর কলকেতা’ শীর্ষক প্রবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরেও নিজস্বতায় উজ্জ্বল।
প্রথমত: আলী সাহেবের লেখায় ইতিহাস, মানবজীবন, সমাজ, রাজনীতি অর্থনীতি ও নান্দনিক বিষয় সবই চমৎকাররূপে প্রতিভাত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: তাঁর রচনায় বাংলার সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি, ফারসি, পুশতু, আরবি, জার্মান, ফরাসি প্রভৃতি ভাষার শব্দের অদ্ভুত মিশেল ঘটেছে।
তৃতীয়ত: কখনও হিউমার, কখন স্যাটায়ার, কখন বা উইটের প্রয়োগে তিনি পাঠককে হাস্যরসের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রুপের জ্বালাও সহ্য করতে বাধ্য করেছেন।
চতুর্থত: মুজতবা আলী মজলিশি আড্ডার মেজাজ বজায় রেখেছেন প্রবন্ধে। এই আড্ডার তথ্য পান্ডিত্যের ভারে ভারাক্রান্ত নয়, উপভোগের বিষয়।
পঞ্চমত: জ্ঞানপিপাসু মনের সঙ্গে আনন্দপিপাসু মনের খোরাক সৈয়দ মুজতবা আলী সরস রম্যতায় পরিবেশন করেছেন। ঘরকুনো-নিভৃতচারী পাঠককে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আপনমনে দু-দণ্ড প্রাণ খুলে হাসানোরও দায়িত্ব নিয়েছেন প্রাবন্ধিক।
ষষ্ঠত: প্রাবন্ধিক তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে বর্ণময় করে তুলেছেন। প্রতিটি অভিজ্ঞতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা যেন এক একটি রঙিন ক্যানভাস হয়ে উঠেছে।
“ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি”-কে, ছেলেবেলা থেকে কোন্ কথা শুনে আসছেন? বক্তার পরিচয় দাও।
যিনি: আলোচ্য অংশটি প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে বক্তা আলী সাহেব স্বয়ং ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছেন, এ কথা বলা হয়েছে।
যে কথা: ছেলেবেলা থেকেই বক্তা শুনে আসছেন যে, কলকাতা হল এক আজব শহর। যদিও তার সপক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ পাননি। তাই কলকাতা শহরকে চেনার জন্য, তার আজব ভাব উপলব্ধি করার জন্য প্রাবন্ধিকের উৎসাহের সীমা ছিল না।
বক্তার পরিচয়: বক্তা হলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী। প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, উপন্যাস ও রম্যরচনায় তাঁর কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়। তিনি বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও বহু ভাষায় প্রাজ্ঞ ছিলেন। ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে তাঁর সেই ভাষাজ্ঞানের প্রমাণ মেলে। তিনি ছিলেন ‘সুরসিক’। আমাদের পাঠ্য ‘পঞ্চতন্ত্র’-এর প্রবন্ধগুলিতে তাঁর সূক্ষ্ম হাস্যরসের পরিচয় পাওয়া যায়। আলোচ্য প্রবন্ধে মজলিশি ঢঙে তিনি যেসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করে শহর কলকাতার আজবভাব-কে তুলে ধরেছেন, তা রম্যরচনা হিসেবে প্রবন্ধটিকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
আজব শহর কলকেতা’-এই শব্দবন্ধটি প্রথম কোথায় ব্যবহৃত হয়? হঠাৎ কী দেখে প্রাবন্ধিকের মনে হয়েছিল কলকাতা শহর আজব?
প্রথম উল্লেখ: ‘আজব শহর কলকেতা’ এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। এই গ্রন্থে উনবিংশ শতাব্দীর নব্য আধুনিক কলকাতার যে বৈচিত্র্যময় সমাজচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধেও প্রাবন্ধিক যেন হুতোমের অনুসরণেই এক বর্ণময়, বহু বিচিত্র ঘটমান ঘটনা সমন্বিত কলকাতার ছবি আঁকতে চেয়েছেন।
মনে হওয়ার কারণ: পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে আমরা দেখি, প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী ছেলেবেলা থেকেই কলকাতা শহর আজব, এ কথা শুনে এসেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে তেমন কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ তিনি পাননি। প্রমাণ সংগ্রহের জন্যই শহর কলকাতা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন প্রাবন্ধিক। হঠাৎ তাঁর নজরে আসে একটি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’। শহর কলকাতায় যেখানে প্রকাশকরা বাংলা বই বিক্রি করেই বহু সময় লাভের মুখ দেখতে পান না, সেখানে কোনো বই বিক্রেতা কলকাতায় ফরাসি ভাষার বই বিক্রি করবেন বলে দোকান খুলেছেন-এই বিষয়টাই প্রাবন্ধিকের কাছে ছিল অবিশ্বাস্য, অবাক করা। তাই তাঁর মনে হয়েছিল কলকাতা শহর হয়তো সত্যিই আজব।
“তবু তার প্রমাণ পেলুম কমই”-কে, কীসের প্রমাণ কম পেয়েছিলেন এবং সে বিষয়ে তাঁর আপশোশ থেকে গিয়েছিল কেন?
বক্তা: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত অংশে স্বয়ং প্রাবন্ধিকের প্রমাণাভাবের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। যে প্রমাণ: কলকাতা যে ‘আজব শহর’ তা প্রাবন্ধিক তাঁর ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছেন। কলকাতার ‘আজব’ চরিত্রের কথা বহুশ্রুত হলেও তার উপযুক্ত প্রমাণ তিনি লাভ করেছেন অনেক কম। জনশ্রুতির পাশাপাশি কলকাতার আজব ভাব বোঝার জন্য যথাযথ প্রমাণের প্রয়োজন। তাই উপযুক্ত প্রমাণ সহযোগে প্রবন্ধ লেখার তাগিদে, তার উপকরণ সংগ্রহ করতেই কলকাতার রাজপথে নেমেছিলেন তিনি।
আপশোশের কারণ: প্রাবন্ধিক ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছেন, কলকাতা হল এক আজব শহর। একসময় বাংলার রক্ষণশীল সমাজ ‘গজিয়ে ওঠা’ কলকাতার নব্য কালচার দেখে বলত- “মিথ্যে কথার কিবা কেতা। আজব শহর কলকেতা”। তিনি বুড়ো হতে চলেছেন তবু এ কথার কোনো কঠোর প্রমাণ পাননি। তাই তাঁর আপশোশ থেকে গিয়েছে।
“তাই নিয়ে একখানা প্রামাণিক প্রবন্ধ লিখব ভাবছি”-কে, কী নিয়ে প্রামাণিক প্রবন্ধ লিখবেন ভেবেছিলেন? লিখতে বসে প্রাবন্ধিকের কী অবস্থা হয়েছিল?
যিনি: আলোচ্য অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত, ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। এই প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী একখানা প্রামাণিক প্রবন্ধ লিখবেন ভেবেছিলেন।
প্রবন্ধের বিষয়: প্রাবন্ধিক ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছেন- কলকাতা হল এক আজব শহর। কিন্তু তার প্রমাণ তিনি বৃদ্ধ বয়সে এসেও সেভাবে পাননি। তাই এই বিষয়ে তিনি একটা প্রামাণিক প্রবন্ধ লিখবেন তিনি বলে মনস্থির করেছিলেন- সে-কথাই এখানে বলা হয়েছে।
প্রাবন্ধিকের অবস্থা: ‘কলকাতা আজব শহর’-এ বিষয়ে একটি প্রামাণিক প্রবন্ধ লেখার কথা যখন প্রাবন্ধিক ভাবছেন তখনই হঠাৎ নামে প্রবল বৃষ্টি। এই অবিরাম বর্ষণে প্রাবন্ধিককে এক গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ, তাঁর কাছে না ছিল ছাতা, না ছিল বর্ষাতি। ট্রামে চড়ার তাগদ নেই, বাসে চড়ার আগ্রহ নেই, আর্থিক অবস্থার জন্য ট্যাক্সি চড়ার ক্ষমতাও নেই। এই অকালদুর্যোগে তাই পথ না হারিয়েও বাড়ি ফেরার চিন্তাটা পথ হারানোর বেদনার মতোই হয়ে ওঠে। আসলে বাড়ির পথ আর প্রবন্ধ রচনার পথ-উভয়ই তিনি যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন।
সমীরণের পথ হারানোর বেদনা বেজে উঠল”-সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করো।
প্রসঙ্গ: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছেন কলকাতা নাকি আজব শহর। যদিও বয়স গড়ালেও সেই আজব ভাবটি টের পেয়েছেন খুব কমই। তা সত্ত্বেও এই বিষয় নিয়ে যখন একটি প্রামাণিক প্রবন্ধ লেখার কথা তিনি ভাবছেন, তখনই নামে প্রবল বৃষ্টি। সেই প্রসঙ্গেই উদ্ধৃতিটির অবতারণা।
ব্যাখ্যা: প্রাবন্ধিকের কেবল জীবনের সঙ্গেই নয়, যেন কলমের সঙ্গেও তাঁর জীবন দেবতা, তাঁর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। তাই হঠাৎই ঝড়-বৃষ্টি নামায় তাঁর মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের গান। ১৩৪২-এর ৫ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ”-এই প্রকৃতি পর্যায়ের গানটি। কবির অন্তর্জগৎ এবং বাহ্যিক পৃথিবী-দুই-ই তখন উত্তাল। শান্তিনিকেতনে তখন নেমেছে শ্রাবণের প্রবল ধারাবর্ষণ। তখনই কবির লেখনী দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল উক্ত গানটি। যার একটি পঙ্ক্তি ছিল- “পথ-হারানোর বাজিছে বেদনা – সমীরণে।” অকালদুর্যোগে বাড়ি ফেরার চিন্তা পথ হারানোর মতোই সমস্যা – হয়ে ওঠায়, প্রাবন্ধিক সেই প্রসঙ্গেই, আলোচ্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রগানের উত্ত কলিটি ব্যবহার করেছেন। এখানে প্রাবন্ধিকের পথ হারানোর মতো সমস্যা যেন রবীন্দ্রনাথের গানের বেদনা হয়ে বেজে উঠেছিল।
“যদিও পথ হারাইনি তবু সমস্যাটা একই”-আলোচ্য অংশে পথ হারানোর প্রসঙ্গ এসেছে কেন? পথ না হারিয়েও বক্তা সেই একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কেন?
পথ হারানোর প্রসঙ্গ: আলোচ্য অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘অনুব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। এই প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী একদিন কলকাতা শহর ঘুরে দেখছিলেন। সেইসময়ে হঠাৎ বৃষ্টি নামে। প্রাবন্ধিকের কাছে সেইদিন ছাতা বা বর্ষাতি কিছুই ছিল না এবং ট্রামে-বাসে চেপে বাড়ি ফেরার মতো যথেষ্ট টাকাও ছিল না। তাই যদিও তিনি পথ হারাননি, তবু বৃষ্টির দিনে এমন পরিস্থিতি তাঁর কাছে ছিল পথ হারানোর সমান। অর্থাৎ, তাঁর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, আদতে পথ না হারালেও তাঁর বাড়ি ফেরার কোনো উপায় ছিল না। এই অসহায় অবস্থা বোঝাতেই সমীরণে পথ হারানোর প্রসঙ্গ এসেছে।
সমস্যাটা এক হওয়ার কারণ: কলকাতার রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে, কলকাতা যে আজব শহর-এ বিষয়ে একটি প্রামাণিক প্রবন্ধ লেখার কথা যখন প্রাবন্ধিক ভাবছেন, তখন হঠাৎই নামল জোর বৃষ্টি। প্রবল বাতাসে পথ হারানোর বেদনা বেজে উঠল। তিনি পথ হারাননি, কিন্তু বাড়ি ফেরারও উপায় নেই। কারণ তাঁর কাছে ছাতা নেই, বর্ষাতি নেই। ট্রামে চড়ার মতো তাগদ নেই। ভীড় বাসে চড়ার ইচ্ছা নেই। আর্থিক অক্ষমতার জন্য ট্যাক্সি চড়তে বুক কচকচ করে।
ফলে অকালদুর্যোগে পথ না হারিয়েও বাড়ি ফেরার চিন্তার বেদনাটা পথ হারানোর মতোই সমস্যা ঘনিয়ে তুলল। আবার কলকাতা আজব শহর, তা প্রমাণের মালমশলা না পাওয়াও যেন একই সমস্যা ঘনিয়ে তোলে বলে মনে করেছেন প্রাবন্ধিক।
“… তবু সমস্যাটা একই”-কোন্ সমস্যার কথা বলা হয়েছে? তাঁর সমস্যার কারণগুলি লেখো।
সমস্যার বর্ণনা: পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছেন কলকাতা ‘আজব শহর’। অথচ তার প্রমাণ বুড়ো বয়স পর্যন্ত পেলেন না। এই কথাই যখন ভাবছিলেন প্রাবন্ধিক তখনই জোর বৃষ্টি নামে। আচমকা ঝড় উঠলে যেমন চারদিক ধুলোয় অন্ধকার হয়ে যায়, চেনা পথ হয়ে যায় অচেনা, তেমনই প্রাবন্ধিকেরও একই সমস্যা হয়েছিল। সঙ্গে না ছিল বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করার সাজ-সরঞ্জাম, না যানবাহনে চড়ার তাগিদ। আবার অর্থাভাবে বিলাসব্যসনের সুযোগও ছিল না। বাড়ি ফেরার সমস্যাটা তাই ঝড়ে পথ হারানোর মতোই মনে হয়েছে আলী সাহেবের।
বক্তার সমস্যার কারণ: বক্তা অর্থাৎ প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘আজব শহর কলকেতা’-কে নিয়ে একটি প্রামাণিক প্রবন্ধ লেখার কথা ভাবতে ভাবতে শহরের পথে হাঁটছিলেন, তখন অঝোরধারায় বৃষ্টি নামে। ফলে বাড়ি ফেরা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ-
প্রথমত, বৃষ্টিতে না ভিজে বাড়ি ফেরার জন্য ছাতা কিংবা বর্ষাতি ছিল না তাঁর কাছে।
দ্বিতীয়ত, তাঁর ট্রামে চড়ার মতো তাগদ ছিল না।
তৃতীয়ত, বাসে করে বাড়ি ফেরার কথা প্রাবন্ধিক ভাবতেই পারেননি।
চতুর্থত, ট্যাক্সিতে চড়ার মতো আর্থিক ক্ষমতাও তাঁর নেই।
তেমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এই সকল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল প্রাবন্ধিককে।
কাজেই বাড়ি ফেরার চিন্তার বেদনাটা ‘পথ হারানো’র মতোই হল-বাড়ি ফেরার চিন্তা কেন বেদনায় পরিণত হয়েছিল? ‘পথ হারানো কথাটির গুরুত্ব আলোচনা করো।
চিন্তা বেদনায় পরিণত হওয়ার কারণ: ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, কলকাতার রাস্তায় চলার পথে হঠাৎই প্রবল বাতাসের সঙ্গে মুশলধারায় বৃষ্টি নামে। ছাতা-বর্ষাতি কিছুই না থাকায় প্রাবন্ধিক বাড়ি ফেরার চিন্তায় বেদনার্ত হয়ে পড়েন। ট্রামে- বাসে চড়ার মতো দৈহিক শক্তি তখন তাঁর নেই। এদিকে ট্যাক্সির ভাড়া মহার্ঘ – হওয়ায় তা তাঁর সাধ্যের অতীত। তাই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কীভাবে বাড়ি ফিরবেন, এই চিন্তা পথভ্রষ্ট হওয়ার বেদনার সমতুল্য বলে মনে হয়েছিল তাঁর।
পথ হারানো কথাটির গুরুত্ব: শহর কলকাতা ঘুরতে বেরিয়ে অবিরাম বর্ষণে প্রাবন্ধিককে খুব অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। কথায় আছে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়’। কলকাতা ভ্রমণে বেরিয়ে সেই রকমই এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন প্রাবন্ধিক আলী সাহেব। হঠাৎ বৃদ্ধি নামলে আত্মরক্ষা করা যাবে, না-ছিল এমন সাজ-সরঞ্জাম, না-ছিল তাগদ, হঠাৎ দুর্যোগ উপস্থিত হলে ভিড়ে ঠাসাঠাসি ট্রামে-বাসে আশ্রয় নেওয়ার। এদিকে চরম অর্থাভাবে বিলাসবহুল গাড়ি চড়ার সুখও অধরা। এমনসময় হঠাৎই চোখে পড়ল, শহর কলকাতার বুকে স্পর্ধাভরে দাঁড়িয়ে আছে একটি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’। বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে সেখানে প্রবেশ করলেন বটে, কিন্তু যে, শহরে বাংলা বই-ই বিক্রি হয় না, সেখানে ফরাসি বই-এর দোকান তাঁকে হতবাক করল। তখন কলকাতা শহরের আজব চরিত্র নিয়ে প্রামাণিক প্রবন্ধ লেখার কথা চিন্তা করার অবকাশও আর আলী সাহেবের ছিল না। তাই পথ না হারালেও প্রাবন্ধিকের করুণ অবস্থাকে পথ হারানোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কারণ বাড়ির পথ আর প্রবন্ধ রচনার পথ উভয়ই তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
যেভাবে প্রমাণিত হল: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে দেখা যায়, প্রাবন্ধিক কলকাতার আজব স্বভাবখানি নিয়ে একটা প্রামাণ্য প্রবন্ধ লেখার অভিপ্রায়ে কলকাতার রাজপথে” নেমেছেন। তাঁর সন্ধানী চোখ যখন প্রবন্ধের উপাদান খুঁজে বেড়াচ্ছে, তখন শহরের বুকে প্রবল দুর্যোগ এসে উপস্থিত হয়। প্রবল বাতাস, প্রবল ধারাবর্ষণ-এদিকে তাঁর না আছে ছাতা বা বর্ষাতি, না আছে সামর্থ্য ট্রামে- বাসে চড়ার। অর্থাভাবে ট্যাক্সিও অধরা। এই প্রবল দুর্যোগে ও চরম অসহায়তায় বাড়ির পথ আর সৃষ্টির পথ দুই-ই যখন হারাতে বসেছেন, এমন সময় একটি দোকানের সাইন বোর্ড তাঁকে বিস্মিত করে। বাড়ি ফেরার চিন্তায় প্রাবন্ধিক যখন উদ্ভ্রান্ত, তখন সামনেই পড়ে একটি বুক শপ, সেটি আবার যেমন-তেমন নয়, ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’। কলকাতার ক্রমহ্রাসমান পাঠককুল, বই বাণিজ্যে লোকসান ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বাঙালি প্রকাশকদের বই যেখানে বিক্রি-ই হয় না, সেখানে ফরাসি বইয়ের প্রকাশক কি হালহকিকত না জেনেই পথ হারিয়ে এই দোকান খুলে বসেছেন? কারণ বাংলায় যদি বাংলা বইয়েরই এমন দুর্দশা, তাহলে ফরাসি বই বিক্রি হবে কী করে! কলকাতা শহরের আজব ভাবখানার যে অংশটুকু প্রাবন্ধিকের কাছে ছিল অধরা, আক্ষেপের কারণ কলকাতা বক্ষের ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ সেটুকুকে পূর্ণ করে তাঁকে হতবাক করে। প্রমাণিত হয় কলকাতা সত্যই আজব শহর।
“এমন সময় সপ্রমাণ হয়ে গেল ‘কলকেতা আজব শহর”-কীভাবে প্রমাণিত হল যে কলকেতা আজব শহর?
১৯১৪ আজব শহর কলকেতা’-য় ফরাসি বইয়ের দোকান দেখে লেখকের মনে কীরূপ ভাবের উদয় হয়েছিল? দোকানের ভিতর ঢুকে লেখক কীরূপ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন? অথবা, “সামনে দেখি বড় বড় হরফে লেখা ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ'”ー ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-টিতে গিয়ে প্রাবন্ধিকের কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা প্রসঙ্গ-সহ বর্ণনা করো।
প্রসঙ্গ: পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী ছেলেবেলা থেকে ‘আজব শহর’ কলকাতাকে নিয়ে একটি প্রামাণিক প্রবন্ধ রচনার পরিকল্পনা করেন। ঠিক সেইসময়ই ঝড়-বৃষ্টির দাপটে বাড়ি ফেরার চিন্তা তাঁকে গ্রাস করে। পথহারানোর অনুভূতির মধ্যেই কলকাতা যে ‘আজব শহর’ তার প্রমাণ তিনি হঠাৎই পেয়ে যান, একটি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ লেখা দোকান সামনে দেখে। কলকাতার আজব স্বভাবখানার প্রমাণস্বরূপই ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এর প্রসঙ্গটি এসেছে।
প্রথম দর্শনে প্রাবন্ধিকের মনের ভাব: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী একদিন শহর কলকাতা ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ রাস্তায় দেখতে পান ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ নামক একটি বইয়ের দোকান। প্রথমে বাইরে থেকে তিনি ভেবেছিলেন নামে ফরাসি হলেও, ভিতরে হয়তো মিলতে পারে প্রসাধনসামগ্রীর মতো ঝকমকে কোনো রদ্দি বই। অর্থাৎ, কেবল ক্রেতাকে আকর্ষণ করার জন্য বাইরে এমন নাম লেখা আছে।
দোকানে প্রবেশের পর প্রাবন্ধিকের অভিজ্ঞতা: দোকানে প্রবেশ করার পর প্রাবন্ধিকের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে। তিনি দেখেন, চারদিকে প্রচুর হলদে ও সাদা মলাটওয়ালা ফরাসি বই ছড়ানো আছে। অর্থাৎ, বিক্রেতা কেবল ফরাসি বই বিক্রি করেই লক্ষ্মীলাভ করতে চান। দোকানদার বইগুলোকে সাজিয়েছেন বাঙালি দোকানদারদের মতো-টাইপরাইটারের হরফ সাজানোর কায়দায়। অর্থাৎ কেউ সাজানোর পদ্ধতিটা আয়ত্ত করতে পারলে অনায়াসেই বই খুঁজে নিতে পারবে। এই দোকানের বিক্রেতা ফরাসি মেমসাহেবের সঙ্গেও পরে প্রাবন্ধিকের কথোপকথন হয় এবং ফরাসি ভাষার প্রতি তাঁর একাত্মতা, তাঁর জাত্যভিমান প্রাবন্ধিক উপলব্ধি করেন।
নিশ্চয়ই কোনো ফরাসী পথ হারিয়ে কলকাতায় এসে পড়েছে”- কোন্ প্রসঙ্গে বক্তা এ কথা বলেছেন? বক্তার এমন মনে হওয়ার কারণ কী?
প্রসঙ্গ: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা দেখি আলী সাহেব একদিন ভীষণ বৃষ্টির মধ্যে শহরের পথে আটকে পড়েন। চরম দুর্যোগে সঙ্গে ছাতা বা বর্ষাতি কিছু না থাকায় এবং ট্রামে-বাসে চড়ার মতো শারীরিক সামর্থ্য কিম্বা ট্যাক্সি চড়বার মতো অর্থ না থাকার কারণে পথ হারানোর মতো বেদনার্ত হতে হয় তাঁকে। একদিকে প্রবল ধারাবর্ষণ, অন্যদিকে আত্মরক্ষার্থে নিরুপায় প্রাবন্ধিকের হঠাৎ চোখে পড়ে কলকাতার বুকে বড়ো বড়ো হরফে লেখা ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’। তখন তিনি অনুমান করেন, কোনো ফরাসি হয়তো পথ হারিয়ে কলকাতায় এসেছেন শখ করে একটি বইয়ের দোকান দিয়ে ট্যাঁকের পয়সা খোয়ানোর জন্য। এই প্রসঙ্গেই আলী সাহেবের এরূপ উক্তি।
মনে হওয়ার কারণ: প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে প্রশ্নোদ্ভূত ভাবনার কথাটি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন কলকাতা শহরে ভালো বাংলা বই ছাপিয়েও পয়সা কামানো যায় না। তাই কলকাতায় ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ দেখে প্রাবন্ধিক অবাক হয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে ফ্রান্সের কোনো বড়োলোক ব্যক্তি, যিনি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এর মালিক, তিনি হয়তো পথ হারিয়ে ফ্রান্স থেকে এসে পড়েছেন কলকাতায় এবং তাঁর সঞ্চিত অর্থ শখ করে খরচ করার জন্যই কলকাতায় ফরাসি বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন।
“আর যে দুটি পয়সা ট্যাকে আছে তাই খোয়াবার জন্য …”-কে, কী করেছিলেন তা কারণ-সহ ব্যাখ্যা করো।
যিনি, যা করেছিলেন: শহর কলকাতার বুকে এক ভয়াবহ দুর্যোগের সম্মুখীন হন প্রাবন্ধিক। এমন সময় হঠাৎই তাঁর চোখে পড়ে শহর কলকাতার বুকে একটি দোকানের এক অত্যাশ্চর্য সাইন বোর্ড। তাতে লেখা ‘ফ্রেঞ্চ বুক শিপ’। কলকাতায় বাংলা বইয়েরই ক্রেতা মেলে না, সেখানে ফরাসি বইয়ের দোকান! প্রাবন্ধিক এই প্রসঙ্গে পথ হারিয়ে কলকাতায় এসে পড়া কোনো ফরাসি ব্যক্তির কথা বলেছেন, যাঁর আর্থিক সংগতি বিদ্যমান বলেই প্রাবন্ধিকের ধারণা। কলকাতায় এসে তিনিই এই ফরাসি বইয়ের দোকান খুলেছেন শখ করে, তাঁর সমস্ত টাকা খোয়ানোর জন্য-এ কথাই এখানে বলা হয়েছে।
কারণ: ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ নামের নির্ভেজাল ফরাসি বইয়ের দোকান কলকাতার বাঙালি সংস্কৃতিতে বেমানান বলে মনে হয়েছে প্রাবন্ধিকের। ‘আজব শহর কলকেতা’ রচনায় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী এই দোকানে শুধু ফরাসি বই বিক্রি করে বিক্রেতার মুনাফা অর্জনের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। তাঁর অভিজ্ঞতায় বাঙালি প্রকাশকরা ভালো বইয়ের পাশাপাশি বহু রদ্দি বইও প্রকাশ করেন লক্ষ্মীলাভের আশায়। তাই প্রাবন্ধিকের ধারণা জন্মে যে, হাতির দাঁতের মতো বাইরেটা ‘ফ্রেঞ্চ’ হলেও ভিতরে চিবোনোর দাঁতের ন্যায় ফরাসি সুগন্ধী, প্রসাধনীস্বরূপ স্বল্প সময়ের জন্য আনন্দদায়ক কোনো রদ্দি বই-ই হয়তো বিক্রি করছেন বিক্রেতা। ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ নামটা কেবল ক্রেতার মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলার জন্য।
বই বিক্রি প্রসঙ্গে বাঙালি প্রকাশকদের অভিমতটি আলোচ্য প্রবন্ধ অনুসারে লেখো।
বাঙালি প্রকাশকদের বক্তব্য: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে বলেছেন-বাঙালি প্রকাশকরা বলেন যে, শুধু ভালো বই ছাপিয়ে পয়সা উপার্জন করা যায় না।
তাদের অবলম্বনের পথ: কলকাতা শহরের এই বাঙালি প্রকাশকরা মুনাফালাভের আশায় অনেকসময় গাদা গাদা নিম্নরুচির উপন্যাসও ছেপে বিক্রি করেন।
এ কথা বলার কারণ: কলকাতা শহর ভ্রমণে বেরিয়ে হঠাৎই ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ অর্থাৎ ফরাসি বইয়ের দোকান দেখে প্রাবন্ধিক অবাক হয়ে যান এবং সেই বইয়ের দোকানের মালিকের মুনাফা করার অভিপ্রায়টি সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করেই তিনি বাঙালি প্রকাশকদের মন্তব্য স্মরণ করেন। এই কথায় বাংলা সাহিত্যের বই কেনাবেচার এক করুণ দৃশ্য ফুটে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের সেই সমৃদ্ধির কালে ভাবলে বিস্ময় জাগে, বাংলা বইয়ের বাঙালি ক্রেতা ছিল অপ্রতুল। বাঙালি প্রকাশকরা তাই দেউলিয়া হওয়ার ভয়ে বেশি বই ছাপতেই ভয় পেত। কেবল ভালো বই ছাপিয়ে লাভের মুখ দ্যাখা যেত না। অর্থাৎ প্রকাশকরা লক্ষ্মীলাভের জন্য সব ধরনের বই, এমনকি নিম্নমানের বইও প্রকাশ করতে বাধ্য হন।
কথাটা যদি সত্যি হয়”-কোন্ কথা? কথাটি কি প্রকৃতপক্ষে সত্যি এবং যদি তা সত্যি হয় তবে কী হবে?
প্রশ্নোক্ত উদ্ধৃতির কথাটা হল: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে বলেছেন, বাঙালি বইয়ের প্রকাশকেরা -বলেন যে,-শুধু ভালো বই ছাপিয়ে পয়সা উপার্জন করা যায় না, নিম্নরুচির • উপন্যাসও বেশি করে প্রকাশ করতে হয়।
সত্যি কথার পক্ষে যুক্তি: বাংলা সাহিত্যজগতে প্রথিতযশা লেখকের সুগ্রন্থের অভাব নেই। অভাব শুধুমাত্র পাঠকের। বাঙালি প্রকাশকরা বাণিজ্যগত দিক থেকে উপলব্ধি করেছেন, যদি ‘ভালো বই’ অর্থাৎ বই কেবল বিষয়ের দিক দিয়ে ভালো হয় তবে সেই বইয়ের বোদ্ধা পাঠক সংখ্যা খুবই নগণ্য হয়ে পড়ে। এতে নাম থাকলেও বহু সময় লক্ষ্মীলাভ থাকে অধরা, কারণ ক্রেতা মেলে না। তাই অচলা লক্ষ্মীকে সচল রাখতে নিম্নরুচির উপন্যাস ছাপাতে হয়। তার পাঠক উন্নতমানের নয় ঠিকই, তবে সারাবছরের ক্রেতা এঁরাই।
কথাটা সত্যি হলে যা হবে: প্রাবন্ধিক আশঙ্কা করেছেন কথাটি সত্য হলে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ থেকে শুধুমাত্র ফরাসি ভাষায় রচিত সাহিত্যকীর্তিমূলক গ্রন্থ বিক্রি করে সেই দোকানদারের লাভের মুখ দেখা মুশকিল হবে।
“তাই আন্দাজ করলুম …”-বক্তা কী আন্দাজ করলেন? বক্তার এমন আন্দাজ করার কারণ কী?
অথবা, আলোচ্য প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক ‘হাতীর দাঁত’-এর প্রসঙ্গ এনেছেন কেন?
অথবা, “চিবোবার জন্য দাঁত রয়েছে লুকোনো”-প্রসঙ্গ কী? লুকোনো দাঁতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য লেখো।
বক্তা যা আন্দাজ করলেন: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী আন্দাজ করেছেন, ফরাসি বইয়ের দোকানের বাইরে বড়ো বড়ো হরফে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ লেখা থাকতেই পারে, কিন্তু ভিতরে গেলে হয়তো অন্য পণ্য মিলবে। দোকানের ভিতরে হয়তো আছে ‘খুশবাই’, ‘সাঁঝের পীর’, ‘লোধরেণু’ বা ‘ওষ্ঠরাগ’-এর মতো সাময়িক আনন্দদায়ী নিম্নরুচির কিছু বই-যা বোধদীপ্ত নয়, যা লঘু সাহিত্য।
আন্দাজ করার কারণ: আলী সাহেব একদিন হঠাৎ কলকাতা শহরে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ দেখে আশ্চর্য হয়ে ভেবেছিলেন, কোনো ফরাসি ব্যক্তি হয়তো পথ হারিয়ে এখানে এসেছে এবং ট্যাকের পয়সা খরচের জন্য শখ করে ফরাসি বইয়ের দোকান দিয়েছে। প্রাবন্ধিকের এমন মনে হয়, কারণ কলকাতার বাঙালি প্রকাশকদেরও শুধু ভালো বই বিক্রি করে মুনাফা অর্জন হয় না, তার সঙ্গে লঘুরসের চটুল উপন্যাসও গাদা গাদা ছাড়তে হয়। তাই সেই কলকাতাতে কেবল ফরাসি বই বিক্রি করে লাভবান হওয়া কঠিন। এই কথা বলতে গিয়ে প্রাবন্ধিক ‘হাতীর দাঁতের’ প্রসঙ্গ এনেছেন। হাতির বাইরের দাঁত কেবল শোভাবর্ধনের জন্য, খাদ্য চিবোনোর জন্য নয়। ঠিক তেমনই বাইরে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ লেখা থাকলেও দোকানের ভিতরে হয়তো থাকবে ‘খুশবাই’, ‘সাঁঝের পীর’, ‘লোধরেণু’, ‘ওষ্ঠরাগ’ জাতীয় চটুল বই-যা বিক্রি করে সম্ভবত মুনাফালাভ হতে পারে। এই প্রসঙ্গেই প্রাবন্ধিকের এই উক্তি।
“সেই ভরসায় ঢুকলুম”-প্রাবন্ধিক কী মনে করে কোথায় ঢুকেছিলেন এবং ভরসার কারণ কী?
যা মনে করে যেখানে ঢুকলেন: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে দেখা যায়, প্রাবন্ধিক কোনো এক বৃষ্টির দিনে বাড়ি ফেরার চিন্তায় বিচলিত হয়ে কলকাতায় একটি ফরাসি বইয়ের দোকান দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে যান। দোকানের সামনে বড়ো বড়ো হরফে লেখা ছিল ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’। কলকাতায় ফরাসি বইয়ের দোকান দেখে লেখকের প্রথমেই মনে হয়েছিল, কোনো ধনী ফরাসি বোধহয় পথ হারিয়ে এখানে চলে এসেছে এবং শখ করে অর্থের স্বেচ্ছা অপচয় করতেই দোকান খুলে বসেছে। তাই তাঁর মনে ভাবনা জাগে এই দোকান নিতান্তই লোকদেখানো। তখনই তিনি একে হাতির দাঁতের সঙ্গে তুলনা করেন। হাতির বাইরের দুটো বড়ো দাঁত তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য, সাধারণত তা কোনো কাজে লাগে না। খাবার চিবিয়ে খাওয়ার জন্য হাতির মুখের ভিতর অন্য দাঁতও থাকে। ফরাসি বইয়ের দোকানটিও তেমনই লোকদেখানো বিপণি। বাইরে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ লেখা থাকলেও আসলে সেখানে কিছু চটুল বই ছাড়া আর কিছুই নেই। ট্যাকের পয়সা খোয়ানোর জন্যই বেচারা ফরাসি দোকানদার এই পুস্তক বিপণি খুলেছেন।
ভরসা পাওয়ার কারণ: পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ অনুসারে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এর সামনে দাঁড়িয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর মনে হয়েছে, এই দোকানটি শুধুমাত্র নামেই ফরাসি। ভিতরে ‘খুশবাই’, ‘সাঁঝের পীর’, ‘ওষ্ঠরাগ’ বা ‘লোধরেণু’ ইত্যাদির মতো তরল লঘু রসাত্মক বই পাওয়া যায়। তাই দোকানে ঢুকলেও তাঁকে পয়সা খরচ করে কোনো বই কিনতে হবে না।
কলকাতায় বাংলা বই-ই বিক্রি হয় না, বাঙালি প্রকাশকদেরও লক্ষ্মী লাভের জন্য নিম্নরুচির বই ছাপাতে হয়। তাই, এই ফরাসি বইয়ের দোকানেও আদতে সেই বই মিলবে বলেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন প্রাবন্ধিক। বই বিক্রির আকালই প্রাবন্ধিকের এই ভরসার কারণ।
আজব শহর কলকেতাই বটে-প্রাবন্ধিকের, কলকাতাকে আজব মনে হওয়ার কারণ কী?
অথবা, “শুধু ফরাসী বই বেচেই লোকটা পয়সা কামাতে চায়- লোকটা কে এবং বক্তার এমন মনে হওয়ার কারণ কী?
লোকটির পরিচয়: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ রচনায় উদ্দিষ্ট ‘লোকটা’ কলকাতায় অবস্থিত ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’- এর মালিক।
মনে হওয়ার কারণ: কলকাতা শহর ভ্রমণে বেরিয়ে প্রাবন্ধিক এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়ে যখন পথ হারানোর মতো বেদনায় কাতর তখন তাঁর চোখে পড়ে একটি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’। যে শহরে বাংলা বইয়েরই ক্রেতা দুর্লভ সেখানে ফরাসি বইয়ের দোকান শহরের আজব ভাব খানিকেই তুলে ধরে। নিশ্চিতভাবেই ধনী ব্যক্তির শখ করে অর্থের অপচয় এবং ফরাসি বইয়ের নামে চটুল বই বিক্রির অভিপ্রায়-দোকানটি সম্পর্কে এইসব চিন্তা মাথায় নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আরও একবার হতবাক হন প্রাবন্ধিক। দেখেন, সেখানে হলদে ও সাদা মলাট দেওয়া ফরাসি ভাষায় লেখা প্রচুর বই রাখা আছে, যা আরও বেশি অভিনব। বইগুলির মধ্যে কিছু সাজানো-গোছানো আছে এবং অবশিষ্ট বই যেখানে-সেখানে ছড়ানো অবস্থায় আছে। যে বইগুলি সাজানো আছে সেগুলি টাইপরাইটারের হরফ সাজানোর মতো করে বিন্যস্ত রয়েছে। যে বই সাজানোর পদ্ধতিটি জানে তার পক্ষে বই খুঁজে বের করা খুবই সহজ, আর যে এই পদ্ধতিটা জানে না তার পক্ষে খুবই অসুবিধার। বাঙালি দোকানদারেরা এভাবেই বইগুলি সাজিয়ে রাখেন। এই বিপুলসংখ্যক ফরাসি বই ও সেগুলিকে সাজানোর রীতি দেখে কথকের মনে হয়েছে, এভাবেই পুস্তকপ্রেমীদের আকর্ষণ করে শুধু ফরাসি বই-ই বেচতে চায় দোকানদার। বাংলা মুলুকের খাস কলকাতায় বসে কেবল ফরাসি বই বিক্রির অদ্ভুত ভাবনার জন্যই প্রাবন্ধিকের, কলকাতা শহরকে আজব বলে মনে হয়েছে।
যে জানে না তার কোমর ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যাবে-কার, কী না জানার কথা বলা হয়েছে? কোমর ভাঙার সম্ভাবনা আছে কেন?
কার: ভ্রমণপিপাসু সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ রচনায় প্রাবন্ধিক বলছেন, ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এর সাজানো পুস্তকরাজির ‘সিজিল’ বা বিন্যাসরীতি না জানা থাকলে সেই অজ্ঞ ক্রেতার পছন্দের বই খুঁজতে গিয়ে তার কোমর ভাঙার সম্ভাবনা আছে।
কী: আলোচ্য অংশে এখানে ফ্রেঞ্চ বুক শপের বই সাজানোর কায়দা বা সিজিলটা জানার কথা বলা হয়েছে। সঠিক পদ্ধতি জানা না থাকলে ক্রেতা তার প্রয়োজনীয় বই খুঁজে পাবেন না এবং তাকে অসুবিধায় পড়তে হবে বলে প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন।
কোমর ভাঙা: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী একদিন কলকাতা শহরের এক ফরাসি বইয়ের দোকানে দেখেন, ফরাসি দোকানদার কলকাতায় বইয়ের ব্যাবসা করতে এসে কার্যত বাঙালি হয়ে গিয়েছেন। বাঙালি দোকানদারের মতো করেই বইগুলি সাজিয়েছেন টাইপরাইটারের ঢঙে। যার সিজিলটা জানা আছে সে অনায়াসেই চোখ বন্ধ করে ইচ্ছামতো বই খুঁজতে পারবে। যার জানা নেই তার নির্দিষ্ট বই খুঁজতে কোমর ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যাবে, অর্থাৎ তাকে খুব অসুবিধায় পড়তে হবে বলেই প্রাবন্ধিকের অভিমত।
“ইতিমধ্যে ফরাসী হাসি হেসে দাঁড়িয়েছেন”-কে ফরাসি হাসি হেসে বক্তাকে কী বললেন? আলোচ্য ব্যক্তির পরিচয় দাও।
যে: আলোচ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে ফ্রেঞ্চ বুক শপের দোকানদার ফরাসি মেমসাহেব, প্রাবন্ধিককে দেখে ফরাসি হাসি হেসে দাঁড়িয়েছিলেন।
যা বললেন: কৌতূহলবশত ফরাসি বইয়ের দোকানে আলী সাহেব ঢুকতেই হাসিমুখে এসে দাঁড়ালেন এক ফরাসি মেমসাহেব। আলী সাহেব পরশুরামের কেদার চাটুজ্যের ভাষায় মেমসাহেবকে সেলাম জানাতে, প্রত্যুত্তরে মেমসাহেব ফরাসি ভাষায় বলেছিলেন- “আপনার আনন্দ কিসে’ অর্থাৎ ‘কি চাই?”
পরিচয়: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে আমরা জানতে পারি, কলকাতার ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ প্রাবন্ধিক আলী সাহেব এক ফরাসি মেমসাহেবের সম্মুখীন হন। মেমসাহেব কলকাতায় এসেছেন মাস তিনেক আগে। এই বইয়ের দোকান তাঁর নিজের নয়, তাঁর বান্ধবীর। মেমসাহেব মোটামুটি কাজ চালানো গোছের ইংরেজি জানেন। বান্ধবীর অনুপস্থিতিতে শুদ্ধমাত্র ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার কামনায় তিনি এই দোকানে বসেছেন। কথাবার্তায় সরল সাধাসিধে। দূর প্রবাসে এসে প্রাবন্ধিকের সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারার আনন্দ তাঁর দেশ ও ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে প্রকাশ করে।
“পরশুরামের কেদার চাটুজ্যেকে আমি মুরুব্বি মানি”-কেদার চাটুজ্যের পরিচয় দাও। তাকে ‘মুরুব্বি’ মানার কারণ কী?
কেদার চাটুজ্যে: পরশুরাম ওরফে রাজশেখর বসুর একটি উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় চরিত্র হল কেদার চাটুজ্যে। বৈঠকি আড্ডার আবহে অজান্তে পাঠকেরাও ঢুকে পড়েছেন কেদার চাটুজ্যের সঙ্গে, তামাক খেয়েছেন এক হুঁকোতে। কেদার চাটুজ্যে বারবার এসেছেন পরশুরামের গল্পে। তাঁর সংলাপ কিছুটা উদ্ভট হলেও তা বেমানান নয়। তিনি কখনও শুনিয়েছেন বাঘের গল্প কখনও-বা প্রেমের গল্প কখনও মেমসাহেবের গল্প।
মুরুব্বি মানার কারণ: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ রচনায় আমরা দেখি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ কথকের সামনে এক ফুটফুটে মেমসাহেব আবির্ভূত হন। মিষ্ট ফরাসি হাসির মাধ্যমে কথককে তিনি উন্ন অভ্যর্থনা জানান ও আলাপ করেন। পরশুরাম সৃষ্ট চরিত্র কেদার চাটুজ্যে মহিলাদের সঙ্গে মসৃণ আলাপে দক্ষ ছিলেন। তাঁকে ‘মুরুব্বি’ অর্থাৎ অভিভাবক হিসেবে স্মরণ করে প্রাবন্ধিক ফরাসি মেমসাহেবকে ‘সেলাম’ জানান। নারী মনস্তত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ কেদার চাটুজ্যেকে অনুসরণ করে মেমসাহেবকে অভিবাদন জানিয়েছেন কথক এবং তাঁকে ‘মুরুব্বি’ হিসেবে মেনেছেন।
“সে কথাই স্মরণ নেই-গোটা ভাষাটার কথা বাদ দিন”-কোন্ কথা স্মরণে নেই? কী কারণে গোটা ভাষাটা বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে?
যে কথা স্মরণে নেই: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে আমরা দেখি, শহর কলকাতায় ঘুরতে ঘুরতে প্রবল বৃষ্টি নামলে প্রাবন্ধিক তাঁর সামনে দেখতে পান একটি ফ্রেঞ্চ বুক শপ। দোকানে ঢোকার পর এক মেমসাহেব তাঁকে ফরাসি ভাষায় অভিবাদন জানিয়ে জিজ্ঞেস করেন, প্রাবন্ধিক কী কিনতে চান। এরপর ফরাসি ভাষায় কিছু টুকরো কথোপকথন চলে মেমসাহেব ও প্রাবন্ধিকের মধ্যে।
সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বহুভাষাবিদ। তিনি ফরাসি ভাষা বলেছেন সেই প্রথম যৌবনে প্রায় দশ বছর পূর্বে। তাই তাঁর ভাষা ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এই কারণে মেমসাহেবের কথার প্রসঙ্গে তিনি প্রাথমিকভাবে নীরব থাকেন। যৌবনে বলা ভাষা প্রৌঢ় বয়সে আর তাঁর স্মরণে নেই।
ভাষাটি বাদ দেওয়ার কারণ: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত ‘আজব শহর কলকেতা’ নামাঙ্কিত রচনায় প্রাবন্ধিক ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ প্রবেশের পর ফুটফুটে এক মেমসাহেব তাঁকে ফরাসি হাসির মাধ্যমে স্বাগত জানিয়েছেন। মেমসাহেবকে সেলাম জানানোর পর তিনি ফরাসিতে প্রাবন্ধিককে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘আপনার আনন্দ কিসে?’ অর্থাৎ ‘কি চাই?’ ফরাসি ভাষার বইয়ের দোকানে ঢুকে ফরাসি মেমসাহেবের মুখে ফরাসি ভাষায় প্রশ্ন শুনে চরম অস্বস্তিতে পড়েন প্রাবন্ধিক। প্রৌঢ়ত্বে উপনীত প্রাবন্ধিক প্রথম যৌবনে ফরাসি ভাষায় কথা বললেও অনভ্যাসের কারণে তা এখন বিস্মৃতপ্রায়। প্রাবন্ধিকের পক্ষে ফরাসি ভাষায় সাবলীলতার সঙ্গে কথা বলার তো প্রশ্নই নেই, কাজ চালানো ফরাসি ভাষা বলাও যে দুর্বৃহ-সে কথাই ব্যক্ত হয়েছে ‘বাদ দিন’ কথাটির মাধ্যমে।
জর্মন ভাষায় একটি প্রেমের গান আছে”-অর্থ-সহ গানটি উল্লেখ করো। আলোচ্য প্রবন্ধে গানটি উল্লেখের তাৎপর্য আলোচনা করো।
উল্লিখিত প্রেমের গান: ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলীর উল্লিখিত জার্মান ভাষায় গাওয়া প্রেমের গানটি হল: Dein Mund sagt “Nein” Aber Deine Augen Sagen “Ja”
জার্মান গানের অর্থ: গানটির রচয়িতা উইলি রোজেন। গানটির অর্থ হল-তোমার মুখ বলছে ‘না, না’, কিন্তু তোমার চোখ দুটি বলছে ‘হাঁ হাঁ’।
তাৎপর্য: জার্মান ভাষায় রচিত মূল গানটি হল Dein Mund sagen “Nein”, Aber Deine Augen sagen “Ja”. গানটির রচয়িতা জার্মান গীতিকার উইলি রোজেন (Willy Rosen)। ১৯৩০ সালে রচিত ও গীত এই গানটির ইংরেজি ভাষান্তর হল, “Your eyes say no-no…but your mouth says yes-yes”. কাহিনিকার ভাষান্তর করে বলেছেন, “তোমার মুখ বলছে ‘না,নো’, কিন্তু তোমার চোখ দু’টি বলছে ‘হাঁ হাঁ।” ফ্রান্স ও জার্মানি শত্রুভাবাপন্ন হওয়ায় তারা একে অপরের বিপরীতধর্মী কাজ করে থাকে। মেমসাহেব কথকের ইংরেজি বুঝতে না পেরে বিপরীত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন। মুখে বললেন ইয়েস, ইয়েস কিন্তু চোখের ভাষায় কথক স্পষ্টত বুঝলেন ‘না, নো’। অর্থাৎ প্রাবন্ধিকের কথার এক বর্ণও ফরাসি মেমসাহেব বুঝতে পারেননি।
“মহা মুশকিল।”-কে, কোথায় মহা মুশকিলে পড়েছিলেন? হঠাৎ মুশকিলে পড়ে, তা থেকে তিনি কীভাবে উদ্ধার পেয়েছিলেন সে প্রসঙ্গ সংক্ষেপে আলোচনা করো।
যিনি, যেখানে: পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে আমরা দেখি প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী মহা মুশকিলে পড়েছিলেন। প্রাবন্ধিক একদিন শহর কলকাতা ঘুরে দেখতে বেরিয়ে একটি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ যান। দোকানের ফরাসি মেমসাহেব বাংলা বা ইংরেজি ভাষা জানেন না। তাই প্রাবন্ধিক মেমসাহেবের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা ফরাসি ভাষায় কথোপকথন চালাতে গিয়ে মহা মুশকিলে পড়েছিলেন।
মুশকিল ও তা থেকে উদ্ধার: প্রাবন্ধিক তাঁর প্রথম যৌবনে প্রথম রপ্ত করা ফরাসি ভাষাটি ভালোভাবে বলতে পারলেও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সেই অভ্যাসে মরচে ধরেছে। তাই ফরাসি পড়ে বুঝতে পারলেও, তা সাবলীলভাবে বলতে পারেন না। কিন্তু মেমসাহেবের সঙ্গে বাক্যালাপের সময় তিনি সামান্য কিছু কথা বলেন ফরাসিতে। মেমসাহেবও তখন খুশি হয়ে তাঁকে ফরাসিতেই কথোপকথন চালাতে বলেন। প্রাবন্ধিক এতে মনে সাহস পেয়ে কোনোক্রমে ভাঙা ভাঙা ফরাসি বলে বাঙালি জাতির মান রেখেছিলেন। এভাবে মেমসাহেবের উৎসাহ প্রদানই প্রাবন্ধিকের মুশকিল আসান হয়ে ওঠে।
মেমসাহেব আদেশ দিলেন,”-মেমসাহেব কাকে কী আদেশ দিলেন? এই আদেশ দেওয়ার ফলে কী হয়েছিল?
যাকে যা আদেশ দিলেন: ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে মেমসাহেব প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলীকে আদেশ দিয়েছিলেন।
মেমসাহেব প্রাবন্ধিককে ‘মসিয়ো’ অর্থাৎ ‘মশাই’ বলে সম্বোধন করে আদেশ দিলেন, তিনি যেন ফরাসি ভাষাতেই কথা বলেন। কারণ মেমসাহেব ইংরেজি বুঝতে পারেন না। এরপর ‘মাসিয়ো ফ্রাঁসোয়া পঁসে’ নামক এক ফরাসি রাজদূতের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে কথক ফরাসি বলে ফেললেই মেমসাহেব এই আদেশ করেন।
আদেশ দেওয়ার ফলে ঘা হল: ফ্রেঞ্চ বুক শপ-এর বই বিক্রেতা ফরাসি মেমসাহেবের সঙ্গে কথোপকথনের সময় আলী সাহেব ইংরজিতে বলতে বলতে হঠাৎ ফরাসি রাজদূত ফ্রাঁসোয়া পঁসে’র নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে। কিছুটা ফরাসি বলে ফেলেন। মুজতবা আলী অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছুটা ফরাসি বলে ফেলাতেই মেমসাহেব তাঁকে বাকি কথা ফরাসিতে বলারই আদেশ দেন। প্রাবন্ধিক আলী সাহেব ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন যৌবনে। এখন ‘কেঁদেকুকিয়ে’ পড়তে পারেন, কিন্তু বলতে গেলে তাঁর শোচনীয় অবস্থা হয়। তবুও তিনি হাল ছাড়েন না। তাঁর কথায় ফরাসি “ব্যাকরণকে গঙ্গা যাত্রায় বসিয়ে উচ্চারণের মাথায় ঘোল ঢেলে চালালুম আমার ধেনো মার্কা ফরাসি শ্যাম্পেন।” এরকম ‘টুটিফুটি’ ফরাসি ভাষা বলাতেও মেমসাহেব আনন্দে আত্মহারা। অর্থাৎ প্রাবন্ধিকের ব্যাকরণহীন ভাঙা ভাঙা ফরাসি শুনেও মেমসাহেব খুশি হয়েছিলেন।
“বাঙালির জাত্যভিমানে বড্ডই আঘাত লাগলো”-আঘাতের স্বরূপ ও তা নিরসনে কথকের প্রচেষ্টার পরিচয় দাও।
জাত্যভিমানে আঘাতের স্বরূপ: পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে স্বয়ং প্রাবন্ধিকের তথা মুজতবা আলীর জাত্যভিমানে আঘাত লাগার কথা বলা হয়েছে। ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ যে মেমসাহেব ছিলেন তিনি ইংরেজি বুঝতে পারছিলেন না। এর ফলে প্রাবন্ধিকের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদানের এক দুরত্ব তৈরি হয়েছিল ভাষার জন্য। এরপর ফরাসি রাজদূতের কথাপ্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক ফরাসি ভাষা বলে ফেললেও তিনি কিন্তু ফরাসি ভাষায় স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন না। মেমসাহেব যখন ফরাসি ভাষায় কথা বলতে বললেন তখন বাঙালি হিসেবে প্রাবন্ধিকের জাত্যভিমানে আঘাত লাগল। কারণ বাঙালিরা কোনো কিছুতেই সহজে পিছপা হয় না। নিরসনের প্রচেষ্টা: প্রাবন্ধিক ফরাসি ভাষা খুব কষ্টে পড়তে পারলেও, তা বলতে গেলে যে তাঁর নির্বোধের মতো অবস্থা হবে তা স্বীকার করাটাই বাঙালির জাত্যভিমানে প্রচণ্ড আঘাত হানে। তাই এই অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য দুর্গতিনাশিনী দশভুজার শরণাপন্ন হন প্রাবন্ধিক। কলকাতায় বসে ফরাসি ললনা বাংলা বা ইংরেজি না বলতে পারলে, একইভাবে সুদূর ফ্রান্স থেকে এতদূরে অবস্থান করে ত্রুটিপূর্ণ ফরাসি বলাও অপরাধ নয় বলে নিজেকে আশ্বাস দেন তিনি।
“আমার অবস্থা ডডনং হয়ে দাঁড়ায়। ভাবলুম, দুঙ্গা বলে ঝুলে পড়ি।”-প্রাবন্ধিকের অবস্থা ‘ডডনং’ হওয়ার কারণ কী? তিনি ‘দুর্গা’ বলে ঝুলে পড়েছিলেন কেন?
এমন হওয়ার কারণ: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে আমরা এই ‘ডডনং’ শব্দবন্ধটি পাই। ‘ডডনং’ শব্দটির কোনো আক্ষরিক অর্থ আমরা জানতে পারি না। তবে লোকশ্রুতি আছে ‘৬৬নং (ছেষট্টি) কলিকাতা’- এই ঠিকানাকে কেউ মূর্খতার দরুন ‘ডডনং কলিকাতা’ পড়ে ফেলেছিল। তাই এই প্রবন্ধে মূর্খের মতো বোঝাতে ‘ডডনং’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলী ফরাসি ভাষাটা অনেক কষ্ট করে কেঁদে কঁকিয়ে পড়তে পারলেও, সেই ভাষায় কথা বলতে গেলে তাঁর অবস্থা হয় শোচনীয়। মেমসাহেবের সাবলীল ফরাসির কাছে তাই তাঁর অবস্থা ডডনং-ই হয়েছে।
প্রাবন্ধিকের এমন ভাবনার কারণ: আলোচ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে আমরা দেখি, মেমসাহেবের আদেশপালনে ফরাসি ভাষায় কথা বলতে গিয়ে নির্বোধের মতো অবস্থা হল প্রাবন্ধিকের। তিনি ফরাসি ভাষাটি কোনোরকমে করে পড়তে পারলেও এই ভাষায় কথা বলা প্রায় অসাধ্য ছিল প্রাবন্ধিকের পক্ষে। তাই তিনি ভাবলেন, মেমসাহেব যদি কলকাতায় বইয়ের দোকান করে বাংলা বা ইংরেজি বলতে না পারেন তাহলে ফ্রান্স থেকে হাজার মাইল দূরে দাঁড়িয়ে নির্ভুল ফরাসি বলতে না পারার জন্য তাঁর লজ্জা পাওয়া উচিত নয়। তাই তিনি মা দুর্গাকে স্মরণ করে ফরাসিতে মেমসাহেবের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করেন।
“এমন কোন্ বাইবেল অশূদ্ধ হয়ে যাবে ?”-‘বাইবেল’ কী? তা অশুদ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে কেন?
‘বাইবেল শব্দের অর্থ: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধতে আমরা ‘বাইবেল’ শব্দটির উল্লেখ পাই। বাইবেল হল খ্রিস্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এর দুটি খণ্ড-ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট। ওল্ড টেস্টামেন্টে সৃষ্টির আদি থেকে জিশুখ্রিস্টের জন্ম পর্যন্ত ঘটনাধারা হিব্রু ভাষায় বিবৃত। নিউ টেস্টামেন্টের ভাষা গ্রিক। এখানে খ্রিস্টের বাণী ও তাঁর শিষ্যদের বার্তা লিপিবদ্ধ হয়েছে।
বাইবেল অশুদ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গ: প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলীর বক্তব্য অনুসারে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ যে মেমসাহেব ছিলেন, তিনি কলকাতায় অবস্থান করেও বাংলা ও ইংরেজি বলতে পারছেন না। বাংলায় বসে * মেমসাহেব বাংলা কিংবা ইংরেজি কিছুই না বলতে পারলে কথকও অসংকোচে ত্রুটিপূর্ণ ফরাসি বলতেই পারেন। তা ফ্রান্স থেকে বহুদূরে কলকাতায় অবস্থানকারী কথকের নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ নয়। তাই তাঁর মনে হয়নি এতে বাইবেল অশুদ্ধ হওয়ার মতো কোনো বিশাল দোষ হয়েছে।
“বরজলালের মত ইমনকল্যাণের সুর ধরলুম … মেমসাহেবও বুড়ো রাজা প্রতাপ রায়ের মত।”-বরজলাল সম্পর্কিত কাহিনিটি আলোচনা করো। মেমসাহেবের আচরণের সঙ্গে প্রতাপ রায়ের আচরণের তুলনা করা হয়েছে কেন?
বরজলাল সম্পর্কিত কাহিনি: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধের কাহিনি প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলী – বরজলাল এবং ইমনকল্যাণের কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গটি রবীন্দ্রনাথ – ঠাকুরের ‘গানভঙ্গ’ কবিতা থেকে নেওয়া।
রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যের অন্তর্গত ‘গানভঙ্গ’ কবিতাটিতে আমরা দেখি রাজা প্রতাপ রায়ের রাজসভায় কাশীনাথ নামে নতুন গায়কের আগমন হয়। তাঁর গায়নপদ্ধতি সম্পূর্ণ নতুন। সংগীতের নানা সূক্ষ্ম ক্রিয়াকলাপে তিনি সভাসদবর্গকে মুহূর্তে মোহিত ও আকর্ষিত করেন। কিন্তু পুরোনোপন্থী বৃদ্ধ রাজার তা পছন্দ হয় না। তিনি তাঁর বাল্যসখা বরজলালের আগমনি-বিজয়ার গান ভূপালি রাগে ও মূলতানি সুরে ‘গোকুলের গোয়াল গাথা’ শুনে অভ্যস্ত। তিনি পুনরায় সভায় বরজলালকে ডেকে আনেন। বৃদ্ধ বরজলাল শীর্ণহস্তে তানপুরা নিয়ে ‘ইমনকল্যাণ’ সুরে গান ধরলেও তিনি গান গাইতে পারেন না। ফলে শ্রোতাদের মন আকৃষ্ট করতে না পেরে তিনি প্রস্থান করেন। দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে প্রাবন্ধিকও ফরাসি বলতে প্রায় ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু ফরাসি মেমসাহেবের অনুরোধ, উৎসাহ ও জাত্যভিমানের তাগিদে শেষপর্যন্ত প্রাবন্ধিক সেই বরজলালের মতোই ফরাসি ভাষা বলতে শুরু করেছিলেন মেমসাহেবের কাছে।
মেমসাহেব প্রতাপ রায়ের মতো হওয়ার কারণ: ‘গানভঙ্গ’ কবিতায় দ্যাখা যায়, বৃদ্ধ রাজা প্রতাপ রায়ের, বাল্যবন্ধু বরজলাল ছাড়া আর কারও গান ভালো লাগে না। তাই বরজলালের গান শ্রুতিমধুর না হলেও তাঁর ইমনকল্যাণ সুর শুনে রাজা তাঁকে উৎসাহ দিয়ে বলেন, “আহাহা, বাহা • বাহা কহিছে কানে, গলা ছাড়িয়া গান গাহ।” দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে • প্রাবন্ধিকও ফরাসি বলতে প্রায় ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু ফরাসি মেমসাহেবের অনুরোধ, উৎসাহ ও জাত্যভিমানের তাগিদে শেষপর্যন্ত প্রাবন্ধিক সেই বরজলালের মতোই ফরাসি ভাষা বলতে শুরু করেছিলেন মেমসাহেবের কাছে। আলী সাহেবের ভাঙা ভাঙা ফরাসি ভাষা শুনেও মেমসাহেব যারপরনাই আনন্দিত হন। সুদূর প্রবাসে মাতৃভাষায় বাক্যালাপ করার আনন্দকে আলী সাহেব তুলনা করেছেন বরজলালের কণ্ঠে ইমনকল্যাণ সুর শুনে বৃদ্ধ রাজা প্রতাপ রায়ের আনন্দের সঙ্গে। মেমসাহেব প্রাবন্ধিকের সঙ্গে ফরাসি ভাষায় বাক্যালাপ করে খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন।
“এই হল ফরাসী জাতটার গুণ। হাজারো দোষের মধ্যে একটা কিছু ভালো দেখতে পেলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।”-ফরাসি জাতির গুণ প্রাবন্ধিক কীভাবে উপলব্ধি করেছিলেন? প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠার কারণ কী?
ফরাসি জাতির গুণ উপলব্ধি: পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী ফরাসি জাতির মানুষদের এক বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। কোনো মানুষের হাজার দোষের মধ্যে সামান্যতম গুণের আভাস পেলেই ফরাসিরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন।
ফরাসিদের এই বৈশিষ্ট্যই প্রাবন্ধিকের খুব ভালো লেগেছিল। কলকাতা শহরের একটি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ প্রবেশ করে প্রাবন্ধিক দেখেন সেখানে বিক্রেতা হলেন এক ফরাসি মেমসাহেব। মেমসাহেব কেবল ফরাসি ভাষাই বোঝেন। ফলত, প্রাবন্ধিককে বাধ্য হয়েই ভাঙা ভাঙা ফরাসি ভাষায় কথোপকথন চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়। দীর্ঘ দিনের অনভ্যাসে ফরাসি প্রায় ভুলে গেলেও, মেমসাহেব প্রাবন্ধিকের মুখে ফরাসি ভাষা শুনে বাহবা দিতে থাকেন। সেই প্রসঙ্গেই আলীসাহেব এ কথা বলেছেন।
প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়ার কারণ: হিন্দুধর্মে যদিও শিব, ব্রহ্মা, গণেশ, হনুমান, গায়ত্রী প্রমুখ দেবদেবীদের পঞ্চমুখের প্রতীকে আঁকা হয়েছে। এটি পূর্ণ শক্তির প্রতীকবিশেষ। কিন্তু চলতি ভাষায় পঞ্চমুখ বলতে প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। প্রাবন্ধিক ফরাসি মেমসাহেবের সঙ্গে কথা বলার সূত্রে পুরোনো মর্চে ধরা, জাম-পড়া, ছাতি-মাথা তানপুরায় তার বাঁধার মতো, কৈশোরে শেখা ফরাসির প্রয়োগ শুরু করলেন। রবীন্দ্রসৃষ্ট চরিত্র বৃদ্ধ বরজলালের মতো ইমনকল্যাণসম দুর্বোধ্য ফরাসি ভাষার প্রয়োগ করলেন প্রাবন্ধিক। মাতৃভাষার এহেন দুরূহ প্রয়োগকেও রবীন্দ্রসাহিত্যের বৃদ্ধ রাজা প্রতাপ রায়ের মতোই ‘আহাহা বাহাবা বাহাবা’ বলে উৎসাহ জোগাতে লাগলেন মেমসাহেব। প্রতাপ রায়ের ‘গলা ছাড়িয়া গান গাহ’র মতোই কথকের প্রচেষ্টার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন মেমসাহেব।
“আমাকে আর পায় কে?”-প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উদ্ধৃতিটির কারণ বর্ণনা করো।
কথার প্রসঙ্গ: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে কলকাতা শহরের এক ফ্রেঞ্চ বুক শপ-এ গিয়ে প্রাবন্ধিকের সঙ্গে বই বিক্রেতা ফরাসি মেমসাহেবের আলাপ হয়। কথোপকথনের শুরুতে প্রাবন্ধিক কোনোক্রমে দু-এক লাইন ফরাসি বলতেই, মেমসাহেব তাঁকে উৎসাহ দেন বাকি কথা ফরসিতেই বলার জন্য। দীর্ঘ অনভ্যাসের পরেও বিদেশিনির থেকে তাঁর এই ব্যাকরণের নিয়মহীন ভাঙা ভাঙা ফরাসি ভাষার প্রশংসা শুনে প্রাবন্ধিকের এই উক্তি।
উদ্ধৃতির ব্যাখ্যা: পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলীর আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আলোচ্য উদ্ধৃতিতে। প্রাবন্ধিকের রপ্ত করা ফরাসি ভাষাটি প্রায় দশ বছর চর্চার বাইরে ছিল। কিন্তু ঘটনাক্রমে তাঁকে মেমসাহেবের সঙ্গে ফরাসিতেই কথোপকথন চালাতে হয়। সেই ফরাসি ভাষা ‘গানভঙ্গ’ কবিতায় বরজলালের ইমনকল্যাণ সুর গাইবার মতো- জোড়াতালি দিয়ে কোনরকমে কথোপকথন চালানো যায় মাত্র। কথোপকথনের মধ্যে না ছিল ব্যাকরণের ভিত্তি, না ছিল মাধুর্য। কিন্তু সেই ত্রুটিযুক্ত ফরাসি শুনেও মেমসাহেব যথেষ্ট খুশি হয়েছিলেন। প্রাবন্ধিক বলেছেন-ফরাসি জাতটার গুণ হল হাজারও দোষের মধ্যে সামান্য কিছু ভালো দেখতে পেলেই তারা প্রশংসায় ভরিয়ে তোলে। মেমসাহেবও সেই ভাঙা ভাঙা ফরাসি ভাষা শুনে প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন, অনেকটা ‘গানভঙ্গ’ কবিতার বৃদ্ধ প্রতাপ রায়ের মতো। এই ঘটনাই প্রাবন্ধিককে আনন্দিত করে তুলেছে এবং অপার গৌরবে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করেছেন তিনি।
“চালালুম আমার ধেনো মার্কা ফরাসী শ্যাম্পেন।”-আলোচ্য অংশটির মর্মার্থ ব্যাখ্যা করে, প্রাবন্ধিকের কৌতুকপ্রিয়তার পরিচয় দাও।
প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা: লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত ‘আজব শহর কলকেতা’ রচনায় প্রাবন্ধিকের ত্রুটিপূর্ণ, ব্যাকরণবর্জিত, উদ্ভট উচ্চারণযুক্ত ফরাসি ভাষা বলার ঘটনাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এর ফুটফুটে মেমসাহেবের আদেশে প্রাবন্ধিক তাঁর বহুদিনের অনভ্যস্ত, মর্চে পড়া ফরাসি ভাষাজ্ঞানের পুনঃপ্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করছিলেন। তাঁর মুখে অসংগতিপূর্ণ মাতৃভাষা শুনেও ফরাসি মেমসাহেব প্রাবন্ধিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। এতে প্রবল উৎসাহে ব্যাকরণকে না মেনে, উচ্চারণকে জলাঞ্জলি দিয়ে ক্রেতারূপী কথক ফরাসি বলতে শুধু করেন। ধান থেকে তৈরি দেশি মদের মতো, সস্তা, নিকৃষ্ট মানের ফরাসি ভাষার অসংলগ্ন প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন তিনি। এতেই মেমসাহেব খুব খুশি হয়েছিলেন এবং কথকও যেন বাঙালির জাত্যভিমান বজায় রাখার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
কৌতুকপ্রিয়তা: ধেনো হল ধান থেকে প্রস্তুত একপ্রকার মদ। শ্যাম্পেন হল একপ্রকার বিদেশি মদ। প্রাবন্ধিক ফ্রেঞ্চ বুক শপের বই বিক্রেতা ফরাসি মেমসাহেবের সঙ্গে ব্যাকরণবর্জিত, ভুল উচ্চারণের ফরাসিতে কথা বলছিলেন-মেমসাহেব তাঁর সেই দুর্বোধ্য ফরাসি শুনে আনন্দও পেয়েছিলেন এবং তাঁকে ফরাসি ভাষায় কথোপকথন চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। প্রাবন্ধিকের বলা ফরাসি যেন ফরাসি শ্যাম্পেনের বোতলে পরিবেশিত ধেনো মদের মতো দেশী, মিশ্রিত, নিকৃষ্ট ও ত্রুটিপূর্ণ- তাই এই তুলনা। সেই ‘ধেনো’ মার্কা ভাষাকেই লেখক ব্যঙ্গ করে ফরাসি শ্যাম্পেন বলেছেন।
সে ভরসাও দিলেন।”-কে, কীসের ভরসা দিয়েছিলেন? এরপর ভরসা দেওয়া মানুষের মনের ভাব কী হয়েছিল?
যে ভরসা দিলেন: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত আলোচ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিককে ফেঞ্চ বুক শপ-এর ফরাসি মেমসাহেব ভরসা যুগিয়েছিলেন।
ভরসার বিষয়: সৈয়দ মুজতবা আলীর বেশ কিছু প্রয়োজনীয় বইয়ের ফর্দ ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ দোকানের মেমসাহেব টুকে নিয়েছিলেন এবং আশ্বাস দিয়েছিলেন দোকানে বই এলেই তিনি খবর দেবেন।
বিদেশিনির মনের ভাব: মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকায় ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এক সাময়িক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল ফরাসি বইয়ের দোকানের বিদেশিনীর। কিন্তু প্রাবন্ধিকের সঙ্গে স্বল্প সময়ের আলাপ তাঁর মনে আনন্দের সৃষ্টি করেছিল। এমনকি প্রাবন্ধিকের বলা প্রায় দুর্বোধ্য ব্যাকরণবিহীণ ফরাসিও যেন ফরাসি মেমকে স্বদেশের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করিয়েছিল। তাই সাতসমুদ্র তেরো নদীর এপারে বিদেশি অর্থাৎ প্রাবন্ধিকের সঙ্গে ফরাসি ভাষায় কথা বলার আনন্দে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথাও ভাগ করে নিয়েছিলেন তিনি।
“সুখ-দুঃখের দু-চারটা কথাও বলে ফেললেন”-কে, কখন সুখ- দুঃখের কথা বলেছিল? কথাগুলি কী ছিল?
যে, যখন বললেন: ‘আজব শহর কলকেতা প্রবন্ধে’ প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলীকে ফ্রেঞ্চ বুক শপের বই বিক্রেতা ফরাসি মেমসাহেব তাঁর সুখ-দুঃখের কিছু কথা বলেছিলেন। ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’এর মেমসাহেবের সঙ্গে প্রাবন্ধিক আলীসাহেব ফরাসি ভাষায় কথোপকথন শুরু করলে তখন সাতসমুদ্র তেরো নদীর এপারে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারার আনন্দে মেমসাহেব বেশ খুশি হয়েছিলেন। সেই আনন্দে মেমসাহেব কিছু ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা আলী সাহেবকে বলেছিলেন।
কথাপ্রসঙ্গ: শহরের এক ফ্রেঞ্চ বুক শপে যাওয়ার পর প্রাবন্ধিকের ফরাসি ভাষায় কথা বলা শুনে খুশি হয়ে তাঁর চাহিদা অনুসারে বইয়ের ফর্দ টুকে নিয়েছিলেন ফ্রেঞ্চ বুক শপের মেমসাহেব। ফর্দে লিপিবদ্ধ বইগুলি দোকানে এলেই প্রাবন্ধিককে জানানোর আশ্বাসও দিলেন তিনি। ফ্রান্স থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও কারোর সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারার অনির্বচনীয় আনন্দে সুখ-দুঃখের কিছু কথাও আদানপ্রদান করেছিলেন তিনি। বিদেশি মেমসাহেব বলেন, তিনি মাত্র তিন মাস হল কলকাতায় এসেছেন। তিনি ফরাসি ছাড়া আর অন্য কোনো ভাষায় কথা বলতে পারেন না। ইংরেজি ভাষা সামান্যই জানেন তিনি-কাজ চালানোর মতো। ‘ফ্রেস্টও বুক শপ’-টির মালিক তিনি নন। মালিক বান্ধবীর অনুপস্থিতিতে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য প্রচারের জন্য ফরাসি মেমসাহেব এই দোকান চালাতে আগ্রহী হয়েছেন। এইসব নানাবিধ সুখ-দুঃখের কাহিনিই তিনি প্রাবন্ধিকের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।
“ইংরিজী যথেষ্ট জানেন না, তবে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন”-ইংরেজি না জানার ফলে কী হয়েছিল? আলোচ্য ব্যক্তির পরিচয় দাও।
ইংরিজী না জানার ফলাফল: পাঠ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধের আলোচ্য উক্তিটি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এর ফরাসি মেমসাহেবের বিষয়ে করা হয়েছে। ফরাসি মেমসাহেব স্বল্প সময় কলকাতায় এসেছেন। ফলে তিনি বাংলা ভাষা একেবারেই জানেন না, ইংরেজি ভাষা কেবল কাজ চালানোর মতোই জানেন। তাই কলকাতা শহরে ব্যাবসার জন্য ক্রেতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথোপকথন চালাতে তাঁকে অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল।
ব্যক্তির পরিচয়: কলকাতা শহর ভ্রমণে বেরিয়ে প্রাবন্ধিক আলী সাহেব যে ফ্রেঞ্চ বুক শপ-এর সন্ধান পান, সেখানে প্রবেশ করে দোকানের তত্ত্বাবধায়ক ফরাসি মেমসাহেবের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। মাত্র তিন মাস ভারতবর্ষে এসেছেন ফরাসি ভদ্রমহিলা। সেই কারণেই তিনি ইংরেজি ভালো জানেন না। বাংলা ও ইংরেজি না জানার ফলে প্রাবন্ধিককে ফরাসি ভাষায় কথা বলার জন্য তিনি অনুরোধ করেছেন। প্রাবন্ধিকের ভাঙা ভাঙা ফরাসি ভাষা শুনে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। লেখকের দেওয়া বইয়ের ফর্দ টুকে নিয়েছেন মহিলা। বই আসার পর আলী সাহেবকে খবর দেওয়ার ভরসাও দিয়েছেন ফরাসি মেম। বইয়ের দোকান তাঁর বান্ধবীর, তাঁর অনুপস্থিতিতে এই মহিলা ফরাসি ভাষা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে দোকান খুলে রেখেছেন। এইভাবেই কর্তব্যস্বরূপ তিনি তাঁর ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা বজায় রাখতে চেয়েছেন।
“তুলসীদাস বলেছেন-পৃথিবীর কী অদ্ভুত রীতি …”-পৃথিবীর অদ্ভুত রীতিটি কী? তুলসীদাসের প্রসঙ্গ আলোচ্য প্রবন্ধে এসেছে কেন?
অদ্ভুত রীতি: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ রচনায় প্রাবন্ধিক পৃথিবীর এক অদ্ভুত রীতির কথা বলেছেন। হিন্দি সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি তুলসীদাস-এর কথায় পৃথিবীর অদ্ভুত রীতিটি হল-শুঁড়ি (মদ্য- বিক্রেতা) দোকানে বসে থাকে এবং সবাই তার দোকানে গিয়ে মদ কেনে। পক্ষান্তরে, দুধওয়ালাকে ঘরে ঘরে গিয়ে পুষ্টিকর সুষম দুধ বিক্রি করতে হয়।
তুলসীদাস প্রসঙ্গ: তুলসীদাস ছিলেন একজন হিন্দু সন্ত কবি, ধর্মসংস্কারক এবং দার্শনিক। রামভক্তির জন্য তিনি প্রসিদ্ধ। পৃথিবীর মানুষের অদ্ভুত রীতির উপর আলোকপাত করেছিলেন কবি তুলসীদাস। মদ্য মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে, তা স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক অথচ, মদ বিক্রেতা দোকানে বসে থাকেন, সেখানে মদ্যাসক্তরা ভিড় জমায়। আবার দুধওয়ালা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ দেয় দুধ পুষ্টিকর সুষম খাদ্য হওয়া সত্ত্বেও। একইভাবে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ পূর্বে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করতেন অথচ, এখন ফরাসি ভাষা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে ফরাসিরা ছুটে আসছে কলকাতায়। প্রবন্ধে উক্ত মেমসাহেব মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে নয়, কেবল ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রচারকামনায় দোকানে বসেছেন। সাহিত্য-শিল্পকলার পীঠস্থান প্যারিসে পৃথিবীর লোক জড়ো হত ফরাসি বই বেচার জন্য, জ্ঞানের সন্ধানে নিজেদের সমৃদ্ধ করার জন্য। আর আজ উলটো-সুদূর ফ্রান্স থেকে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য প্রচার করতে কলকাতায় ফরাসি বইয়ের দোকান দিতে হচ্ছে।
“বুঝলুম কথা সত্যি।”-কোন্ কথা সত্যি? বক্তা কীভাবে তা ‘সত্যি’ বলে বুঝলেন?
সত্যি কথাটি: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধতে প্রাবন্ধিক তুলসীদাসের একটি উক্তিকে তুলে ধরেছেন। তুলসীদাসের একটি উক্তিকেই লেখক সত্যি কথা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলছেন, ‘পৃথিবীর কী অদ্ভুত রীতি। শুঁড়ি নিজের দোকানে জেঁকে বসে থাকে আর দুনিয়ার লোক তার দোকানে গিয়ে মদ কেনে। ওদিকে দেখ, দুধওয়ালাকে ঘরে ঘরে ধন্না দিয়ে দুধ বেচতে হয়।’
অর্থাৎ, শুড়ি মদ্য বিক্রি করে, অথচ দোকানে বসে থাকে, দুনিয়ার সুরাসক্তরা দোকানে গিয়ে মদ কেনে। অথচ, দুধওয়ালাকে ঘরে ঘরে গিয়ে দুধ বিক্রি করতে হয়। অর্থাৎ, ভালোর পরিবর্তে মন্দের প্রতি তার আকর্ষণ বেশি তাই স্বাস্থ্যহানিকারক মাদক দ্রব্য ক্রয়ে সে দোকানে ছোটে আর দুধ – পুষ্টিকর হওয়া সত্ত্বেও সেটা সংগ্রহে তার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টাই দেখা যায় না। – তুলসীদাসের এ কথাটি কতখানি সত্য তা প্রাবন্ধিক কলকাতার বুকে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ দেখে বুঝেছিলেন।
বক্তার উপলব্ধি: প্যারিস জ্ঞানে-গরিমায়, বিদ্যাচর্চায় চিরকাল উন্নত, সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত। তাই বিশ্বমানব একসময় জ্ঞান অন্বেষণের জন্য প্যারিসে জড়ো হত। ফরাসি সাহিত্য উন্নত চিন্তাভাবনায় ঋদ্ধ হত। আর এখন শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত অবক্ষয়ের কারণে ফরাসি ভাষায় বই বিক্রির জন্য ফরাসিরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষত কলকাতায় ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ খুলে বসেছে। এই কারণেই প্রাবন্ধিক মনীষী তুলসীদাসের কথা সত্যি বলে বুঝেছেন।
“বাঙালী তাহলে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে”-প্রসঙ্গ সহ উদ্ধৃতিটি ব্যাখ্যা করো।
প্রসঙ্গ: সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘আজব শহর কলকেতা’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রাবন্ধিকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার রম্যপরিবেশন। প্রশ্নোক্ত অংশটির বক্তা প্রাবন্ধিক স্বয়ং।
প্রসঙ্গ: হঠাৎ নেমে আসা এক বৃষ্টির দিনে উপায় না পেয়ে প্রাবন্ধিক আজব শহর কলকাতার একটি ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ ঢুকে পড়েন। দোকানের মেমসাহেবের সঙ্গে পরিচয় পর্বে একটি ‘বাঙ্গাল ছোকরা’ সেখানে এসে পড়ে। সে কমার্শিয়াল আর্ট সম্বন্ধে বই আছে কি না তার সন্ধান করছে। বাঙালি ছেলের ফরাসি ভাষায় কমার্শিয়াল আর্টের বইয়ের অন্বেষণ প্রাবন্ধিককে আনন্দিত ও চমৎকৃত করে। ঘরকুনো বাঙালি তার তকমা ঝেড়ে বিশ্বজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে উঠছে-এই বিষয়টিকে বাঙালির অগ্রগতির সোপান বলে ভেবেছেন প্রাবন্ধিক। তাই উৎফুল্ল হয়ে তিনি বুঝেছেন বাঙালি বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে।
তবে এই অনুভূতির মধ্যেও মিশে ছিল ব্যঙ্গ। একে তো বাংলায় বাঙালি পাঠক কম হওয়ায় প্রকাশকরা উৎকৃষ্টমানের বাংলা বই ছাপাতে ভয় পায় সেখানে ফরাসি ভাষা সঠিকভাবে না জেনেই সেই ভাষাতে কমার্শিয়াল আর্টের বইয়ের খোঁজ বাঙালি জাতির ভুয়ো অগ্রগতিকেই বোঝায়। বাঙালি জাতির এই লোকদেখানো, ভণ্ডামির দিকটিকেই কার্যত কটাক্ষ করেছেন প্রাবন্ধিক। ব্যাখ্যা: ‘ফ্রেস্ত বুক শপ’-এ এক বাঙালি ছোকরাকে ফরাসি ভাষায় কমার্শিয়াল আর্টের বই চাইতে দেখে প্রাবন্ধিকের মনে হয়েছিল যে, বাঙালির বেশ খানিকটা অগ্রগতি হয়েছে। যদিও প্রাবন্ধিকের মনের এই ভাবনার সঙ্গে মিশে রয়েছে ব্যঙ্গাত্মক ব্যঞ্জনা। বাঙালি যেখানে মাতৃভাষায় লেখা সাহিত্যই সেভাবে পড়ে না, সেখানে তার ফরাসি ভাষা সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফরাসি কমার্শিয়াল আর্টের বইয়ের খোঁজ বাঙালি জাতির লোক-দেখানো অগ্রগতিকে প্রতিভাত করে।
“আরেক দিন হবে”- উদ্ধৃতিটির অর্থ পাঠ্য প্রবন্ধ অনুসরণে লেখো।
আরেক দিন হবে: সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত আলোচ্য ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক ফ্রেঞ্চ বুক শপে দেখা একটি বই ‘হিটলার চরিত্রবর্ণন’ নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। এই বইটির মূল বিষয়বস্তু ছিল ন্যূরনবর্গের মোকদ্দমায় যেসব দলিল দস্তাবেজ পাওয়া গিয়েছিল, তাই দিয়ে গড়া হিটলারের চরিত্রবর্ণন। হিটলার সম্পর্কে তাঁর প্রতিপক্ষ ফরাসিরা কী ভাবেন-সেই ছবিই ছিল ওই বইটিতে।
কিন্তু সাহিত্যিকরা বহু সময় খাঁটি সত্যকে পাঠকদের সামনে সরাসরি তুলে ধরতে পারেন না। তাই ভোর হয়ে যাওয়ার ও কাকের কা-কা ডাকার অজুহাতে প্রাবন্ধিকের মনে পড়ে যায় তাঁর সেই সীমাবদ্ধতার কথা। এই কাহিনি শেষ হয়েছে হিটলারের সঙ্গে জার্মানির বৈরিতা নিয়ে গ্রন্থের পরিচয় দিতে গিয়ে। অল্প পরিসরে কাহিনির প্রস্তাবনা হিসেবে ফ্রেঞ্চ বুক শপের অন্দরমহলের কথা বলতে গিয়েই নির্দিষ্ট বইটি সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনাদানের পূর্বেই প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন, তাঁর আর লেখার অবসর নেই। এই সীমাবদ্ধতা রক্ষা করতে এবং কার্যত বিতর্কিত প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেই প্রাবন্ধিক ‘আরেকদিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
‘আজব শহর কলকেতা’-য় মেমসাহেবের স্বল্প উপস্থিতিতে তাঁর চরিত্রের কোন্ দিকগুলি ফুটে উঠেছে, আলোচনা করো।
ভূমিকা: ‘আজব শহর কলকেতা’-য় সৈয়দ মুজতবা আলী বৃষ্টির সন্ধ্যায় যে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ দেখেছিলেন, সেই দোকান সামলাচ্ছিলেন এক ফরাসি মেমসাহেব। তার সামান্যতম উপস্থিতি প্রবন্ধকে করে তুলেছে মনোগ্রাহী। আলোচ্য প্রবন্ধে তার চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ পেয়ে তা হল-
অতিথি আপ্যায়ন: প্রাবন্ধিক ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ প্রবেশ করার সময় মেমসাহেব স্মিত হাসিতে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান-এতেই বোঝা যায় তিনি অতিথিবৎসল।
ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি একনিষ্ঠতা ও ভালোবাসা: মেমসাহেব ইংরেজি জানেন না। তিনি স্বাভাবিকভাবে ফরাসি ভাষাতেই সাবলীল। তাই প্রাবন্ধিক সামান্য কারণে ফরাসি বলে ফেললে তিনি প্রাবন্ধিককে অনুরোধ করেন সর্বক্ষণ ফরাসিতে কথা বলার জন্য। ফরাসি ভাষার প্রতি ভালোবাসার কারণেই তাঁর দেশান্তরে আসা এবং বই বিক্রেতার কর্তব্য পালন করা।
জাত্যভিমান: ফরাসি জাতির গুণ, হাজার দোষের মধ্যে কিছু ভালো দেখলেই তার প্রশংসা করা। প্রাবন্ধিক কোনোক্রমে ভাঙা ভাঙা ফরাসি ভাষা বললেও তিনি তাঁকে উৎসাহ দিয়েছেন।
কর্তব্যপরায়ণতা: মেমসাহেব প্রাবন্ধিকের খোঁজ করা বইয়ের ফর্দ টুকে নেন এবং বই এলে খবর দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন-এখান থেকেই তার কর্তব্যনিষ্ঠার ছবি ফুটে ওঠে।
সরলতা: মেমসাহেব সরল মনের পরিচয়বাহী বলে তিনি বলেছেন মাত্র তিন মাস আগে তিনি কলকাতায় এসেছেন এবং প্রাবন্ধিকের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাও ভাগ করেছেন। এখানেই তার সহজসরল স্বভাবধর্মটি প্রকাশিত হয়েছে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাশৈলী ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ অবলম্বনে আলোচনা করো।
বাংলা সাহিত্যে আড্ডার ভঙ্গিতে রম্যরচনার অনন্য রূপকার সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর রচনাশৈলী ‘আজব শহর কলকেতা’ শীর্ষক প্রবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরেও নিজস্বতায় উজ্জ্বল।
প্রথমত: তাঁর লেখায় ইতিহাস, মানবজীবন, সমাজ, রাজনীতি অর্থনীতি ও নান্দনিক বিষয় সবই চমৎকাররূপে প্রতিভাত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: তাঁর রচনায় বাংলার সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি, ফারসি (দুশমন), পুশতু, আরবি (তাগদ, হরফ, সিজিল), জার্মান, ফরাসি প্রভৃতি ভাষার শব্দের অদ্ভুত মিশেল ঘটেছে, যা পাঠকের কাছে প্রবন্ধটিকে আরও সজীব করে তুলেছে।
তৃতীয়ত: কখনও হিউমার, কখনও স্যাটায়ার, কখনও বা উইটের প্রয়োগে তিনি পাঠককে হাস্যরসের সঙ্গে সঙ্গে আঘাতের জ্বালাও সহ্য করতে বাধ্য করেছেন। তাই কখনও বহুকাল বাদে ফরাসি ভাষায় কথা বলা প্রসঙ্গে দশ বছরের পুরোনো মরচে ধরা, জাম-পড়া, ছাতিমাথা ফরাসি তানপুরোর উপমা কিংবা প্রাবন্ধিকের বলা ভুলভাল ফরাসি শুনে মেমসাহেবের ‘আহাহা বাহাবা বাহাবা’ ‘গলা ছড়িয়া গান গাহো’ ইত্যাদি অভিব্যক্তি পাঠককে নির্ভেজাল আনন্দ দেয়।
চতুর্থত: মুজতবা আলী মজলিশি আড্ডার মেজাজ বজায় রেখেছেন প্রবন্ধে। প্রাবন্ধিক যেন পাঠকের পাশাপাশি বসে কথা বলছেন, এমন ভঙ্গিমায় এই প্রবন্ধ লেখা। এই আড্ডার তথ্য পান্ডিত্যের ভার নয়, উপভোগের বিষয়।
পঞ্চমত: জ্ঞানপিপাসু মনের সঙ্গে আনন্দপিপাসু মনের খোরাক সৈয়দ মুজতবা আলী সরস রম্যতায় পরিবেশন করেছেন। ঘরকুনো-নিভৃতচারী পাঠককে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আপনমনে দু-দণ্ড প্রাণ খুলে হাসানোরও দায়িত্ব নিয়েছেন প্রাবন্ধিক।
ষষ্ঠত: প্রাবন্ধিক তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে বর্ণময় করে তুলেছেন। প্রতিটি – অভিজ্ঞতার বর্ণময় বর্ণনা যেন এক একটি রঙিন ক্যানভাস হয়ে উঠেছে।
‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে সৈয়দ মুজতবা আলীর বৈঠকি মেজাজে যে হাস্যরসের উপস্থাপনা করেছেন, সেটি আলোচনা করো।
বৈঠকি প্রবন্ধ: সৈয়দ মুজতবা আলী রম্যরচনার প্রাবন্ধিক। তাঁর বেশিরভাগ প্রবন্ধ হিউমারে শুরু, স্যাটায়ারে শেষ। প্রবন্ধগুলি হালকা চালে বৈঠকি ভঙ্গিতে লেখা বৈঠকি প্রবন্ধ। বৈঠকি বা মজলিশি মেজাজ তৈরি করে পাঠকের মনের মধ্যে ঢুকে পড়ার এই কাজটিই ‘আজব শহর কলকেতা’য় সাধন করেছেন প্রাবন্ধিক।
উপস্থাপনভঙ্গি: ‘আজব শহর কলকেতা’য় কলকাতার একটি ‘ফ্রেঞ্চবুক শপ’ পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা পরিবেশন করেছেন প্রাবন্ধিক। ফরাসি বইয়ের দোকানের দায়িত্বে থাকা ফরাসি মেম-সাহেব ইংরেজি জানেন না। – প্রাবন্ধিকের মুখে দু-একটা ফরাসি শব্দ শুনে তিনি প্রাবন্ধিককে ফরাসিতেই তাঁর বক্তব্য জ্ঞাপন করতে বলেন। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘গানভঙ্গ’ কবিতার রাজা প্রতাপ রায়ের ভঙ্গিতে ‘আহাহা বাহাবা বাহাবা’ কখনো-বা ‘গলা ছাড়িয়া গান গাহো’ ইত্যাদি বলেন। তাঁর ফরাসি কথনের অভিজ্ঞতাটুকু সরস ভাষায় নিবেদন করেছেন প্রাবন্ধিকও। তার সঙ্গে ইয়ার্কিও মিশে রয়েছে। তিনি লেখেন, “বলতে গেলে আমার অবস্থা ডডনং দাঁড়ায়।” আর বলেন, “চালালুম আমার ধেনো মার্কা ফরাসি শ্যাম্পেন”। এভাবেই হাস্যরসের উদ্রেক করেছেন প্রাবন্ধিক। শব্দ প্রয়োগেরে ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বৈচিত্র্য দেখা যায় তাঁর রচনায়।
আরও পড়ুন – বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর