অহিংসা সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণা বিশ্লেষণ করো
অহিংসার প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য
গান্ধিজির তত্ত্ব অনুসারে অহিংসার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়গুলির কথা উঠে আসে সেগুলি হল-
[1] অহিংসার মধ্যে ভীরুতা বা কাপুরুষতার কোনো স্থান নেই: গান্ধিজির অহিংসা তত্ত্বে ভীরুতা বা কাপুরুষতার কোনো স্থান নেই। কারণ ভীতু ব্যক্তিরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রাম করতে চায় না। কাপুরুষতার চেয়ে হিংসাকে তিনি শ্রেয় বলে মনে করতেন।
গান্ধিজির মতে, অহিংসা হল সাহসিকতার সর্বোচ্চ শিখর। অহিংসা প্রয়োগ করতে তরবারি চালনার তুলনায় অনেক বেশি সাহসের দরকার হয়।
[2] পূর্ণ অহিংসা বাস্তবে অসম্ভব: গান্ধিজি এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, পূর্ণ অহিংসার প্রয়োগ বাস্তবে সম্ভব নয়। জীবন রক্ষা, স্বাস্থ্য রক্ষা, খাদ্য সংগ্রহ এবং সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে হিংসার প্রয়োজন হতে পারে। হিংসা যদিও আইনসিদ্ধ নয় তবুও যখন তা আত্মরক্ষার জন্য বা অরক্ষিতকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত হয়, তখন সেটা কাপুরুষোচিত নতি স্বীকারের তুলনায় অনেক বেশি সাহসিকতার কাজ। তবে গান্ধিজি এটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের ন্যূনতম হিংসার পথটিকে বেছে নিতে হবে।
[3] অহিংসা হল আত্মিক শক্তি: গান্ধিজি মনে করতেন, অহিংসা হল আত্মিক বা নৈতিক শক্তি। ঈশ্বরিক শক্তি, এভাবে অহিংসার প্রকৃতিতে আধ্যাত্মিকতাকে আরোপ করতে চেয়েছিলেন গান্ধিজি। তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বরে জীবন্ত বিশ্বাস ছাড়া অহিংসায় জীবন্ত বিশ্বাস অসম্ভব। ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে অহিংসার নীতি হল ঈশ্বরের আদেশ। হিংসা হল বলপ্রয়োগের বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু অহিংসা হল সভ্য মানুষের হাতিয়ার।
[4] হিংসার প্রতিরোধে অহিংসা: গান্ধিজি মনে করতেন, অহিংসা দিয়ে হিংসাকে প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য অহিংস সৈনিককে আত্মপীড়নের মধ্য দিয়ে হিংসাকারীর হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে গান্ধিজি পথনির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘হয় তুমি চোরকে তারই অস্ত্র দিয়ে নিরস্ত্র করবে বা করার চেষ্টা করবে অথবা ভালোবাসা দিয়ে তাকে জয় করবে।’
[5] সামাজিক গুণ হিসেবে অহিংসা: অহিংসা হল প্রেমপ্রীতি, ভালোবাসার প্রকাশ। অহিংস আদর্শে দীক্ষিত ব্যক্তিরা অন্যের উপর কষ্ট চাপিয়ে না দিয়ে সর্বদা নিজেই তা বহন করে চলে। তাই বলা যায়, হিংসার থেকে অহিংসার আদর্শ অনেক উন্নত এবং কঠিন। গান্ধিজির কাছে অহিংসা নিছক ব্যক্তিগত গুণ নয় বরং, এটি হল একটি সামাজিক গুণ, যা সামাজিকভাবে অনুশীলন করা যায়। গান্ধিজি চেয়েছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অহিংসার প্রসার ঘটুক। এভাবে গান্ধিজি ব্যক্তিগত স্তর থেকে অহিংসাকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন।
[6] গণতন্ত্র ও অহিংসা: গান্ধিজির মতে গণতন্ত্র ও হিংসা একসঙ্গে চলতে পারে না। জাতীয় স্তরে অহিংসাকে স্বীকৃতি না দিলে সাংবিধানিক বা গণতান্ত্রিক সরকার বলে কিছু হতে পারে না।
[7] প্রতিহিংসার অবসান: ঘৃণা, বিদ্বেষ থেকে জন্ম নেয় হিংসামূলক মানসিকতা। অহিংস নীতিটির মধ্য দিয়ে মানুষের বিবেকের কাছে আবেদন জানানো হয়, যাতে ব্যক্তির মধ্যে সুকোমল বৃত্তি জাগরিত হয়। কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নেওয়া উচিত নয়। প্রতিপক্ষের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের মাধ্যমে তার উগ্র মানসিকতার পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা করতে হবে।
[৪] সত্য ও অহিংসা ওতপ্রোতভাবে জড়িত: সত্য ও হিংসা পরস্পরের পরিপন্থী। অহিংসা গান্ধিজির কাছে ছিল পরমধর্ম, সত্যের আধার ও সনাতনরূপী। তাঁর মতে, সত্যাগ্রহী সকল প্রকার বঞ্চনা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। গান্ধিজির মতানুসারে, কেবলমাত্র অহিংসার মাধ্যমেই সত্যের উপলব্ধি সম্ভব।
পরিশেষে বলা যায়, গান্ধিদর্শনের মূল মন্ত্রই ছিল অহিংসা যা তিনি আমৃত্যু পর্যন্ত পালন করে গেছেন। গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন অহিংস নীতির সম্পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব নয়। তাই তার মতানুসারে, কোন বৃহত্তর স্বার্থে অনেকসময় হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করা যেতে পারে। এতদসত্ত্বেও গান্ধিজি সকল মানুষকে সত্য ও অহিংস পথেই ব্রতী হতে বলেছিলেন।
আরও পড়ুন – সরকারের বিভিন্ন রূপ বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর