দ্রব্য সম্পর্কে সাধারণ বা লোকায়ত মত | Common or popular opinion about a product

সাধারণ মানুষ লৌকিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দ্রব্যের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্বন্ধে যে মতবাদ পোষণ করে থাকে তাই হল দ্রব্য সম্পর্কে সাধারণ বা লোকায়ত মত। দ্রব্য সম্পর্কিত দার্শনিক আলোচনার ভিত্তি হল লোকায়ত মত। তাই দার্শনিক আলোচনার পূর্বে সাধারণ বা লোকায়ত মত আলোচনা করা হল-
দ্রব্য হল গুণ ও ক্রিয়ার আশ্রয়
আমরা সাধারণ মানুষ আমাদের সহজ বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করি যে, এই পৃথিবীতে অসংখ্য বস্তু আছে, যেমন- চেয়ার, টেবিল, কলম, বই ইত্যাদি। এইসব বস্তুগুলি পরস্পর নিরপেক্ষ এবং এদের প্রত্যেকেরই কোনো-না-কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য আছে। কারণ রূপ, রস, গন্ধ, আকার, আয়তন ইত্যাদি গুণগুলি শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থাকতে পারে না। আধার বা আশ্রয়স্থল (Support or Substratum) অবশ্যই থাকবে। গুণের এই আধারকেই আমরা সাধারণ মানুষ ‘দ্রব্য’ নামে অভিহিত করি। কাজেই দ্রব্য হল গুণের আধার (Substance is the substratum of qualities)।
দ্রব্য হল গুণসমষ্টিযুক্ত বস্তু
এই পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুর দুটি দিক আছে- একটি হল তার গুণের দিক এবং অপরটি হল তার দ্রব্যের দিক। উদাহরণ স্বরূপ, ‘চিনি’ নামক বস্তুটির গুণ হল ‘শ্বেতত্ব’, ‘মিষ্টত্ব’ ও ‘কাঠিন্য’ এবং এইসব গুণের আধার হল চিনির দ্রব্যত্ব। কাজেই, বস্তু হল দ্রব্য ও গুণের সমষ্টি। আর দ্রব্য হল গুণসমষ্টিযুক্ত কোনো বস্তু। যেমন- ইট, কাঠ, পাথর, জল, বই, পেন ইত্যাদি সকল বস্তুই দ্রব্য। এগুলিকে সাধারণত ভৌতদ্রব্য বা জড়দ্রব্য বলা হয়।
দ্রব্য দুই প্রকার- ভৌতদ্রব্য ও অধ্যাত্মদ্রব্য
উপরে উল্লিখিত দ্রব্যগুলি হল জড়দ্রব্য বা ভৌতদ্রব্য। কিন্তু জড়দ্রব্য ছাড়াও আরও একপ্রকার অধ্যাত্মদ্রব্য আছে, তা হল আত্মা বা মন (Soul)। আমরা যে সুখ-দুঃখ অনুভব করতে পারি, কোনো কিছুর ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারি, চিন্তা করতে পারি -এই সকল ক্রিয়ার জন্য এমন একটি কিছু আধার স্বীকার করতে হয়, যার দ্বারা এসব ক্রিয়া সম্ভব হয়। আত্মা বা মন-ই হল সেই আধার, যার দ্বারা এইরূপ ক্রিয়াগুলির ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব।
সাধারণ মতে দ্রব্য
সাধারণ বা লৌকিক মত অনুযায়ী, দ্রব্য হল বস্তুর এমন এক মূল সত্তা, যা শত বাহ্য-পরিবর্তনের মধ্যেও অপরিবর্তিত থাকে, যা ক্রিয়া, শক্তি ও প্রচেষ্টার উৎস এবং যা গুণের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে।
লৌকিক মত অনুযায়ী দ্রব্যের বৈশিষ্ট্য
দ্রব্যের সংজ্ঞাটিকে বিশ্লেষণ করলে দ্রব্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
দ্রব্য হল গুণের আধার
দ্রব্য হল গুণের আধার বা আশ্রয়স্থল। বস্তুর গুণগুলি দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকে এবং গুণের মাধ্যমেই দ্রব্য নিজেকে প্রকাশ করে। যেমন, ‘গোলাপ’ নামক বস্তুটির গুণ হল ‘লালত্ব’, ‘গন্ধত্ব’, ‘গোলত্ব’ ও ‘কোমলতা’। অর্থাৎ ‘গোলাপ‘ দ্রব্যটি লালত্ব, গন্ধত্ব, গোলত্ব, কোমলতা ইত্যাদি গুণগুলিকে আশ্রয় করে থাকে এবং এই সকল গুণের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।
দ্রব্য হল অপরিবর্তনীয় সত্তা
দ্রব্য নানা পরিবর্তনের মধ্যেও অপরিবর্তনীয় থাকে। কোনো বস্তুর গুণের বা অবস্থানের পরিবর্তন হলেও দ্রব্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। যেমন-একটি টেবিলের রং যদি বদলে যায়, তার স্বাভাবিক আকার যদি বিকৃত হয়ে যায় তবুও আমরা তাকে টেবিলই বলি। তার গুণের পরিবর্তন হলেও টেবিলের কোনো পরিবর্তন হয় না। আবার যদি টেবিলটিকে উল্টে রাখা হয় তাহলেও সেটিকে আমরা টেবিল বলি। অর্থাৎ অবস্থানের পরিবর্তন হলেও দ্রব্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন হলেও দ্রব্য নিজে অপরিবর্তনীয় থাকে।
দ্রব্য হল ক্রিয়াশীলতার উৎস
দ্রব্য অপরিবর্তিত থাকে বলে দ্রব্যকে ক্রিয়ার উৎস বলা হয়। অর্থাৎ, গুণ যেমন দ্রব্যে আশ্রিত থাকে, ক্রিয়াও তেমনই দ্রব্যে আশ্রিত থাকে। যখন বলা হয় মাথার উপর পাখাটি ঘুরছে, তখন ঘোরা ক্রিয়াটি রয়েছে পাখাতে। অর্থাৎ পাখাতে ওই ক্রিয়াটি আশ্রিত। সুতরাং পাখাটি একটি দ্রব্য।
দ্রব্যই হল একমাত্র যা অন্য দ্রব্যের উপর ক্রিয়া করতে পারে। যেমন- আগুন জলকে বাষ্প করতে পারে। কারণ আগুন ও জল উভয়েই দ্রব্য। কিন্তু কোনো গুণ অন্য গুণের উপর দ্রব্যকে ছাড়া ক্রিয়া করতে পারে না। দ্রব্য গুণের মাধ্যমে অন্য দ্রব্যের উপর ক্রিয়া করে।
দ্রব্য হল বস্তুর শক্তি, ক্রিয়া ও প্রচেষ্টার উৎস এবং এই দ্রব্যের প্রকাশ ঘটে গুণের মাধ্যমে। গুণ যেমন গুণীকে বা দ্রব্যের উপর নির্ভর করে, কর্ম বা ক্রিয়াও সেইরকম দ্রব্যের উপর নির্ভর করে। আমরা নিছক গতিকে দেখি না, দেখি গতিমান কোনো বস্তুকে। অনুরূপভাবে শক্তিমানকে বাদ দিয়ে শক্তির কথা ভাবা যায় না।
দ্রব্য গুণ নয়
গুণ দ্রব্যের মধ্যে থাকলেও দ্রব্য থেকে গুণ কিন্তু ভিন্ন। অর্থাৎ দ্রব্য ও গুণ পরস্পর ভিন্ন। কিন্তু তাদের মধ্যে সম্বন্ধও আছে। দ্রব্য ও গুণের মধ্যে এই সম্বন্ধকে কেন্দ্র করে দর্শনে বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে।
দ্রব্য হল সাংগঠনিক ঐক্যকেন্দ্র
দ্রব্য বস্তুর বিভিন্ন অংশের মধ্যে ঐক্যবিধান করে। দ্রব্য হল বস্তুর অন্তর্নিহিত ঐক্যবিধি, যার জন্য কোনো বস্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একই বস্তুরূপে থাকে। বস্তুর গুণগুলিকে বাদ দিয়ে যেমন বিশুদ্ধ একক দ্রব্য থাকতে পারে না, তেমনি বিশুদ্ধ একক দ্রব্যকে বাদ দিয়ে গুণগুলিও থাকতে পারে না। তাই বলা যায় দ্রব্য হল অনেককে নিয়ে গঠিত এক সাংগঠনিক ঐক্যকেন্দ্র।
সমালোচনা
দ্রব্য সম্পর্কে সাধারণ মতবাদ সন্তোষজনক নয়। এ কথা সত্য যে, এই মতবাদ স্বীকার করলে বস্তুর স্থায়িত্ব ও অভিন্নতার ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। আসলে দ্রব্য সম্পর্কে লৌকিক মতটি সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে কোনো যুক্তিবুদ্ধির ভূমিকা নেই বললেই চলে।
দ্রব্য সম্পর্কে সাধারণ মতটি নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন-দ্রব্যের সঙ্গে গুণের সম্বন্ধ কী? নানা পরিবর্তনের মধ্যেও যা অপরিবর্তিত থাকে, তার প্রকৃত স্বরূপ কী? দ্রব্য কি গুণের সমষ্টি মাত্র, না গুণের অতিরিক্ত কিছু? দ্রব্য যদি গুণের অতিরিক্ত কিছু হয়, তবে সেই ‘অতিরিক্ত কিছু’-টি কী? দ্রব্যকে কীভাবে জানা যায়? দ্রব্য এক না বহু? এইসব প্রশ্নের সদুত্তর সাধারণ মতবাদে পাওয়া যায় না। তাই দার্শনিক বিচারে দ্রব্য সম্পর্কে লৌকিক মতটি গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে দ্রব্যের ব্যাখ্যার অসংগতি দূর করার জন্য নানা দার্শনিক মতবাদের উদ্ভব হয়েছে।
আরো পড়ুন : দিগ্বিজয়ের রূপকথা কবিতার বিষয়বস্তু
আরও পড়ুন : আদরিণী গল্পের MCQ প্রশ্ন উত্তর
আরও পড়ুন : অন্ধকার লেখাগুছ MCQ প্রশ্ন উত্তর
আরও পড়ুন : দিগ্বিজয়ের রূপকথা কবিতার MCQ
আরও পড়ুন : ভাষাবিজ্ঞান ও তার শাখাপ্রশাখা MCQ প্রশ্ন উত্তর