স্কিনারের সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্ব | Skinner’s operant conditioning (Class 11 Exclusive )

1935 সালে Science of Human Behaviour নামে স্কিনার একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি তাঁর গবেষণাগুলি থেকে প্রাপ্ত নীতিসমূহের উল্লেখ করেন। এই পুস্তকটি আমেরিকার শিক্ষাজগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন মনোবিদ ও শিক্ষাবিদগণ এই অপারেন্ট বা সক্রিয় আচরণের ওপর পরীক্ষা শুরু করেন।

স্কিনারের সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্ব | Skinner’s operant conditioning

স্কিনারের সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্ব
স্কিনারের সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্ব

স্কিনারের সক্রিয় অনুবর্তন [Skinner’s operant conditioning]

মনোবিজ্ঞানী স্কিনার (Skinner)-এর মতে মনস্তত্বের উদ্দেশ্য হল প্রাণীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্বাভাসদান। এখানে আচরণ বলতে প্রাণীর সেইসব সক্রিয়তার কথা বোঝায় যা অন্যের পর্যবেক্ষণগ্রাহ্য। পরীক্ষামূলক গবেষণার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও তার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে স্কিনার যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্কিনারের মতে, আচরণ দু-রকমের-রেসপনডেন্ট এবং অপারেন্ট। যেসব আচরণে নির্দিষ্ট উদ্দীপক আছে, যেমন-লালা নিঃসরণের জন্য খাদ্য, চোখের সংকোচনের জন্য উজ্জ্বল আলো ইত্যাদি রেসপন্ডেন্ট জাতীয় আচরণের অন্তর্ভুক্ত।

আর যেসব আচরণের নির্দিষ্ট কোনো উদ্দীপক নেই, যে- কোনো উদ্দীপকের সঙ্গে ওই আচরণ ঘটানো যেতে পারে তা অপারেন্ট জাতীয় আচরণের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, কোনো শিক্ষার্থী যদি বানান ভুল কমাতে পারে তাহলে তাকে চকোলেট দেওয়া। এ ছাড়া চাহিদা, বেদনাদায়ক অনুভূতি, আনন্দদায়ক অনুভূতি প্রভৃতি অধিকাংশ ইচ্ছাসাপেক্ষ আচরণ অপারেন্ট জাতীয়। স্কিনার প্রধানত অপারেন্ট জাতীয় আচরণের ওপর গবেষণা করেছিলেন, যেখানে প্যাভলভ করেছিলেন রেসপনডেন্ট জাতীয় আচরণের ওপর।

1935 সালে Science of Human Behaviour নামে স্কিনার একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি তাঁর গবেষণাগুলি থেকে প্রাপ্ত নীতিসমূহের উল্লেখ করেন। এই পুস্তকটি আমেরিকার শিক্ষাজগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন মনোবিদ ও শিক্ষাবিদগণ এই অপারেন্ট বা সক্রিয় আচরণের ওপর পরীক্ষা শুরু করেন।

(1) স্ক্রিনারের পরীক্ষা: 

অপারেন্ট বা সক্রিয় অনুবর্তনের জন্য পরীক্ষা করতে স্কিনার নিজস্ব যন্ত্র ও পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি বিশেষ একটি বাক্স ব্যবহার করেছিলেন যেটি ‘স্কিনারের বাক্স’ (Skinner’s Box) বলে খ্যাত। এই বাক্সে একটি ট্রে আছে, যার মধ্যে ইলেকট্রিক বোতামের সাহায্যে খাদ্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা থাকে। সাবজেক্ট (যার ওপর পরীক্ষা করা হয়) হিসেবে একটি ক্ষুধার্ত ইঁদুরকে নেওয়া হয়। মূল পরীক্ষার জন্য ইঁদুরটিকে প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে ট্রেতে খাদ্য রাখা হয়। মনে রাখতে হবে, এখানে বোতাম টিপে ট্রেতে খাদ্য আনা হয়নি। পরে ইঁদুরটিকে বাক্সে রাখা অবস্থায় বোতাম টিপে খাদ্য আনা হয়।

প্রথমবারে ট্রেতে খাদ্য আনার উদ্দেশ্য ছিল ইঁদুরটিকে ট্রেতে করে খাদ্য সরবরাহের সঙ্গে পরিচিত করানো এবং দ্বিতীয়বারের উদ্দেশ্য ছিল স্কিনারের পরীক্ষার সঙ্গে পরিচিত করানো। এরপরে ইঁদুরটিকে পুনরায় বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ইঁদুরটি ট্রের দিকে ছুটে যায়, খাদ্য পাওয়ার আশায়। কিন্তু না পাওয়ায় নানা প্রকারের সম্মলনমূলক আচরণ করতে থাকে। হঠাৎ ইঁদুরটি বাক্সের মধ্যে অবস্থিত বোতামটির ওপর চাপ দিয়ে ফেললে খাদ্যবস্তু ট্রেতে চলে আসে। এই পরীক্ষা বেশ কয়েকবার করার পর দেখা যায় ইঁদুরটিকে বাক্সে রাখামাত্র যথাস্থানে গিয়ে বোতাম টিপে খাদ্য নিয়ে আসে।

এখানে বলা যায় খাদ্যপ্রাপ্তি ইঁদুরকে প্রতিক্রিয়ার (যথাস্থানে গিয়ে বোতাম টেপা) শক্তি (রি-এনফোর্স) জোগায়, যা ইঁদুরটি শিখেছে। যেহেতু আচরণটি (যথাস্থানে গিয়ে বোতাম টেপা) যান্ত্রিকভাবে (ইনস্ট্রুমেন্টাল) পুরস্কার (খাদ্য)-এর সঙ্গে যুক্ত, তাই একে যান্ত্রিক (ইনস্ট্রুমেন্টাল) শিখনও বলা হয়। এখানে আচরণ ও শক্তিদাতা উদ্দীপক (রি-এনফোর্সার) গুরুত্বপূর্ণ। যদি খাদ্য বা রি-এনফোর্সার বা শক্তিদায়ী উদ্দীপক বারবার দেওয়া না হয়, তাহলে আচরণটি (যথাস্থানে গিয়ে বোতাম টেপা) দেখা যাবে না। শক্তিদায়ী উদ্দীপক এখানে ফিডব্যাকের কাজ করে, যা শিখনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সক্রিয় অনুবর্তন হল এমন একটি শিখন প্রক্রিয়া যেখানে শক্তিদায়ী উদ্দীপকের সাহায্যে প্রতিক্রিয়ার সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি করা হয় বা প্রতিক্রিয়া ঘটানো হয়। সক্রিয় অনুবর্তনে প্রতিক্রিয়া করার সঙ্গে সঙ্গেই উদ্দীপক আসে, তাই শিক্ষাক্ষেত্রে এটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

(2) সক্রিয় অনুবর্তনের নীতি: 

সক্রিয় অনুবর্তনের নীতিগুলি হল-

  1. বিন্যাসকরণ: প্রাণীর মধ্যে বাঞ্ছিত আচরণ নিয়ে আসার জন্য পরিকল্পিতভাবে শক্তিদায়ী উদ্দীপকের ব্যবস্থাকেই বিন্যাসকরণ (Shaping) বলে।
  2. শক্তিদাতা: স্কিনার আচরণ পরিবর্তনের কৌশল হিসেবে শক্তিদায়ী উদ্দীপক (রি-এনফোর্সার) ব্যবহার করেছেন। শক্তিদাতা বলতে এমন ঘটনাকে বোঝায় যা আচরণের সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি করে।
  3. প্রাথমিক প্রস্তুতি: সক্রিয় অনুবর্তন সৃষ্টি হওয়ার আগে প্রাণীর প্রাথমিক প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। এই প্রস্তুতি প্রাণীকে পরীক্ষামূলক পরিস্থিতির উপযোগী করে তোলে। বিলোপসাধন যদি সঠিক প্রতিক্রিয়াটি করার পরেও শক্তিদায়ী উদ্দীপক না পাওয়া যায় তাহলে প্রাচীন অনুবর্তনের মতো সক্রিয় অনুবর্তনেরও বিলোপ ঘটে।
  4. স্বতঃস্ফূর্ত পুনরাবির্ভাব: প্রাচীন অনুবর্তনের মতো সক্রিয় অনুবর্তনেরও স্বতঃস্ফূর্ত পুনরাবির্ভাব ঘটে। সক্রিয় অনুবর্তনের বিলোপসাধনের পরে যদি কিছু সময়ের জন্য প্রাণীকে দূরে রেখে পুনরায় একই পরিস্থিতিতে নিয়ে এসে দু-একবার শক্তিদায়ী উদ্দীপক উপস্থাপন করা হয়, তাহলে পুনরায় সক্রিয় অনুবর্তন দেখা যাবে।
  5. স্থায়িত্ব: সক্রিয় অনুবর্তনে অর্জিত আচরণের স্থায়িত্ব নির্ভর করে শক্তিদায়ী উদ্দীপকের উপস্থিতির ওপর। অনুবর্তিত আচরণ বজায় রাখার জন্য কখন কীভাবে শক্তিদায়ী উদ্দীপক ব্যবহার করতে হবে, তা স্কিনার উল্লেখ করেছেন। একে ‘সিডিউল’ বলে।

(3) শিক্ষাক্ষেত্রে সক্রিয় অনুবর্তনের তাৎপর্য: 

সক্রিয় অনুবর্তন বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- পরিকল্পিত শিখন পদ্ধতি এবং  আচরণ সংশোধন।

  1. পরিকল্পিত শিখন পদ্ধতি: স্কিনারের সক্রিয় অনুবর্তন নীতিকে ভিত্তি করে এই যুগান্তকারী শিখন পদ্ধতিটি রূপ পেয়েছে। পরিকল্পিত শিখন পদ্ধতি হল পাঠ্য বিষয়কে পরিকল্পিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ ক’রে বিষয়টিকে শেখা। যে বিষয়টি শিক্ষার্থী শিখবে, সেই বিষয়টিকে শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা হয়। একে ফ্রেম বলে। প্রত্যেকটি ফ্রেম এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই নিজে পড়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। ওই ফ্রেমগুলি পুস্তিকার আকারে বা ভিডিয়ো টেপে ধরে রাখা হয়। শিক্ষার্থী প্রতিটি অংশ বা ফ্রেম পর্যায়ক্রমে শেখে। প্রতিটি অংশেই প্রশ্ন থাকে। একটি অংশ বা ফ্রেমের প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারলে পরবর্তী অংশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। আবার ওই অংশটিই পড়তে হয়। এইভাবে পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থী সমগ্র বিষয়টি আয়ত্ত করে।
  2. আচরণ সংশোধন: অবাঞ্ছিত আচরণ সংশোধন, ভুল বানান শুদ্ধ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সক্রিয় অনুবর্তন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে দুটি নীতিশক্তিদায়ী উদ্দীপক এবং বিন্যাসকরণ বা শেপিং প্রয়োগ করা হয়। এ ছাড়াও কম্পিউটারভিত্তিক শিখন, ম্যাথেমেটিকস প্রভৃতি ক্ষেত্রে সক্রিয় অনুবর্তনের প্রয়োগ দেখা যায়।

(4) সক্রিয় অনুবর্তনের সীমাবদ্ধতা: 

যদিও অধিকাংশ মনোবিদগণ ব্যক্তির আচরণ সংশোধন এবং শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণে সক্রিয় অনুবর্তনের কার্যকারিতা স্বীকার করেছেন, তবে কোনো কোনো মনস্তত্ত্ববিদ ল্যাবরেটরির বাইরে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নোয়াম চমস্কি (Noam Chomsky)। চমস্কি সক্রিয় অনুবর্তনের যেসব সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন, সেগুলি হল-

  1. স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রয়োগযোগ্যতার অভাব: চমস্কি বলেন, পরীক্ষাগারের মতো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে শিখন সংক্রান্ত পরীক্ষায় যে ফল পাওয়া যায়, স্বাভাবিক শিখন পরিস্থিতিতে তার প্রয়োগযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। পরীক্ষাগারে সক্রিয় অনুবর্তনের যে নীতিগুলি আবিষ্কৃত হয়, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তার প্রয়োগ সম্পর্কে প্রশ্ন থাকাই স্বাভাবিক, কারণ এখানে আচরণ ও তার নিয়ন্ত্রণকারী উদ্দীপকের সম্পর্ক অনেক জটিল। 
  2. বংশগত ও গঠনগত উপাদান উপেক্ষিত: স্কিনার ব্যক্তির বংশগত ও গঠনগত উপাদানগুলির ওপর কোনো গুরুত্ব আরোপ করেননি, যদিও মনস্তত্ত্বের দিক থেকে ভাষার বিকাশে এর গুরুত্ব আজ সকলেই স্বীকার করেছেন।
  3. অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা: সক্রিয় অনুবর্তনে শক্তিদায়ী উদ্দীপক-ব্যবস্থা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা, কৌতূহল এবং সৃজনশীলতার ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়।
  4. সহজাত বৈশিষ্ট্য উপেক্ষিত: চমস্কি সহজাত বৈশিষ্ট্যাবলির কথা অস্বীকার করে বলেছেন, সমস্ত আচরণ মানুষের জীবনকালেই অর্জিত হয়। মনোবিদগণ একথা স্বীকার করেন না।
আরও পড়ুনLink
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
আগুন নাটকের বড়ো প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment