শিখন প্রশ্ন উত্তর ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার শিক্ষাবিজ্ঞান

সূচিপত্র

শিখন প্রশ্ন উত্তর ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার শিক্ষাবিজ্ঞান | Shikhon Long Question Answer | Class 12 Semester 4th Education

শিখন প্রশ্ন উত্তর
শিখন প্রশ্ন উত্তর

১। শিখনের সংজ্ঞা দাও। শিখনের বৈশিষ্ট্য লেখো।

শিখনের সংজ্ঞা

বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী শিখনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা এখানে উল্লেখ করা হল-

মেলভিন এইচ মার্কস (Melvin H Marx) প্রদত্ত সংজ্ঞা: শিখন হল অপেক্ষাকৃত স্থায়ী আচরণের পরিবর্তন যা পূর্বের আচরণের ফল (যাকে সাধারণত অনুশীলন বলা হয়)।

এইচ পি স্মিথ (HP Smith) প্রদত্ত সংজ্ঞা: শিখন হল নতুন আচার-আচরণ, অথবা অভিজ্ঞতার ফলে পুরোনো আচরণের দৃঢ়ীকরণ বা শিথিলকরণ।

ম্যাকগিয়ক এবং ইরোডেন (McGeoch and Iroven) প্রদত্ত সংজ্ঞা: সক্রিয়তা, অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতার ফলে আচরণের পরিবর্তনই হল শিখন।

কিংসলে এবং গ্যারি (Kingsley and Garry) প্রদত্ত সংজ্ঞা: শিখন হল একপ্রকার প্রক্রিয়া যার দ্বারা আচরণ সৃষ্টি হয়, অথবা অনুশীলন বা প্রশিক্ষণের দ্বারা পরিবর্তিত হয়।

কার্যকরী সংজ্ঞা: অতীতের অভিজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণের প্রভাবে আচরণের পরিবর্তনের প্রক্রিয়াই হল শিখন।

শিখনের বৈশিষ্ট্য

শিখনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

[1] উদ্দেশ্যমুখী: প্রথাগত শিক্ষায় শিখন উদ্দেশ্যমুখী অর্থাৎ, পূর্বনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আয়ত্ত করার জন্যই শিক্ষার্থীরা শেখে।

[2] বিকাশমান: শিখন হল একটি ক্রমবিকাশমান প্রক্রিয়া। জন্মকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবনে শিখনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

[3] অভিযোজনমূলক: শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাণীরা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে শেখে এবং নতুন কোনো সমস্যায় পড়লে সমাধানের পথ খুঁজে বার করে।

[4] চাহিদানির্ভর: শিখন প্রক্রিয়া চাহিদানির্ভর অর্থাৎ, চাহিদা পূরণ শিখনকে নিয়ন্ত্রণ করে।

[5] ব্যক্তি ও সমাজ নির্ভর: শিখন যেমন ব্যক্তির চাহিদার ওপর নির্ভর করে, তেমনি সমাজের চাহিদার দ্বারাও শিখন প্রভাবিত হয়। শিখন হল একইসঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজনির্ভর প্রক্রিয়া।

[6] আচরণগত পরিবর্তন: ব্যক্তি যখন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন সে পূর্বার্জিত আচরণের দ্বারা তা সমাধানের চেষ্টা করে। তাই শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি তার আচরণের পরিবর্তন করে।

[7] স্থায়ী পরিবর্তন: শিখনের ফলে যে পরিবর্তন হয় তা স্থায়ী প্রকৃতির। অন্যান্য অস্থায়ী বা সাময়িক পরিবর্তনের সঙ্গে শিখনজাত পরিবর্তনের এখানেই পার্থক্য।

[৪] সার্বিক বিকাশে সহায়ক: শিখনের ফলে ব্যক্তি যে কেবলমাত্র কয়েকটি কৌশল অর্জন করে তা-ই নয়, শিখনের ফলে ব্যক্তির বিভিন্ন দিকেরও বিকাশ ঘটে।

[9] অনুশীলনসাপেক্ষ: পুরোনো আচরণ ত্যাগ করে নতুন নতুন আচরণ আয়ত্ত করার জন্য ব্যক্তিকে বারবার অনুশীলন করতে হয়। অনুশীলন ছাড়া শিখন স্থায়ী হয় না।

[10] শিখনের হার: পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রথম দিকে শিখন খুব দ্রুত ঘটে। পরে এর হার হ্রাস পায় এবং এমন এক সময় আসে যখন অনুশীলনের ফলেও শিখনের উন্নতি হয় না। একেই শিখনের অধিত্যকা বলে।

[11 ] অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন: প্রতিটি শিখনই অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন। প্রতিটি শিখনেই পুরোনো অভিজ্ঞতা নতুন পরিস্থিতিতে পুনর্গঠিত হয়ে কার্যকরী হয়। অর্থাৎ, শিখনের ফলে অভিজ্ঞতাসমূহের পুনর্গঠন হয়।

[12] সক্রিয় প্রক্রিয়া: ব্যক্তি নিজে সক্রিয় না হলে শিখন সম্ভব নয়। শিখনের জন্য চাই প্রচেষ্টা। প্রচেষ্টায় অভাব দেখা দিলে যথাযথ শিখন হয় না।

[13] সর্বজনীন প্রক্রিয়া: শিখন কেবলমাত্র মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইতর প্রাণীদের ক্ষেত্রেও শিখন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। কারণ তারাও শিখনের মাধ্যমে পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়।

মন্তব্য

শিক্ষামনস্তত্ত্বে বহু-আলোচিত শিখন একটি জটিল মানসিক প্রক্রিয়া। শুধু মানুষ নয়, সমস্ত প্রাণীরই সার্থকভাবে বেঁচে থাকার প্রধান কৌশল হল শিখন। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণ হল তার শিখন ক্ষমতা যা অন্যান্য প্রাণীর থেকে অনেক বেশি। এই ক্ষমতাকে যাতে আরও সার্থকভাবে ব্যবহার করা যায় তার জন্য প্রয়োজন শিখনের বৈশিষ্ট্যাবলি সম্পর্কে সঠিক ধারণা।

২। শিক্ষামনোবিদ গ্যাগনের/গ্যানের মত অনুসারে শিখনের প্রকারভেদ আলোচনা করো।

শিক্ষামনোবিদ গ্যাগনের/গ্যানের মত অনুসারে শিখনের প্রকারভেদ

আমেরিকার বিশিষ্ট শিক্ষামনোবিদ রবার্ট এম গ্যানে (Robert M Gagne) 1956 সালে ব্যক্তির মানসিক প্রক্রিয়াসমূহের জটিলতার স্তর অনুযায়ী শিখনের প্রকারভেদ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি শিখনের আটটি প্রধান প্রকার চিহ্নিত করেন এবং সেগুলিকে একটি বিশেষ সজ্জাক্রম (hierarchy) অনুযায়ী বিন্যস্ত করেন।

গ্যানের মতে, এই শ্রেণিবিন্যাসে উচ্চ পর্যায়ের (higher orders) শিখন নিম্নস্তরের শিখনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এদের উৎকর্ষের জন্য পূর্ববর্তী শিখনের জ্ঞান অপরিহার্য। এই আট ধরনের শিখনের মধ্যে প্রথম চারটি (এক থেকে চার পর্যন্ত) পর্যায় মূলত শিখনের আচরণগত দৃষ্টিভঙ্গিকে সূচিত করে। অন্যদিকে, অপর চারটি (পাঁচ থেকে আট পর্যন্ত) পর্যায় শিখনের প্রজ্ঞামূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে সূচিত করে।

নীচে গ্যানের আটপ্রকার শিখন সম্পর্কে আলোচনা করা হল-

[1] সংকেত শিখন: এটি সবচেয়ে সরল প্রকৃতির শিখন। এটিকে সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন আচরণবাদী মনোবিদ প্যাভলভ (Pavlov) এটি প্রকৃতপক্ষে ধ্রুপদি বা প্রাচীন অনুবর্তন (classical conditioning)-জনিত শিখন। গৌণ বা কৃত্রিম বা বিকল্প উদ্দীপকের দ্বারা প্রাণীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে ধ্রুপদি বা প্রাচীন অনুবর্তন বলে। বর্ণ, শব্দ, নামতা ইত্যাদি শিখনে প্রাচীন অনুবর্তন তথা সংকেত শিখনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ব্যক্তির মধ্যে অভ্যাস গঠনে এই শিখনের বিশেষ অবদান লক্ষ করা যায়।

[2] উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়া শিখন: এটি প্রকৃতপক্ষে এক প্রকার উন্নত ধরনের শিখন। এটি সক্রিয় বা অপারেন্ট অনুবর্তন নামে পরিচিত। পরস্পর-সম্পর্কিত একাধিক আচরণের মধ্য দিয়ে বাঞ্ছিত আচরণের দিকে নিয়ে যাওয়াই সক্রিয় অনুবর্তনের উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে প্রাণীর প্রতিক্রিয়া ঘটার পর শক্তিদায়ী উদ্দীপক ব্যবহার করা হয়। এই অনুবর্তনে প্রেষণা ও পুরস্কারের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সক্রিয় অনুবর্তনের নীতি বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- [i] পরিকল্পিত শিক্ষণ পদ্ধতি এবং [ii] আচরণ সংশোধন কৌশল। এ ছাড়াও শক্তিদায়ী উদ্দীপকের সাহায্যে শিক্ষাভীতিকে দূর করা যায়। শিক্ষার্থীর আকাঙ্ক্ষিত আচরণকে তাৎক্ষণিক শক্তিদায়ী উদ্দীপকের মাধ্যমে শক্তিশালী করা যায়।

[3] শৃঙ্খলিতকরণ শিখন: এটি অত্যন্ত উন্নতমানের শিখন। এইপ্রকার শিখনের দ্বারা অতি জটিল চিন্তন কর্মসমন্বয় দক্ষতা (psycho-motor skill) অর্জিত হয়, যেমন- সাইকেল চালানো বা পিয়ানো বাজানো ইত্যাদি।

[4] বাচনিক বা ভাষাগত সংযোগসাধনের মাধ্যমে শিখন: এটিও এক ধরনের শৃঙ্খলিতকরণ, যাতে বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সংযোগ সাধন করা হয়।

[5] বিনিশ্চয় শিখন বা পার্থক্যকরণ শিখন: এইপ্রকার শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই সকল সামর্থ্য বা দক্ষতা গড়ে তোলা হয়, যার দ্বারা তারা একই ধরনের এক গুচ্ছ উদ্দীপকের ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত অথচ ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। এই ধরনের শিখন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও কঠিন।

[6] ধারণা শিখন: ধারণা হল কোনো-একটি বস্তু সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞান। ধারণা শিখনে কোনো বস্তু বা বিষয়ের আলোচনার সময় সেগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্যের দিকে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

[7] নিয়ম শিখন: এটি প্রকৃতপক্ষে অতি উচ্চমানের প্রজ্ঞামূলক শিক্ষাপদ্ধতি। এইজাতীয় শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধারণার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক খুঁজে পেতে সমর্থ হয়। এই-জাতীয় শিখন ছাত্রছাত্রীদের সাধারণ নিয়মাবলি ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করে।

[৪] সমস্যাসমাধানমূলক শিখন: সমস্যাসমাধানমূলক শিখন হল এক বিশেষ ধরনের শিখন পদ্ধতি, যার দ্বারা শিক্ষার্থী প্রয়োজনমতো প্রতিক্রিয়া জানানোর বা সাড়া দেওয়ার উপযুক্ত ধরনটি আবিষ্কার করতে পারে। মনোবিদদের মতে, এই ধরনের শিখন সব থেকে জটিল। গ্যানে ‘সমস্যা সমাধান’-কে চিন্তন প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

৩। পরিণমন কাকে বলে? পরিণমনের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।

পরিণমন

স্কিনারের মত অনুযায়ী, পরিণমন হল এর ধরনের বিকাশ যা পরিবেশগত অবস্থার ব্যাপক তারতম্য থাকলেও মোটামুটি একইভাবে সংঘটিত হয়। মনোবিদ গেসেলের মতে, স্বকীয় ও অন্তর্জাত বৃদ্ধিই হল পরিণমন। মনোবিদ কোলেস্পিস্নকের মতে, জন্মগত প্রবণতাগুলি স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার ফলে শিশুর আচরণের গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়াই হল পরিণমন।

পরিণমনের বৈশিষ্ট্য

পরিণমন হল এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জন্মগত প্রবণতার স্বাভাবিক বিকাশের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির আচরণের গুণগত ও পরিমাণগত, উভয় প্রকারের পরিবর্তন ঘটে। নীচে পরিণমনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা হল-

[1] বিকাশের প্রক্রিয়া: পরিণমন হল একটি বিকাশমূলক প্রক্রিয়া যার দ্বারা ব্যক্তির বৃদ্ধি ঘটে।

[2] সহজাত প্রবণতার ওপর নির্ভরশীল প্রক্রিয়া: পরিণমন প্রক্রিয়া শিশুর সহজাত প্রবণতার ওপর নির্ভরশীল। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সম্ভাবনাগুলির বিকাশের ওপর পরিণমন নির্ভর করে।

[3] স্বাভাবিক প্রক্রিয়া: পরিণমন প্রক্রিয়া শিশুর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ঘটে। এই প্রক্রিয়া শর্তাধীন নয়।

[4] প্রশিক্ষণনির্ভর নয়: পরিণমন ঘটার জন্য কোনো প্রকার প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। এই প্রক্রিয়া ব্যক্তি বা সমাজের চাহিদা, ইচ্ছা, অবস্থা, পরিস্থিতি কোনো কিছুর ওপর নির্ভরশীল নয়।

[5] চাহিদানির্ভর নয়: পরিণমন প্রক্রিয়াটি শিশুর চাহিদার ওপর নির্ভর করে না। এটি সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখেও ঘটে না।

[6] শারীরিক ক্ষমতা অর্জনে সহায়ক: পরিণমন ব্যক্তির শারীরিক ক্ষমতা অর্জনে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

[7] সক্রিয়তাভিত্তিক নয়: পরিণমন প্রক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার জন্য ব্যক্তির আত্মসক্রিয়তার খুব একটা প্রয়োজন হয় না।

[৪] জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া নয়: পরিণমন জীবনের একটি বিশেষ পর্যায়ে শুরু হয় এবং একটি বিশেষ পর্যায়ে শেষ হয়।

[9] জৈবিক বিকাশের প্রক্রিয়া: পরিণমন ব্যক্তির দেহের জৈবিক কেন্দ্রগুলির স্বাভাবিক বিকাশের ওপর নির্ভর করে।

[10] সর্বজনীন প্রক্রিয়া: দেশ, কালভেদে পরিণমনের পরিবর্তন ঘটে না। বিশ্বের সব শিশুরাই প্রথমে হামাগুড়ি দেয়, পরে দাঁড়াতে শেখে, সবশেষে হাঁটতে শেখে।

মন্তব্য

ওপরের বৈশিষ্ট্যগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পরিণমন হল ব্যক্তির জীবনবিকাশের একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া যা তার আচরণের পরিবর্তন ঘটায়। এটি একটি স্বাধীন ও সর্বজনীন প্রক্রিয়া।

৪। প্রেষণার বৈশিষ্ট্য লেখো। প্রেষণার প্রকারভেদ আলোচনা করো।

প্রেষণার বৈশিষ্ট্য

প্রেষণার বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

[1] চাহিদা বা অভাববোধ: প্রেষণা বিশেষভাবে একটি ব্যক্তিগত চাহিদা থেকে শুরু হয়। কোনো সময় ব্যক্তি তার বিশেষ কোনো চাহিদাকে প্রত্যক্ষণ করলে বা তার মধ্যে কোনো অভাববোধ দেখা দিলে প্রেষণার উন্মেষ ঘটে।

[2] তাড়না: ব্যক্তির চাহিদা সরাসরি উদ্দেশ্যমুখী আচরণ সৃষ্টি করতে পারে না। ব্যক্তির অভাববোধ তার মধ্যে এক ধরনের মানসিক অবস্থা, অর্থাৎ তাড়নার সৃষ্টি করে। তাড়নাই পরবর্তী পর্যায়ে ব্যক্তিকে উদ্দেশ্যমুখী আচরণে উদ্বুদ্ধ করে। অর্থাৎ, প্রেষণার সৃষ্টি হয়।

[3] লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ: প্রেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ। প্রেষিত আচরণের পরিণতি হিসেবে ব্যক্তি লক্ষ্যবস্তু অর্জন করে। লক্ষ্যবস্তু প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে কর্মতৎপরতা হ্রাস পায়।

[4] প্রেষণার হ্রাস ও বৃদ্ধি: যে চাহিদা বা অভাববোধ থেকে প্রেষণাপ্রেষণার উন্মেষ ঘটে, সেই প্রেষণা পূর্ণ হওয়ার পর ব্যক্তির মধ্যে আর-একটি নতুন প্রেষণার উদ্ভব ঘটে।

[5] বাধ্যতামূলক ক্ষমতা: মনোবিদদের মতে, প্রেষণার একটি বাধ্যতামূলক ক্ষমতা থাকে। ওই ক্ষমতা মূলত ব্যক্তির চাহিদার প্রকৃতি এবং লক্ষ্যবস্তুর দ্বারা নির্ধারিত হয়।

[6 ] ব্যক্তি-আচরণের গতি নির্ণয়: প্রেষণা ব্যক্তি-আচরণের গতি নির্ণয় করে। অর্থাৎ প্রেষণা ব্যক্তির উদ্দেশ্যমুখী আচরণের পাশাপাশি তার কর্মতৎপরতাকে বাড়িয়ে তোলে বা কমিয়ে আনে।

[7] ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য রক্ষা: প্রেষণা ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষভাবে সাহায্য করে। দৈহিক চাহিদা, সামাজিক চাহিদা ও মানসিক চাহিদা পূরণ না হলে ব্যক্তিজীবনে যে ভারসাম্যের অভাব ঘটে, প্রেষণা তা দূর করতে সাহায্য করে।

প্রেষণার প্রকারভেদ

মনোবিজ্ঞানীরা প্রেষণাকে যে তিন ভাগে ভাগ করেছেন, তা হল-

[1] জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় প্রেষণা: ব্যক্তির জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় চাহিদাগুলি থেকে যে প্রেষণার সৃষ্টি হয়, তাকে জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় প্রেষণা বলে। ব্যক্তির জীবনধারণের জন্য এইসব প্রেষণার উন্মেষ ঘটে বলে এগুলিকে মুখ্য প্রেষণাও বলা হয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌন প্রেষণা, মাতৃত্ব ইত্যাদি হল জৈবিক প্রেষণার উদাহরণ। এগুলি সহজাত প্রেষণা। এগুলি শিক্ষালব্ধ নয়।

[2] ব্যক্তিগত প্রেষণা: ব্যক্তির মানসিক চাহিদা বা আত্মসচেতনতার সঙ্গে যুক্ত প্রেষণাগুলিকে ব্যক্তিগত প্রেষণা বলা হয়। ব্যক্তির আত্মসচেতনতামূলক চাহিদার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল আত্মশ্রদ্ধার চাহিদা। মনোবিজ্ঞানী ম্যাসলো (Maslow)-র মতে, এই চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির মধ্যে আত্মশ্রদ্ধার প্রেষণার উন্মেষ ঘটে। এই প্রেষণা ব্যক্তিকে তার আত্মমর্যাদা রক্ষার অনুকূল আচরণ সম্পাদন করায় উদ্বুদ্ধ করে। আত্মশ্রদ্ধার প্রেষণা ধীরে ধীরে সীমিত বস্তু থেকে বৃহত্তর লক্ষ্যের অভিমুখী হয়।

[3] সামাজিক প্রেষণা: মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। তার মধ্যে নিরাপত্তা, ভালোবাসা, খ্যাতির স্পৃহা প্রভৃতি সামাজিক চাহিদাগুলি থাকে। সে ওই চাহিদাগুলির পরিতৃপ্তির মাধ্যমে সুস্থ সামাজিক জীবন যাপন করতে চায়। ওইসব সামাজিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রেষণা জাগ্রত হয়, তাকে সামাজিক প্রেষণা বলে। সামাজিক প্রেষণা ব্যক্তির সামাজিক বিকাশে সহায়তা করে।

মন্তব্য

আলোচনার সুবিধার জন্য প্রেষণাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হলেও, এই তিন ধরনের প্রেষণা একেবারে পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। বরং এই প্রেষণাগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।

৫। প্রেষণার প্রভাবক বা নির্ধারক বলতে কী বোঝ? প্রেষণার উল্লেখযোগ্য প্রভাবক বা শর্তগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

প্রেষণার প্রভাবক বা নির্ধারক

মনোবিদদের মতে, কতকগুলি প্রভাবক বা শর্ত ব্যক্তির প্রেষণার গতি নির্ধারণ করে। ওই শর্ত বা প্রভাবকগুলিকে প্রেষণার নির্ধারক বলা হয়।

প্রেষণার উল্লেখযোগ্য প্রভাবক বা শর্তসমূহ

প্রেষণার উল্লেখযোগ্য প্রভাবক বা শর্তগুলি হল-অনুরাগ, কৌতূহল, উদ্বেগ, মূল্যবোধ, নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, অর্জিত অসহায়তা, দক্ষতা সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস, সাফল্য, উদ্দীপনা, জীবনাদর্শ, অভ্যাস, পরিবেশ ইত্যাদি। নীচে এগুলির সম্পর্কে আলোচনা করা হল-

[1] অনুরাগ: প্রেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক বা নির্ধারক হল ব্যক্তির অনুরাগ। কোনোরকম চাহিদাপূরণের জন্য চাহিদা তৃপ্তিকারক বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে যেটির প্রতি ব্যক্তির অনুরাগ বা আগ্রহ আছে, সেটি সে নির্বাচন করে।

[2] কৌতূহল: মনোবিদ ম্যাকডুগাল-এর মতে, যে বিষয়ে কোনো ব্যক্তির কৌতূহল সৃষ্টি হয়, সেই বিষয়ে কৌতূহল নিবৃত্ত না হওয়া পর্যন্ত সে অস্বস্তি বোধ করে। সুতরাং বলা যায়, কৌতূহল হল ব্যক্তির প্রেষণার অন্যতম প্রভাবক।

[3] উদ্বেগ: ব্যক্তির কোনো একটি বিষয়ে উদ্বেগ প্রেষণার প্রভাবক রূপে কাজ করে। এর ফলে কোনো কাজ সহজ বা কঠিনের মাঝামাঝি হলে, প্রেষণা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়।

[4] মূল্যবোধ: কোনো সমাজে বসবাসকারী কোনো ব্যক্তির মনে ওই সমাজে প্রচলিত ধ্যানধারণা অনুযায়ী ভালোমন্দ, সত্য-মিথ্যা, সৎ-অসৎ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে যে বোধ বা ধারণার সৃষ্টি হয়, তাকেই ওই ব্যক্তির মূল্যবোধ আখ্যা দেওয়া হয়। ব্যক্তিজীবনে মূল্যবোধ প্রেষণাক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক।

[5] নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র: ব্যক্তির প্রেষণা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মনোবিদ রোটার (Rotter) দুই ধরনের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কথা উল্লেখ করেছেন। বাহানিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র এবং অন্তর্নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। কোনো শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফল খারাপ হলে যদি প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়াকে দায়ী করা হয়, তবে সেটি বাহানিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। আর যদি শিক্ষার্থী মনে করে সে ভালো প্রস্তুতি নিতে পারেনি বলেই এই ফল, তবে সেটি অন্তর্নিয়ন্ত্রক।

[6] অর্জিত অসহায়তা: কোনো ব্যক্তি কোনো কাজে বারে বারে অসফল হলে সেই কাজে প্রেষণা জাগে না। অসফলতার মধ্য দিয়ে ওই ব্যক্তির মধ্যে অসহায়তার সৃষ্টি হয়।

[7] দক্ষতা সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস: যেসব ব্যক্তির মধ্যে নিজের প্রতি বিশ্বাস রয়েছে, তারা সহজেই যে-কোনো কাজে প্রেষণা পায়। অন্যদিকে, যারা নিজের প্রতি বিশ্বাস গড়ে তুলতে পারে না, তাদের কোনো কাজেই প্রেষণা জাগে না। তাই দক্ষতা সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাসকে প্রেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক বলা হয়।

[৪] সাফল্য: ব্যক্তি কোনো কাজে সাফল্য লাভ করলে, সেই কাজের জন্য তার মধ্যে প্রেষণার সঞ্চার ঘটে। অর্থাৎ, সাফল্য প্রত্যক্ষভাবে কোনো ব্যক্তির প্রেষণা প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

[9] উদ্দীপনা: নানাপ্রকার বস্তু বা ঘটনা প্রেষণাকে কার্যকরী করে তোলে। উপযুক্ত লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ ও লক্ষ্যবস্তুর প্রকৃতি ব্যক্তির মধ্যে প্রেষণার উন্মেষ ঘটায়।

[10] জীবনাদর্শ: ব্যক্তির জীবনাদর্শ প্রেষণার নির্ধারক হিসেবে কাজ করে। সঠিক জীবনাদর্শ গড়ে উঠলে ব্যক্তি সেই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর চেষ্টা করে। ফলে তার যে-কোনো আচরণ ওই লক্ষ্যমুখী হয়।

[11] অভ্যাস: প্রত্যেক ব্যক্তিরই এমন কিছু অভ্যাস থাকে যা তার মধ্যে কোনো বিশেষ কাজ করার জন্য প্রেষণা জাগায়। চাহিদাপূরণ হলে, অভ্যাসগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে যান্ত্রিক নিয়মে কাজ করে। প্রেষণা সৃষ্টিতে সহায়ক হয় না।

[12] পরিবেশ: ব্যক্তির পরিবেশ প্রেষণা সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাস্তবে দেখা গেছে, ব্যক্তির পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ উপযুক্ত না হলে, সে কোনো কাজে সঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে পারে না। ফলে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই তার মধ্যে প্রেষণার উন্মেষ ঘটে না।

৬। স্মৃতি বা স্মরণক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করো।

স্মৃতি বা স্মরণক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ

মনোবিদগণ স্মৃতি বা স্মরণক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিভাগ করেছেন-

[1] শিখন কৌশল অনুযায়ী

[i] যান্ত্রিক বা অভ্যাসগত স্মৃতি: কোনো বিষয়বস্তু না বুঝে, বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে যখন শিখন সম্পন্ন হয় এবং সেই শিখনীয় অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে স্মরণ করা হয়, তাকে বলে যান্ত্রিক স্মৃতি (Rote memory) বা অভ্যাসগত স্মৃতি (Habit memory)।

[ii ] যৌক্তিক বা প্রকৃত স্মৃতি: কোনো বিষয়বস্তুর হৃদয়ঙ্গমের পর ব্যক্তি যখন মনঃকল্পের (mental image) দ্বারা বস্তুকে স্মরণ করে, তখন ওইরূপ স্মৃতিকে যৌক্তিক স্মৃতি (Logical memory) বা প্রকৃত স্মৃতি (True memory) বলে।

[2] স্থায়িত্বকাল অনুযায়ী

[i] তাৎক্ষণিক স্মৃতি: কোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে শিক্ষালাভ করার পরেই তার পুনরুদ্রেককে তাৎক্ষণিক স্মৃতি (Immediate memory) বলে।

[ii] দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি: কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন করার দীর্ঘ সময় পরে সেটিকে স্মরণ করাকে স্থায়ী স্মৃতি বলা হয়।

[iii] স্বল্পস্থায়ী স্মৃতি: এই ধরনের স্মৃতিও সাময়িক, তবে তাৎক্ষণিক স্মৃতির তুলনায় কিছুটা বেশি সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। স্বল্পস্থায়ী স্মৃতির পরিসর প্রায় 30 সেকেন্ড। অনুশীলনের মাধ্যমে স্বল্পস্থায়ী স্মৃতি (Short-term memory) অনেকদিন স্থায়ী হতে পারে।

[3] অভিজ্ঞতার মাধ্যম অনুযায়ী

[i] ব্যক্তিগত স্মৃতি: কোনো বিষয়ে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং স্মরণ করে, তাকে ব্যক্তিগত স্মৃতি (Personal memory) বলে।

[ii] নৈর্ব্যক্তিক স্মৃতি: ব্যক্তির জীবনে বেশিরভাগ অভিজ্ঞতা আসে অন্যের কাছ থেকে বা বই পড়ে। এইসব অভিজ্ঞতার স্মরণকে নৈর্ব্যক্তিক স্মৃতি (Impersonal memory) বলা হয়।

[4] ইন্দ্রিয় অনুযায়ী

[i] দর্শনগত স্মৃতি: এইপ্রকার স্মৃতি বা পুনরুদ্রেক দর্শনগত প্রত্যক্ষণের প্রভাবে ঘটে থাকে। বহু শিক্ষার্থীর দর্শনগত স্মৃতি প্রখর। তারা যাতে দর্শন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, তার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।

[ii] শ্রবণগত স্মৃতি: এই ধরনের স্মৃতি বা পুনরুদ্রেক শ্রবণগত প্রত্যক্ষণের প্রভাবে ঘটে থাকে। যেসব শিক্ষার্থীর শ্রবণগত স্মৃতি প্রখর, তারা যাতে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

[iii] ঘ্রাণজাত স্মৃতি: এই ধরনের স্মৃতি বা পুনরুদ্রেক ঘ্রাণজাত প্রত্যক্ষণের প্রভাবে ঘটে থাকে।

[iv] স্পর্শজাত স্মৃতি: এইপ্রকার স্মৃতি বা পুনরুদ্রেক স্পর্শগত প্রত্যক্ষণের প্রভাবে ঘটে।

[v] স্বাদমূলক স্মৃতি: এইজাতীয় স্মৃতি বা পুনরুদ্রেক স্বাদমূলক প্রত্যক্ষণের প্রভাবে ঘটে থাকে।

[5] মানসিক ইচ্ছা অনুযায়ী

[i] সক্রিয় স্মৃতি: কোনো অভিজ্ঞতাকে মনে রাখার জন্য ব্যক্তি যখন নিজেদের মানসিক ইচ্ছা বিশেষভাবে প্রয়োগ করে, তখন তাকে সক্রিয় স্মৃতি (Active memory) বলা হয়। যেমন-কোনো ব্যক্তির পূর্ব ঘটনাকে স্বেচ্ছায় স্মরণ করার বিষয়টি এই স্মৃতির উদাহরণ।

[ii] নিষ্ক্রিয় স্মৃতি: কোনো অভিজ্ঞতাকে পুনরুদ্রেক করার জন্য যখন ব্যক্তির সক্রিয় মানসিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না, তখন তাকে নিষ্ক্রিয় স্মৃতি (Passive memory) বলে। যেমন-কোনো অতীত ঘটনাকে স্মরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিষ্ক্রিয়তা বা মনে করার চেষ্টা না করার বিষয়টি এইরূপ স্মৃতির উদাহরণ।

[6] সংগঠন অনুযায়ী

[i] ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি: এইপ্রকার স্মৃতিতে অভিজ্ঞতা দ্রুত প্রবেশ করতে পারে। এই স্মৃতিতে অভিজ্ঞতা সেনসরি রেজিস্টার অথবা স্থায়ী স্মৃতি থেকে আসতে পারে। এই স্মৃতিতে অভিজ্ঞতা খুবই অল্প সময়ের জন্য থাকতে পারে।

[ii] স্থায়ী স্মৃতি: স্থায়ী স্মৃতিতে অভিজ্ঞতাগুলি ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। এই স্মৃতির অভিজ্ঞতা ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি থেকেই আসে, যা দীর্ঘদিন সংরক্ষিত হয়।

৭। কল্পনার বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

কল্পনার বৈশিষ্ট্যাবলি

কল্পনা মানুষের মানসিক কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা এবং আবিষ্কারের ভিত্তি গঠন করে। এটি আমাদের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও বাস্তবতা থেকে পৃথক হলেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। কল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ-

[1] মানসিক চিত্র গঠনের ক্ষমতা: কল্পনার মাধ্যমে ব্যক্তি এমন বস্তুর ছবি বা ধারণা মনের মধ্যে তৈরি করতে পারে, যা বাস্তবে উপস্থিত নেই। এটি মস্তিষ্কের সংরক্ষিত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নতুন দৃশ্যপট সৃষ্টি করে।

[2] সৃজনশীলতা ও নতুনত্ব: কল্পনা নতুন ধাবণা, চিন্তা ও সৃজনশীলতার প্রধান উৎস। সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সংগীত-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

[3] বাস্তব ও অবাস্তবের সংমিশ্রণ: কল্পনার মধ্যে বাস্তব উপাদান বিদ্যমান থাকলেও এটি প্রায়শই বাস্তবের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে নতুন ও অবাস্তব জগতের সৃষ্টি করতে পারে, যেমন-কল্পবিজ্ঞান, রূপকথা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

[4] ইচ্ছাপূরণের একটি উপায়: ফ্রয়েডের মতে, কল্পনা মানুষের অবচেতন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। মানুষ কল্পনার মাধ্যমে তার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলির বাস্তব রূপ দিতে চায়, যা স্বপ্ন বা দিবাস্বপ্নের রূপ নিতে পারে।

[5] অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন: কল্পনার মাধ্যমে মানুষ অতীত অভিজ্ঞতাকে পুনর্গঠন করে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য নতুন চিন্তা ও কৌশল তৈরি করতে পারে। এটি শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

[6] ভবিষ্যৎ ভাবনার ক্ষমতা: কল্পনার মাধ্যমে মানুষ ভবিষ্যতের ঘটনা বা সম্ভাবনাগুলি কল্পনা করতে পারে। এটি পরিকল্পনা, কৌশল নির্ধারণ এবং নতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।

[7] আবেগ ও অনুভূতির সাথে সংযুক্ত: কল্পনা শুধু চিন্তার সাথে সম্পর্কিত নয়, এটি আবেগ ও অনুভূতিরও বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এটি কখনও আনন্দদায়ক হতে পারে, আবার কখনও উদ্বেগ বা আশঙ্কার কারণও হতে পারে।

[৪] সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি: কল্পনা ব্যক্তিকে বিকল্প সমাধান খুঁজে বের করতে সহায়তা করে। এটি সমস্যা সমাধান, গবেষণা এবং আবিষ্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

[9] ব্যক্তি ও পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত: কল্পনার বিকাশ ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন এবং এটি শিক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা এবং পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

মন্তব্য

কল্পনা মানুষের চিন্তাশক্তির অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য, যা ব্যক্তি ও সমাজের বিকাশে অপরিহার্য। এটি সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ভিত্তি গঠন করে, যা মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৮। মনোযোগের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

মনোযোগের বৈশিষ্ট্য

মনোযোগের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

[1] কেন্দ্রানুগ: টিচেনারের মতে চেতনার দুটি স্তর আছে-[i] কেন্দ্রীয় চেতনার স্তর ও [ii] প্রান্তীয় চেতনার স্তর। বস্তু যখন কেন্দ্রীয় চেতনার স্তরে অবস্থান করে তখন বস্তু সম্পর্কে আমরা সচেতন হই অর্থাৎ মনোযোগী হই।

[2] নির্বাচনধর্মী: উডওয়ার্থ প্রমুখ আচরণবাদী মনোযোগের নির্বাচনধর্মী বৈশিষ্ট্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। মনোযোগে একাধিক বিষয় বা বস্তুর মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নেওয়া হয়।

[3] পরিসরযুক্ত: মুহূর্তমাত্র দেখে বা শুনে ব্যক্তি যতগুলি বস্তুর প্রতি মনোযোগ দেয়, তাকে মনোযোগের পরিসর বলে।

[4] সঞ্চারণশীল: একটি নির্দিষ্ট বস্তুর প্রতি ইচ্ছা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক নিয়মে বেশিক্ষণ মনোযোগ দেওয়া যায় না, মনোযোগ পার্শ্ববর্তী অন্য বস্তুতে চলে যায়। একে মনোযোগের সঞ্চারণশীলতা (oscillation of attention) বলে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, গড়ে দুই সেকেন্ড অন্তর এটি ঘটে। ট্যাচিসটোস্কোপ (Tachistoscope) যন্ত্রের সাহায্যে এটি পরিমাপ করা যায়।

[5] চঞ্চল: কোনো বস্তুর প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়ার সময় দেখা যায়, কিছু সময় অন্তর মনোযোগ অন্যত্র চলে যায়, আবার তা ফিরে আসে। মনোযোগের এই বৈশিষ্ট্যকে মনোযোগের চঞ্চলতা বলে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, মনোযোগের এই চঞ্চলতা 8-12 সেকেন্ড অন্তর ঘটে।

[6] দৈহিক পরিবর্তনভিত্তিক: মনোযোগের সময় দৈহিক পরিবর্তন ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অঙ্গ- সঞ্চালনমূলক, ইন্দ্রিয়ঘটিত এবং স্নায়ুঘটিত পরিবর্তন।

[7] সীমাবদ্ধ ও একমুখী: এক সময়ে একটি বস্তু বা বিষয়ের ওপর মনোযোগ দেওয়া যায়। একই সময়ে একাধিক বস্তু বা বিষয়ের ওপর মনোযোগ দেওয়া যায় না।

[৪] শর্তনির্ভর: মনোযোগের শর্তগুলিকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়-[i] বস্তুগত শর্ত ও [ii] ব্যক্তিগত শর্ত। বস্তুগত শর্তগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল উদ্দীপকের তীব্রতা, নতুনত্ব, আকার, পরিবর্তনশীলতা ইত্যাদি। ব্যক্তিগত শর্তগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আগ্রহ, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।

[9] নতুনত্বসন্ধানী: মনোযোগ হল অনুসন্ধানী। মনোযোগ সব সময় বিভিন্ন বিষয়বস্তুর মধ্যে বৈচিত্র্য বা নতুনত্ব খুঁজে বেড়ায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিশুরা নতুন খেলনার প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়।

[10] সম্বন্ধস্থাপনে সহায়ক: মনোযোগ বিভিন্ন বিষয়বস্তুর মধ্যে একটি সম্বন্ধ স্থাপন করতে সহায়তা করে।

[11] প্রচেষ্টামূলক ক্রিয়া: মনোযোগের মধ্যে একটি প্রচেষ্টামূলক ক্রিয়া রয়েছে। ম্যাকডুগালের মতে, জানার প্রচেষ্টাই হল মনোযোগ।

[12] উপযোজননির্ভর: মনোযোগের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়বস্তুর বিশেষ উপযোজন প্রয়োজন।

[13] মনোযোগ ও আগ্রহ: ম্যাকডুগালের মতে, মনোযোগ হল সক্রিয় আগ্রহ আর আগ্রহ হল সুপ্ত মনোযোগ।

৯। আগ্রহের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করো।

আগ্রহের বৈশিষ্ট্য

আগ্রহের ধারণাটি স্পষ্ট করতে এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা হল-

[১] বংশগত ও অর্জিত: আগ্রহ সম্পূর্ণভাবে অর্জিত নয়, কারণ আগ্রহে বংশধারার কিছু প্রভাব দেখা যায়।

[2] স্থায়ী: আগ্রহ ব্যক্তিত্বের একটি স্থায়ী মানসিক সংগঠন বা প্রলক্ষণ। বুদ্ধি ছাড়া অন্যান্য সব অভীক্ষার স্কোরের চেয়ে আগ্রহের স্কোরের স্থায়িত্ব বেশি।

[3] বিকাশশীল: একটা সাধারণ দিক ঠিক রেখে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহের বিকাশ ঘটে থাকে।

[4] সামাজিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত: সামাজিক পরিবেশ, বিশেষত সামাজিক আশা-প্রত্যাশা এবং অবস্থান আগ্রহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

[5] চাহিদার পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল: ব্যক্তি ও সমাজের চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে আগ্রহের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। সাধারণত 25 বছরের পর আগ্রহের পরিবর্তন আর দেখা যায় না। পরিবর্তন বেশি হয় 15 থেকে 20 বছরের মধ্যে।

[6] ব্যক্তিভেদে পৃথক: এইরূপ সমান পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ব্যক্তিভেদে আগ্রহের ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

[7] সাফল্যের অভিজ্ঞতানির্ভর: সাফল্যের অভিজ্ঞতা আগ্রহ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

[৪] পরিমাপযোগ্য: আগ্রহ পরিমাপযোগ্য। আগ্রহ পরিমাপের জন্য বর্তমানে একাধিক অভীক্ষা ব্যবহৃত হয়।

[9] তৃপ্তিদায়ক: ব্যক্তি তার আগ্রহ অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ পেলে তার মধ্যে তৃপ্তি দেখা যায়।

[10] আগ্রহনির্ভর: আগ্রহ মনোযোগের প্রাথমিক শর্ত। আগ্রহ বা অনুরাগ না জন্মালে কোনো কাজে মন দেওয়া যায় না।

[11] চাহিদানির্ভর: আগ্রহ সৃষ্টির মূল কারণ হল চাহিদা। শিক্ষার্থী বা ব্যক্তি যখন কোনো বিষয়ে চাহিদা বোধ করে, তখনই তার মধ্যে ওই বিষয়টির প্রতি অনুরাগ বা আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

[12] অনুভূতিনির্ভর: বহু ক্ষেত্রে ব্যক্তি এমন বিষয়ের প্রতি অনুরাগ বা আগ্রহ দেখায়, যার প্রতি তার সেন্টিমেন্ট যুক্ত থাকে।

[13] সামাজিক পরিবেশনির্ভর: সামাজিক পরিবেশ ও সংস্কৃতি ব্যক্তির আগ্রহ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কারণে পাশ্চাত্য দেশের ব্যক্তিদের আগ্রহের সঙ্গে প্রাচ্য দেশীয় ব্যক্তিদের আগ্রহের পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

[14] সক্রিয়তা: কোনো ব্যক্তির মধ্যে অনুরাগ সৃষ্টি করতে হলে, ব্যক্তির সক্রিয়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

[15] সুযোগসুবিধা দান: অনেক সময় কোনো বিশেষ বিষয়ে ব্যক্তিকে সুযোগসুবিধা দিলে ব্যক্তির মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

[16] আগ্রহ হল সুপ্ত মনোযোগ: ম্যাকডুগালের মতে, আগ্রহ হল সুপ্ত মনোযোগ এবং মনোযোগ হল সক্রিয় আগ্রহ।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment