জাতিগঠন ও সম্পর্কিত দিকসমূহ (সপ্তম অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার ইতিহাস

সূচিপত্র

জাতিগঠন ও সম্পর্কিত দিকসমূহ (সপ্তম অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার ইতিহাস | HS 4th Semester History Long Question answer 7th Chapter

জাতিগঠন ও সম্পর্কিত দিকসমূহ (সপ্তম অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর
জাতিগঠন ও সম্পর্কিত দিকসমূহ (সপ্তম অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর

১। পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র চেতনা ক্রমবিকাশের কারণ কী ছিল?
অথবা, পূর্ব পাকিস্তানের উপজাতীয়তাবাদী তৎপরতা বৃদ্ধির কারণ আলোচনা করো।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুটি প্রধান অংশ পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান ছিল ভারত রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দ্বারা সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন। এই দুই অঞ্চলের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতিগত ঐক্য ছিল না। নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের লক্ষ্য হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি আধা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত করা।

পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র চেতনা ক্রমবিকাশের কারণ/উপজাতীয়তাবাদী তৎপরতা বৃদ্ধির কারণ:

রুশ রাষ্ট্রনেতা জোসেফ স্ট্যালিন বলেছেন, ‘বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি স্থায়ী জনসমাজ যখন ভাষা, ভূখণ্ড, অর্থনৈতিক জীবন ও মানসিক গঠনপ্রণালীর ঐক্যের মাধ্যমে একই সাংস্কৃতিক সাধারণীকরণ ভোগ করে, তখন গড়ে ওঠে জাতি।’ এই বিচারে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ এক জাতি ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র চেতনার ক্রমবিকাশ এবং উপজাতীয়তাবাদী তৎপরতা বৃদ্ধির কারণগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-

(i) ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য: দেশভাগের পরবর্তীকালে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। তাদের মাতৃভাষা বাংলা। এই মানুষগুলির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, বাংলা ভাষা স্বাধীন পাকিস্তানে প্রথম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাবে। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের মূল ভাষা ছিল উর্দু। রাজনৈতিকভাবে কর্তৃত্ববাদী পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা সংখ্যালঘিষ্ঠের উর্দু ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজন বাংলা ভাষার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের এই অবজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি।

(ii) সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য : সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ব্যাপক স্বাতন্ত্র্য ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে আরবীয় সংস্কৃতির প্রাধান্য থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রাধান্য ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের উপর সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ধর্মীয় জাতিচেতনাকে দুর্বল করে দেয়। এই সময় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান সমাজে স্বতন্ত্র চেতনার বিকাশ ঘটে।

(iii) অর্থনৈতিক বৈষম্য: পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হন। পাকিস্তানের মোট জাতীয় আয়ের প্রায় সবটাই পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল। অপরদিকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ছিল মূলত কৃষিপ্রধান অঞ্চল। গোটা পাকিস্তানের শস্যভান্ডার ছিল এই পূর্বাঞ্চল। খাদ্যশস্যের পাশাপাশি অর্থকরী ফসল এবং নদনদী ও খাল-বিলের অস্তিত্বের কারণে মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের উদ্‌বৃত্ত খাদ্যসম্পদ বাধ্যতামূলকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হত। পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা থাকলেও, পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প-অর্থনীতি বিকাশের বিষয়ে পশ্চিমি নেতারা নিস্পৃহ মনোভাব পোষণ করেন। এহেন বিমাতৃসুলভ অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের হতাশ করে।

(iv) প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বৈষম্য: পশ্চিমের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে অধিক জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও সবরকম রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানের করায়ত ছিল। এমনকি, প্রশাসনিক সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রেও সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ছিল বৈষম্যের শিকার। সারাদেশে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ সরকারি পদগুলি অ-বাংলাভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষদের কৃক্ষিগত। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানেও গরুত্বপূর্ণ সরকারি পদগুলিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদেরই একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। এই ব্যবস্থা সুপ্রশাসনের উপযোগী ছিল না। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী নাগরিকরা বিক্ষুব্ধ হন।

পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী নেতৃবর্গ পূর্ব পাকিস্তানের উপর সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সর্বোপরি ভাষাগত ক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনমনীয় প্রয়াস চালান। মূলত এই কারণগুলিই পূর্ব পাকিস্তানের জনমানসে স্বতন্ত্র চেতনার ক্রমবিকাশ এবং উপজাতীয়তাবাদী তৎপরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

২। টীকা লেখোঃ- ভাষা আন্দোলন।

ভাষা আন্দোলন: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান গঠনের পর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়। এই আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি:

পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে একটি আধা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস ভাষা আন্দোলনের পটভূমি গড়ে দিয়েছিল।

(i) বাংলা ভাষার গুরুত্ব হ্রাস: নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল পশ্চিম * পাকিস্তানের উর্দুভাষী নেতাদের হাতে। তাঁরা রাষ্ট্রের দলিল-দস্তাবেজ, পোস্টকার্ড, ডাকটিকিট সহ বিভিন্ন নথিপত্রে সচেতনভাবে বাংলা ভাষা বর্জন করে উর্দু ও ইংরেজি ভাষার প্রচলন করেন। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।

(ii) উর্দু ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার পরিকল্পনা: এ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস নাগাদ করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা এ হিসেবে গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। মহম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানে এসে স্পষ্ট ভাষায় জানান যে, ‘উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে, অন্য কোনও ভাষা নয়।’

(iii) অন্যান্য কারণ: এই সকল ঘটনাবলির পাশাপাশি দল বাঙালিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ ও পঙ্গু করে রাখা এবং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার ষড়যন্ত্র বাঙালি যুবসমাজকে আন্দোলনমুখী করে তোলে।

ভাষা আন্দোলনের প্রসার: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কালপর্ব ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই আন্দোলন সুনির্দিষ্ট ও শক্তিশালী রূপ ধারণ করে।

(i) আন্দোলনের প্রাথমিক পর্ব: ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব জানালে, তা বাতিল হয়ে যায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস স্বরূপ স্কুলকলেজের ছাত্র, রেলকর্মী ও বহু সরকারি কর্মচারী ধর্মঘটে যোগদান করেন। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র মুজিবুর রহমান এবং শামসুল হক, কাজি গোলাম মাহবুব-সহ বহু নেতা গ্রেফতার হয়েছিলেন।

(ii) আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব: ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভাষা আন্দোলন তীব্ররূপ ধারণ করে। এরপর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে মত প্রকাশ করলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করেন। ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই দিনটিকে সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটি রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে ঘোষণা করে।

সরকারি দমননীতি: ভাষা আন্দোলনের গতি বুদ্ধ করার জন্য সরকার দমননীতি গ্রহণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী একমাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে এগিয়ে এলে সংঘবদ্ধ ছাত্রদের উপর পুলিশ গুলি চালায়। এর ফলে আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক-সহ বহু মানুষ শহীদ হন। পুলিশের এই নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্রদের ভাষা আন্দোলন কার্যত গণ আন্দোলনে পরিণত হয়।

সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে বিশিষ্টদের প্রতিক্রিয়া:

ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করার অপরাধে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি, আবদুল হাসেম, খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ, অধ্যাপক মুনির চৌধুরী-সহ অনেককে সরকার গ্রেফতার করে।
আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশনেও এই বিষয়ে বিতর্ক হয়। পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল কালাম শামসউদ্দিন আইন পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের সব জায়গায় সরকারি দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। সাংবাদিক আবদুল গফ্ফর চৌধুরী লেখেন, “আমার ভাই-এর রক্তে রাঙানো ২১ ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলতে পারি?”

আন্দোলনের পরিণতি: ব্যাপক পুলিশি দমনপীড়নের পরও সরকারের পক্ষে আন্দোলন স্তব্ধ করা সম্ভব হয়নি। শেষপর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের আত্মবলিদান পৃথিবীতে বিরল। তাই ইউনেস্কো (UNESCO) ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day) হিসেবে সম্মান প্রদান করেছে।

৩। ভাষা আন্দোলনে মুজিবুর রহমানের অবদান অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। তিনি ৭ বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করলেও শেষপর্যন্ত গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। তারপর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান নাম-মৌলানা আজাদ কলেজ) ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে শিক্ষালাভের জন্য ভরতি হন। আইন নিয়ে পড়াশোনার সময় তিনি ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। এই আন্দোলনে মুজিবের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভাষা আন্দোলনে মুজিবুর রহমানের অবদান

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান গঠনের পর তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ একটি অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন মুজিবুর রহমান।

(i) ছাত্রনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা: ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। আর এরপরেই পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা হন তিনি।

(ii) ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ: ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উর্দু ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদাদানের প্রস্তাব পাকিস্তানের গণপরিষদে খারিজ হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ তারিখে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস পালনের আহ্বান জানায়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সচিবালয়ে প্রথম গেটের সম্মুখে যে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছিল তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

(iii) মুজিবুর রহমানের কারাবরণ: ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবসের দিন মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। মোনায়েম সরকার সম্পাদিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয় যে, স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই ছিল মুজিবুর রহমানের প্রথম গ্রেফতার। এরপর ১৫ মার্চ তিনি মুক্তি পান। কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তিনি একাধিকবার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তিনি নিয়মিত আন্দোলনের খোঁজখবর নিতেন এবং আন্দোলনকারীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। এমনকি কারাবন্দি অবস্থায় তিনি ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে মোট ১৩ দিন অনশনও করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, সাহস এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ভাষা আন্দোলনকে শক্তিদান করেছিল। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি গড়ে তোলেন।

৪। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন কীভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিল?
অথবা, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন কীভাবে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল?
অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ)-এর উপর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের কী প্রভাব পড়েছিল?
অথবা, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক আলোচনা করো।

বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন:

পাকিস্তান গঠনের পর নতুন এই রাষ্ট্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপরীত্য প্রকট হয়ে ওঠে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল ভাষাগত বৈপরীত্য। এই প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়।

রাষ্ট্রভাষা উর্দু: পাকিস্তানের পূর্ব অংশে অধিকাংশ মানুষের কথ্যভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু তা সত্ত্বেও উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব পেশ করে পাকিস্তান। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন।

প্রতিক্রিয়া: এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানায়। ঢাকার সলিমউল্লাহ মুসলিম হল-এ ছাত্ররা এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়ে পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটও পালিত হয়। ছাত্ররা ১০ জন করে ছোটো ছোটো মিছিল করেন। পুলিশ মিছিলের উপর প্রথমে লাঠিচার্জ ও পরে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে বরকত, সালাম, জব্বার, রফিক-সহ অনেকে শহিদ হন।

দমনপীড়ন ও পরিণতি: ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করার অপরাধে সরকার মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি, আবদুল হাসেম, খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ, অধ্যাপক মুনির চৌধুরি-সহ অনেককে গ্রেফতার করে। পূর্ব পাকিস্তানের সব জায়গায় সরকারি দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের নির্মম অত্যাচার পূর্ব পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই আন্দোলনকে প্রসারিত করেছিল। এর ফলে পাকিস্তান সরকার শেষপর্যন্ত উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে/বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব:

(i) আওয়ামী লীগ গঠন: ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মুসলমানদের নিয়ে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি দল গঠন করেন। এই দলই পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে।

(ii) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধ হয়েছিল। আইয়ুব খান ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পদত্যাগ করলে নতুন সামরিক শাসক হন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানে নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি হয়।

(iii) নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংকট: ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল গণসমর্থন লাভ করে এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরালো হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (PPP)-র নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি ছিলেন না। এরূপ পরিস্থিতিতে নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখলে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ধর্মঘট আহ্বান করেন। পরবর্তী ঘটনা পরম্পরায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, যা গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করে।

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতালাভ: ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে মুক্তি সংগ্রামের ডাক দেন। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক সহায়তায় প্রায় আট মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। শেষপর্যন্ত ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে।

এইভাবে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ভাষা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে যে প্রতিবাদের সূচনা হয়েছিল, তা প্রায় দুই দশকের পথ পাড়ি দিয়ে বহু রক্তপাতের বিনিময়ে তার লক্ষ্যপূরণ করে। এক্ষেত্রে ভাষা দিবসের প্রেরণা ও ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

৫। টীকা লেখো: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা:

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করেন। এই দাবি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণসমর্থন পায়। এমতাবস্থায় পাক সরকার মুজিবের জনপ্রিয়তা হ্রাস করার লক্ষ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে।

পাক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি / অভিমত:

পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ধারণা করেছিল যে, সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সংখ্যক বাঙালি অফিসার অতি গোপনে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার বিষয়ে স্বচেষ্ট হচ্ছে। ফলে কেবল সন্দেহের বশে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বাহিনী ৩৫ জন মানুষকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সহায়তায় এক সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

পাক সরকারের কর্মসূচি: ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে নিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৯৬৮. খ্রিস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি মাঝরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুজিব-সহ অন্য বন্দিদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। এরপর ১৯ জুন তারিখে ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারকার্য শুরু হয়। এই মামলাকে শেখ মুজিব তাঁর বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন।

জনগণের প্রতিক্রিয়া: সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি সরকারি চক্রান্তের বিরুদ্ধে এবং শেখ মুজিব-সহ সকল বন্দিদের মুক্তির দাবিতে মামলা প্রত্যাহারের জন্য গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন। সরকার সামরিক আইন জারি করে গণবিক্ষোভ ধ্বংস করতে চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙালি উপজাতীয় চেতনায় জাগ্রত পূর্ব পাকিস্তানের জনতা সামরিক আইন অমান্য করে সভা-সমাবেশ ও প্রতিবাদ চালাতে থাকেন। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের দমননীতির বিরুদ্ধে ক্রমে সেখানেও জনমত সোচ্চার হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একাংশ কেন্দ্রীয় সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ ও দমননীতির বিরূপ সমালোচনা শুরু করেন।

পরিণতি: শেখ মুজিবের আইনজীবী ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য টমাস উইলিয়ম (Thomas Williams)-এর বিচক্ষণতা এবং প্রবল গণ আন্দোলনের চাপে সরকার মুজিবের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। মুজিবুর রহমান-সহ সকল বন্দিদের নিঃশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাক সরকার।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিলাভের পরেই ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে মুজিবুর রহমানকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানেই এগারো দফা আন্দোলনের নেতা তোফায়েল আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীকালে মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারা বিকশিত হয়।

৬। স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ও শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা আলোচনা করো।
অথবা, মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু বলার কারণ আলোচনা করো।
অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান কী ছিল?

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। এই সংগ্রামের পিছনে ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বঞ্চনা, সাংস্কৃতিক শোষণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য।

স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ও শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা:

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাক-বিরোধী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিকে জাগরিত করার মূল কান্ডারী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি আজও অন্যতম উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব।

আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কার্যকলাপ: পাকিস্তান সরকার ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে মুজিবুর রহমান সক্রিয়ভাবে আন্দোলন শুরু করেন। দুই পাকিস্তানের মধ্যে এইরূপ বৈষম্যের প্রতিকার ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন লাভের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন (ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ খ্রি.)। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত দলই এই দাবিপত্রের নিন্দা করে। পাকিস্তান সরকার এই দাবিপত্রকে রাষ্ট্রীয় শত্রুদের দ্বারা রচিত বলে ঘোষণা করে মুজিবুর রহমান-সহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে (১৯৬৮ খ্রি.), যা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচন: ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ৩১৩ টি আসনের মধ্যে ২৯৮ টি আসন পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের দাবিদার হয়। কিন্তু জুলফিকার আলি ভুট্টোর বিরোধিতা এবং বিভিন্ন দলের এই রাজনৈতিক মতবিরোধের সুযোগ নেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন।

মুক্তিযুদ্ধে ঘোষণা ও মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারি: জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘটনার প্রতিবাদে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মকভাবে ধর্মঘট পালিত হয় ৩ মার্চ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। পল্টনে আয়োজিত এক জনসভায় পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইস্তাহার। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” ১৫ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনায় মিলিত হন। কিন্তু আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অনড় থাকে। অতঃপর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক হত্যালীলা চালায়। এর প্রতিবাদে মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি করা হয়।

পরবর্তী ঘটনাবলি: ১৭ এপ্রিল তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা শপথ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী পদে বসেন তাজউদ্দিন আহমেদ। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থনায় ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন-সহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক সমর্থন নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেয়।

পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতালাভ: এই সময় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনারা একটি যৌথ কমান্ড গঠন করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ১২ দিনের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের শেষে পাকিস্তানি সেনাপতি এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও উত্থানের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অকল্পনীয়। তাঁর ত্যাগ, আপসহীন সংগ্রামী মনোভাব পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতিকে আত্মপরিচয় লাভে এবং স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জনে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছিল।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment