সংগঠিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান : প্রাক ১৯১৭ ও উত্তর ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার ইতিহাস

সূচিপত্র

সংগঠিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান : প্রাক ১৯১৭ ও উত্তর ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার ইতিহাস | তৃতীয় অধ্যায় ইতিহাস দ্বাদশ শ্রেণি

সংগঠিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান
সংগঠিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান

১। সেফটি সেফটি ভাল্ভ তত্ত্ব (Safety Valve Theory) কী?

অথবা, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে কেন সেফটি ভাল্ড বলা হয়?

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় সেফটি ভাল্ভ তত্ত্ব:

জাতীয় কংগ্রেস-এর প্রতিষ্ঠায় প্রাক্তন ব্রিটিশ আমলা অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম-এর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জীবনীকার উইলিয়ম ওয়েডারবার্ন রচিত Allan Octavian Hume, C.B.: Father of the Indian National Congress, 1829 – 1912 গ্রন্থ থেকে হিউমের কর্মকান্ডের কথা জানা যায়। কর্মসূত্রে তিনি সিমলাতে থাকাকালীন সময়ে সাত খণ্ডের এক গোপন দলিল দেখার সুযোগ পান। সেগুলি পড়ে তিনি বুঝতে পারেন যে, ব্রিটিশ শাসনের চাপে জর্জরিত ভারতের সাধারণ ও নিম্নশ্রেণির মানুষেরা যে-কোনো সময় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। এই বিদ্রোহ থেকে দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়কে দূরে রেখে তাঁদের মতামতকে একটি নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করার জন্য হিউম জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। হিউমের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় কংগ্রেসকে ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থে সেফটি ভাল্ভহিসেবে ব্যবহার করা। হিউম স্বয়ং বলেছেন-‘আমাদের কাজের জন্য ভারতবাসীর মনে যে ব্রিটিশবিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হয়েছে, তার নির্গমনের জন্য একটি নিরাপত্তামূলক যন্ত্র (সেফটি ভাল্ভ) আশু প্রয়োজন এবং একাজে কংগ্রেসের মতো সংগঠন সবথেকে উপযোগী হতে পারে।’ এই সামগ্রিক ধারণাই সেফটি ভাল্ভ তত্ত্ব (Safety Valve Theory) নামে পরিচিত।

সেফটি ভাল্ভ তত্ত্বের সমর্থন: বিশিষ্ট চরমপন্থী নেতা লালা লাজপত রায় তাঁর Young India গ্রন্থে (১৯১৬ খ্রি.) প্রথম সেফটি ভাল্ভ তত্ত্ব উল্লেখ করে নরমপত্রীদের আক্রমণ করেন। তাঁর মতে, কংগ্রেস বড়োলাট লর্ড ডাফরিন-এর মস্তিষ্কপ্রসূত। সি এফ অ্যান্ড্রুজ ও গিরিজা মুখার্জি রচিত The Rise and Growth of the Congress in India গ্রন্থেও (১৯৩৮ খ্রি.) সেফটি ভাল্ভ তত্ত্বের সমর্থন পাওয়া যায়। উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রজনীপাম দত্ত এক্ষেত্রে হিউমের সঙ্গে বড়োলাট লর্ড ডাফরিন-এর সাক্ষাৎ ও আলোচনার বিষয়টিকে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে করেছেন।

সেফটি ভাল্ড তত্ত্বের সমর্থন : সাম্প্রতিক নানা গবেষণায় সেফটি ভাল্ভ তত্ত্বের অসাড়তা তুলে ধরেছেন বিপানচন্দ্র, অমলেশ ত্রিপাঠি, সুমিত সরকার-এর মতো ঐতিহাসিকগণ। তাঁদের প্রদত্ত যুক্তিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

  • সিমলায় অবস্থানকালে হিউম সাত খন্ড গোপন রিপোর্ট দেখার সুযোগ পান বলে ওয়েডারবার্ন দাবি করেছেন। কিন্তু বিপানচন্দ্র ও অন্যান্যরা দিল্লি বা লন্ডনের মহাফেজখানায় (তথ্যাগার) তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ওই নথির অস্তিত্ব দেখতে পাননি।
  • ওয়েডারবার্ন বলেছেন যে, ওই সকল গণ অসন্তোষের তথ্য প্রায় ৩০ হাজার প্রতিবেদক সংগ্রহ করেছিলেন। এই সংখ্যা অবাস্তব।
  • ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে হিউম ছিলেন রাজস্ব ও বাণিজ্য বিভাগের সচিব। তাঁর দফতর ছিল সিমলাতে। স্বভাবতই স্বরাষ্ট্র দফতরের গোপন তথ্য জানার সুযোগ তাঁর ছিল না।

পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে হিউম ও সেফটি ভাল্ভতত্ত্বের ধারণা গভীরভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু, তা সত্ত্বেও পুরোপুরিভাবে কংগ্রেসকে ব্রিটিশ শাসনের স্বার্থে গড়ে তোলা একটি সংগঠন বলা যুক্তিযুক্ত হবে না।

২। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউম ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব:

অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ কর্মচারী। আর তৎকালীন ভারতের বড়োলাট বা ভাইসরয় ছিলেন লর্ড ডাফরিন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে সিমলায় ডাফরিন ও হিউমের সাক্ষাৎ হয়। বেশকিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে, এই সাক্ষাৎ এবং তাঁদের আলোচনার মধ্যে দিয়েই জাতীয় কংগ্রেস তৈরির পরিকল্পনা করা হয়, যা ইতিহাসে হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত।

হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থন:

রজনীপাম দত্তের অভিমত: মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্ত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব-এর অবতারণা করে তাকে বহুল প্রচারিত করেন। তিনি তাঁর India Today গ্রন্থে (১৯৪০ খ্রি.) লেখেন যে, ভারতবর্ষে কোনও গণ অভ্যুত্থান ঘটার আগেই তাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র করে কংগ্রেসকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই কারণে কংগ্রেসের কর্মধারায় এক ধরনের দোদুল্যমানতা দেখা যায়। একদিকে কংগ্রেস গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, আবার আন্দোলন যখন দ্রুত বৈপ্লবিক পথে এগিয়েছে তখনই সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে আন্দোলন ভেঙে দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।

উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত: জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা Introduction to Indian Politics (১৮৯৮ খ্রি.) গ্রন্থে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার জন্য হিউম-এর সঙ্গে বড়োলাট লর্ড ডাফরিন-এর সাক্ষাৎ এবং ভারতীয়দের একটি জাতীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডাফরিনের উৎসাহের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এস আর মেহরোত্রার মত: ঐতিহাসিক এস আর মেহরোত্রা তাঁর The Emergence of the Indian National Congress (১৯৭১ খ্রি.) নামক গ্রন্থে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকেই সমর্থন করেছেন। হিউম মূলত ডাফরিন-এর পরামর্শ নিয়ে এবং লর্ড রিয়ে -কে সভাপতি করে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বলে মেহরোত্রা মনে করেন।

হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিরুদ্ধাচরণ :

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিপানচন্দ্র, অমলেশ ত্রিপাঠী প্রমুখ হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব-এর বিরোধিতা করেন। কারণ হিসেবে তাঁরা দেখিয়েছেন যে-

  • সেফটি ভাল্ভ ও ষড়যন্ত্রের ঘটনার সময়ে হিউম স্বরাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাই সরকারি গোপন রিপোর্ট দেখে ডাফরিন-এর সঙ্গে হিউমের আলোচনার ব্যাপারটা যুক্তিগ্রাহ্য হয় না।
  • ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে বোম্বাইয়ের ছোটোলাট লর্ড রিয়ে-কে লেখা বড়োলাট লর্ড ডাফরিন-এর একটি চিঠি থেকেই বোঝা যায় যে, হিউম-এর এই ধরনের সম্মেলনের প্রস্তাবকে সন্দেহের চোখেই দেখেছিলেন ডাফরিন। তিনি, হিউমকে একজন ধূর্ত, ছিটগ্রস্ত ও অহংকারী মানুষ বলেই মনে করতেন।

কংগ্রেস ব্রিটিশ কর্তৃত্ব রক্ষার হাতিয়ার হলে লর্ড ডাফরিন অবশ্যই কংগ্রেসের পক্ষে কথা বলতেন। কিন্তু কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি কংগ্রেসকে আণুবীক্ষণিক সংখ্যালঘু বা বাবুশ্রেণির সংগঠন বলে ব্যঙ্গ করেন।

পরিশেষে বলা যায়, হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের কাছেই স্বীকৃত নয়। তবে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

৩। টীকা লেখো: সুরাট বিচ্ছেদ (১৯০৭ খ্রি.)। অথবা, কংগ্রেসের সুরাট ভাঙনের পটভূমি আলোচনা করো।

সুরাট বিচ্ছেদ: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য ছিল বিস্তর। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন উভয়পক্ষের মধ্যেকার সংঘাত ক্রমে বাড়তে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের তাপ্তি নদীর তীরে সুরাটে কংগ্রেসের ২৩ তম অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী নেতাদের মধ্যে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে এই ঘটনা কংগ্রেসের সুরাট বিচ্ছেদ বা সুরাট ভাঙন নামে পরিচিত। আওয়া

কংগ্রেসের সুরাট ভাঙনের পটভূমি/ ১৯০৭খ্রিস্টাব্দে সুরাট অধিবেশনে কংগ্রেসের বিচ্ছেদের কারণসমূহ:

আদর্শগত বিরোধ: নরমপন্থীদের কাছে ব্রিটিশ শাসন ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ কিন্তু চরমপন্থীদের কাছে তা ছিল অভিশাপ। নরমপন্থীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে আবেদন-নিবেদন-এর মাধ্যমে দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চরমপন্থীরা সংঘবদ্ধভাবে সক্রিয় কর্মসূচির মাধ্যমে ভারতীয়দের দাবিদাওয়া আদায় তথা সমস্যাসমাধানে বিশ্বাসী ছিলেন।

উদ্দেশ্যগত পার্থক্য: উভয়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। নরমপন্থীরা ছিলেন আপোস-মীমাংসার মাধ্যমে ব্রিটিশদের অধীনে স্বরাজ অর্থাৎ স্বায়ত্তশাসন লাভে বিশ্বাসী। অপরদিকে, চরমপন্থীদের কাছে স্বরাজ ছিল ব্রিটিশমুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা।

কংগ্রেসের বেনারস অধিবেশন (১৯০৫ খ্রি): কংগ্রেসে মতাদর্শের বিরোধ ও সংঘাত প্রথম প্রকাশ্যে আসে জাতীয় কংগ্রেসের বেনারস অধিবেশনে (১৯০৫ খ্রি.)। এই অধিবেশনে লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সর্বসম্মতভাবে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু আন্দোলনের পদ্ধতির প্রশ্নে উভয়পক্ষের মতভেদ বৃদ্ধি পায়। চরমপন্থীরা রাজনৈতিক হাতিয়ার রূপে বয়কট আন্দোলনের উপর জোর দিয়ে এই আন্দোলনকে দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে দিতে চান। একই সঙ্গে তাঁরা বয়কট-কে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যুক্ত সবকিছুর সম্পর্ক ও সহযোগিতা বর্জনের দিকে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু নরমপন্থীরা বয়কট-কে নেতিবাচক আদর্শ আখ্যা দিয়ে তা কেবল বাংলার মধ্যেই সীমিত রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন (১৯০৫ খ্রি.): এরপর ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনেও নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের বিরোধ অব্যাহত থাকে। বাল গঙ্গাধর তিলক-কে চরমপন্থীরা এই অধিবেশনে সভাপতি করার চেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত নরমপন্থী দাদাভাই নৌরজি-কে তাঁরা সভাপতি হিসেবে মেনে নেন। তবে চরমপন্থীরা বয়কট আন্দোলনের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ জোরালো করার দাবিতে অনড় থাকেন।

সুরাট অধিবেশন ও চূড়ান্ত বিচ্ছেদ পর্ব: এক সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের আয়োজন শুরু হয়। এসময় নরমপন্থী নেতা ফিরোজ শাহ মেহতা পরবর্তী অধিবেশন স্থল নাগপুর থেকে সরিয়ে সুরাটে নিয়ে যান।

সভাপতি নির্বাচনে মতভেদ : সভাপতি নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে দেখা দেয় মতভেদ। চরমপন্থীরা লালা রাজপত রায়-কে সভাপতি পদে বরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, অন্যদিকে নরমপন্থীরা সভাপতিরূপে নির্বাচিত করেন। রাসবিহারী ঘোষ-কে। অতঃপর নরমপদী নেতা। রাসবিহারী ঘোষ-এর সভাপতিত্বে সুরাট অধিবেশন (২৬ ডিসেম্বর, ১৯০৭ খ্রি.)-এর সূচনা হয়।

চূড়ান্ত বিচ্ছেদ সভার চরমপত্রীরা দাবি তোলেন যে, পূর্ববর্তী অধিবেশনে গৃহীত চারটি প্রস্তাব (বয়কট, স্বদেশি, জাতীয় শিক্ষা ও স্বরাজ সমর্থন করা হোক। কিন্তু নরমপস্বীরা উক্ত চারটি প্রস্তাবের আলোচনা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। উভয়পক্ষের মতভেদের দরুন সৃষ্টি হয় এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির। শেষপর্যন্ত চরমপন্দ্বীদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

৪। লাল-বাল-পাল কাদের বলা হত?

লাল-বাল-পাল: প্রধানত বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাব-এ চরমপন্থী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে। এই তিন অঞ্চলের তিনজন প্রধান চরমপন্থী নেতা ছিলেন- পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায়, মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক ও বাংলার বিপিনচন্দ্র পাল। এঁদের তিনজনকে একসঙ্গে লাল-বাল-পাল বলে অভিহিত করা হয়।

লালা লাজপত রায়: পাঞ্জাব কেশরী নামে পরিচিত বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও আর্য সমাজের একজন সক্রিয় কর্মী লালা লাজপত রায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাঞ্জাব অঞ্চলে চরমপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের কংগ্রেসের বেনারস অধিবেশনে তিনি বলেন যে, নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে স্বরাজ অর্জন করা একটি আইনসম্মত পদ্ধতি। বয়কট, স্বদেশি ও গণ আন্দোলন-এর সমর্থনে তিনি গণসংযোগ গড়ে তোলেন। তাঁর উদ্যোগে পাঞ্জাবে স্বদেশি ব্যাংক বিমা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন বয়কট মিছিলে পুলিশের লাঠির আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন এবং কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন (১৭ নভেম্বর, ১৯২৮ খ্রি.)।

বাল গঙ্গাধর তিলক: জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও চরমপন্থী রাজনীতির অন্যতম অগ্রণী প্রবক্তা মহারাষ্ট্রের বিশিষ্ট নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক ছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তার কারণে তিনি লোকমান্য অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন। কেশরী ও মারাঠা (মাহরাট্টা) পত্রিকা মারফত তিনি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারে উদ্যত হন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণপতি উৎসবে বক্তৃতা, নাটক, গান ইত্যাদির মাধ্যমে শুরু করেন জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রচার। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিবাজি উৎসবের মাধ্যমে মহারাজা শিবাজির আদর্শ, বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও অখণ্ড ভারত রাষ্ট্র গঠনের কাহিনি প্রচার করেন। তিনি বলেছিলেন যে, স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার এবং আমি তা অর্জন করবই (Swaraj is my birthright and I must have it.)

বিপিনচন্দ্র পাল: বাংলার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বিপিনচন্দ্র পাল ছিলেন চরমপত্রী মতাদর্শের অন্যতম প্রবক্তা। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে তিনি স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। তিনি মনে করতেন, একমাত্র ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত ভারতেই স্বরাজ অর্জন সম্ভব। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ সত্তর বৎসর আধুনিক ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত।

৫। ভারতে সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের উদ্ভবের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ভারতে সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের উদ্ভবের কারণসমূহ:

উনবিংশ শতকের শেষ দশকে ভারতের রাজনীতিতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি নতুন ধারার উদ্ভব ঘটে। এটি ছিল সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের ধারা। এর অন্যতম প্রধান কারণগুলি ছিল-

(i) বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেসের ব্যর্থতা: নরমপত্রীদের আবেদন-নিবেদন নীতির ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে যুবসমাজ চরমপন্থী আন্দোলনে আশার আলো দেখেছিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে চরমপন্থীরা বয়কট বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলনের কর্মসূচি নিলেও, তা রূপায়ণের সঠিক পথ খুঁজে পাননি। জনগণের সামনে গণ আন্দোলনের নতুন কোনও রূপ উপস্থিত করতে পারেননি।

(ii) তৎকালীন সংবাদপত্রের প্রচার: সেসময় প্রকাশিত বন্দেমাতরম্, যুগান্তর সংবাদপত্রগুলি কংগ্রেসের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধেরও তীব্র সমালোচনা করে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে দলীয় ভাঙনের ফলে চরমপন্থীদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লে যুবসমাজ সশস্ত্র আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁদের অসন্তোষ প্রতিফলিত হয় যুগান্তর পত্রিকায় (এপ্রিল, ১৯০৬ খ্রি.)। শান্তিপূর্ণ বরিশাল সম্মেলনের উপর পুলিশের নির্মম আক্রমণের প্রতিবাদে লেখা হয়, “দেশের ত্রিশ কোটি মানুষ যদি তাদের ষাট কোটি হাত প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞায় তুলে ধরে তবেই বন্ধ হবে এই অত্যাচার। একমাত্র শক্তি দিয়েই শক্তির প্রতিরোধ করা সম্ভব।”

(iii) মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব : স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক পেশিশক্তি এবং ইস্পাত কঠিন স্নায়ুর বিকাশ সাধনায় যুবসমাজকে আহ্বান, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর দেশাত্মবোধক রচনাবলি; বাল গঙ্গাধর তিলক, ঋষি অরবিন্দ প্রমুখের জাতীয়তাবাদী আদর্শ ইত্যাদি। বিপ্লবী আন্দোলনের একটা মনস্তাত্ত্বিক পটভূমি গড়ে দেয়।

(iv) আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির প্রভাব : বিদেশের বিপ্লববাদী আন্দোলনের দৃষ্টান্ত ভারতের সশস্ত্র সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ সমাজকে অনুপ্রাণিত করে। বিপ্লববাদীরা হাঙ্গেরিতে লুই কসুথ-এর সংগ্রাম, ইটালির কার্বোনারি দলের আন্দোলন, রাশিয়ার নিহিলিস্টদের ক্রিয়াকলাপ থেকে গুপ্ত সমিতি স্থাপনের মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের শিক্ষা গ্রহণ করেন। কালক্রমে বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্র ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সক্রিয় কেন্দ্রে পরিণত হয়।

৬। ক্ষুদিরাম বসু কেন স্মরণীয়?

অথবা, বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে ক্ষুদিরাম বসুর অবদান লেখো।

বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের বীর অগ্নিসন্তান ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম বিপ্লবী যিনি ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হয়েছিলেন। ক্ষুদিরাম বসুর আত্মবলিদান বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করেছিল।

বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে ক্ষুদিরাম বসুর অবদান

পূর্ব পরিচয়: ক্ষুদিরাম বসু ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর মেদিনীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে হ্যামিলটন স্কুল ও কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষালাভের পর তিনি বিপ্লবী আদর্শে উদ্‌বুদ্ধ হয়ে যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত হন।

কিংসফোর্ড হত্যার দায়িত্ব লাভ : মি. কিংসফোর্ড ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলার বিপ্লবীদের উপর ভয়ংকর নির্যাতনের নির্দেশ দিতেন। তাঁর নির্মম অত্যাচারের উপযুক্ত শাস্তি হিসেবে বাংলার বিপ্লবীরা তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে মি. কিংসফোর্ড মুজফ্ফরপুরে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার দায়িত্ব পান বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি।

কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা: ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি মুজফফরপুরে গিয়ে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল রাত আটটা নাগাদ পরিকল্পনামতো একটি ঘোড়ার গাড়ির উপর বোমা ছোঁড়েন। কিন্তু সেটি কিংসফোর্ডের গাড়ি ছিল না। ভুলবশত কিংসফোর্ডের জায়গায় ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা বোমার আঘাতে মারা যান।

পরিণতি: ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যার পর ক্ষুদিরাম বসু পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। বিচারে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট তাঁর ফাঁসি হয়।

মূল্যায়ন: উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে ক্ষুদিরাম বসু-র অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর এই আত্মবলিদান বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।

৭। মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী আন্দোলনে বাসুদেব বলবন্ত ফাদকের ভূমিকা লেখো।

অথবা, ভারতের বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের জনক কাকে, কেন আখ্যা দেওয়া হয়?

মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী আন্দোলনে বাসুদেব বলবন্ত ফাদকের ভূমিকা:

প্রথম জীবন: ভারতের সশস্ত্র বিপ্লববাদের পথপ্রদর্শক ছিলেন বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ৪ নভেম্বর বর্তমান মহারাষ্ট্রের কোলাবা জেলার এক চিৎপাবন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। মহারাষ্ট্রের থানে জেলায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি পুনা হাইস্কুল থেকে শিক্ষালাভ করেন। এরপর বোম্বাইতে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে কোম্পানির অডিট অফিসে করণিক হিসেবে যুক্ত হন ফাদকে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি সরকারি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ: ১৮৭৬-১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বেকারত্ব, খাদ্যের জন্য হাহাকার এবং দরিদ্র সাধারণ মানুষের কষ্ট দেখে ফাদকে ব্যথিত হন। এই দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা যান। সরকারের উদাসীনতা লক্ষ করে তিনি দেশের সকল দুরবস্থার জন্য ইংরেজ সরকারকে দায়ী করেন। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত থেকে ইংরেজ শাসনের অবসানের শপথ গ্রহণ করেন। এই লক্ষ্যে ফাদকে কিছু যুবকদের বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত করেন। রামোশি নামক এক নির্যাতিত ও পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীকে দলভুক্ত করে তাদের অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। এ ছাড়াও তিনি ধাঙড়, কোল, ভিল প্রভৃতি নিম্নবর্গীয় মানুষদের সংগঠিত করে বিপ্লবী দল গঠন করেন। সম্ভবত এটিই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী দল। ব্রিটিশদের সমর্থক ধনী ব্যবসায়ী ও মহাজনদের বাড়ি লুঠ করে এই দল দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে তা বণ্টন করে দেয়।

ফাদকের পরিকল্পনা: ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের জন্য ফাদকে যে পরিকল্পনাগুলি গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলি হল- গুপ্ত বিপ্লবী সংঘ স্থাপন, বিপ্লবের প্রয়োজনে অর্থ সংগ্রহের জন্য রাজনৈতিক ডাকাতি, রেল চলাচল ও ডাকব্যবস্থা বিপর্যস্ত করা, জেলবন্দিদের মুক্ত করে তাদের দলের অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি। তিনি স্থানীয় আফগানি সর্দার ইসমাইল খান-এর সাহায্য নিয়ে বৈপ্লবিক কাজকর্ম পরিচালনা করেন।

গ্রেফতার ও মৃত্যু : ফাদকে-র বিপ্লবী দলের কাজকর্ম ও তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমেই ব্রিটিশ সরকারকে শঙ্কিত করে। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে বন্দি করা হয় এবং যাবজ্জীবন নির্বাসন দন্ড দিয়ে পাঠানো হয় আরবের এডেন জেলে। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বন্দি অবস্থায় যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

বিপ্লবী বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে ভারতের অগণিত সশস্ত্র বিপ্লবীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ফাদকের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও তাঁর আদর্শ সফল হয়েছিল। তাঁরই দেখানো পথে পরবর্তীকালে বিপ্লবীরা নির্ভয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। এজন্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ফাদকে-কে ভারতের বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের জনক (Father of Militant Natonalism in India) বলে আখ্যায়িত করেছেন।

৮। গদর পার্টি সম্পর্কে কী জানো লেখো।

আজ ভারতের ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের ইতিহাসে গদর দল বা গদর পার্টি-র গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিংশ শতকে ভারতে একদিকে যেমন বিপ্লবী ভাবধারা তথা আন্দোলনের প্রসার ঘটে তেমনি ভারতের বাইরে বিদেশের মাটিতেও বিপ্লবী ভাবাদর্শ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। গদর পার্টির প্রতিষ্ঠা ছিল বিদেশের মাটিতে এই ভাবাদর্শ বিস্তারের এক সার্থক রূপায়ণ।

গদর পার্টি:

প্রতিষ্ঠা: ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে লালা হরদয়াল-এর সক্রিয় উদ্যোগে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে গদর দল (Ghadar Party) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গদর শব্দের অর্থ-বিদ্রোহ। সম্ভবত এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সোহন সিং ভাকনা এবং প্রথমদিকের নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন লালা হরদয়াল। গদর দল প্রতিষ্ঠার স্বল্পকালের মধ্যেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫ হাজার স্বাধীনতাকামী প্রবাসী ভারতীয় এই পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন।

পত্রিকা প্রকাশ: গদর পার্টির প্রধান মুখপত্র ছিল গদর পত্রিকা। এই পত্রিকা লালা হরদয়াল-এর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হত। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে বিপ্লবী অগ্নিমন্ত্র প্রচারিত হত এই পত্রিকায়। ইংরেজি গদর পত্রিকা হিন্দু, উর্দু, গুজরাটি প্রভৃতি ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে এবং ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দেওয়া হত।

বিপ্লবী কার্যকলাপের প্রসার: কালক্রমে গদর পার্টি আমেরিকা ও কানাডার প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনা বিকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গদর পার্টির সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং পার্টির বহু সদস্য বিদেশ থেকে অর্থ ও অস্ত্র-সহ ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। পরবর্তীতে কোমাগাতামারু ঘটনা (Komagata Maru Incident)-কে কেন্দ্র করে গদরপন্থীদের বিক্ষোভচরমে ওঠে।

লালা হরদয়ালের বিরুদ্ধে মামলা: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ আমেরিকায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টির অপরাধে মার্কিন সরকার লালা হরদয়াল-কে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে। জামিনে মুক্তি লাভ করে তিনি জার্মানিতে চলে যান। এই সময়ে ব্রিটিশ সরকার গদর পার্টি ও পত্রিকাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে।

এভাবে বিদেশের মাটিতে ও ভারতবর্ষে বিপ্লবী চেতনা বিস্তারে গদর পার্টির অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment