একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মানবশিশুর দেহের আকার বা আয়তন, ওজন ও উচ্চতার স্বতঃস্ফূর্ত ও স্থায়ী পরিবর্তনই হল বৃদ্ধি। Arnolt’ Jones-এর মতে, দেহের উচ্চতা ও ওজন বেড়ে যাওয়াকে বৃদ্ধি বলে; যেমন-শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধি, ওজন বৃদ্ধি, হাতের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য, শিক্ষা ও মনস্তত্বে বৃদ্ধির ধারণা শুধুমাত্র আকার ও আয়তনে বৃদ্ধি নয়, পরিণমনও এর অন্তর্ভুক্ত। পরিণমন (Maturation) হল কোনো কিছু করার উপযুক্ত স্তরে উপনীত হওয়া, যেমন-হাঁটার জন্য পায়ের মাংসপেশিগুলি উপযুক্ত পরিমাণে পুষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য | বৃদ্ধির নীতিসমূহ | বৃদ্ধির শিক্ষাগত প্রভাব
বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য
শিশুর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, সেগুলি হল-
(1) বৃদ্ধি বংশধারা ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার ফল:
বংশধারা ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার ফলেই বৃদ্ধি ঘটে। অনেক মনোবিদ মনে করেন, বৃদ্ধির ওপর বংশধারার প্রভাব অধিক। আবার অনেকের মতে, পরিবেশের কারণেই বৃদ্ধি ঘটে। অধিকাংশ মনোবিদ অবশ্য মনে করেন বৃদ্ধি বংশধারা ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার ফল। কার প্রভাব বেশি বা কম তা অপ্রাসঙ্গিক। শিক্ষকের কাজ হল, এমন পরিবেশ রচনা করা, যা মিথস্ক্রিয়াকে উৎসাহিত করে এবং বৃদ্ধিকে সার্থক করে তোলে।
(2) বিভিন্ন বয়সে বৃদ্ধির হার:
বিভিন্ন বয়সে বৃদ্ধির হার বিভিন্ন। এইচ ডি মেরেডিথ (H V Meredith) বৃদ্ধির হারের ওপর লম্ব অধ্যয়ন করেছেন (Longitudinal বা ‘লম্ব অধ্যয়ন পদ্ধতি’ বলতে বোঝায় একই শিশু বা শিশুদলকে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অধ্যয়ন করা)। মেরেডিথ অধ্যয়ন করে দেখেছেন যে-[i] জন্ম থেকে 2-2% বছর পর্যন্ত বৃদ্ধির হার খুব বেশি। [ii] 2% বছর থেকে বয়ঃসন্ধিক্ষণের 2 বছর পূর্ব পর্যন্ত বৃদ্ধির হার হ্রাস পায়। [iii] বয়ঃসন্ধিক্ষণের কিছু পূর্ব থেকেই বৃদ্ধির হার পুনরায় দ্রুত ঘটে। [iv] বয়ঃসন্ধিক্ষণের পরে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধির হার হ্রাস পায়।
শিক্ষার ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হারের তাৎপর্য হল-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকগণ দ্রুত বৃদ্ধির স্বার্থে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য এবং অনুশীলনের ব্যবস্থা করবেন। শিক্ষা এবং সমাজের অন্যান্য উপাদানের প্রতি উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে শিক্ষক ছাত্রদের প্রতি বিশেষ নজর দেবেন এবং বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবেন।
(3) বৃদ্ধি ও অনুশীলন:
বৃদ্ধির ওপর অনুশীলনের প্রভাব সম্পর্কিত একাধিক পরীক্ষা হয়েছে এবং ধনাত্মক প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া গেছে (হিলগার্ড-1932; ব্রুনার-1963)। উপযুক্ত বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকগণ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের অনুশীলনের ব্যবস্থা করবেন।
(4) একই বয়সে বৃদ্ধির হারের তারতম্য:
শিশুদের মধ্যে বৃদ্ধির হারে পার্থক্য দেখা যায়। কিছু শিশু দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং কোনো কোনো শিশুর বৃদ্ধি শ্লথ গতিতে হয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীর বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে শিক্ষা-পরিকল্পনা রচনা করবেন।
(5) বৃদ্ধির সম হার:
ব্যক্তিভেদে বৃদ্ধির সম হার সাধারণভাবে বজায় থাকে। যে শিশু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে থাকে, সারা জীবনেই সে এগিয়ে থাকে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর জন্য বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা কর্মসূচি পরিকল্পনায় বৃদ্ধির এই বৈশিষ্ট্যের ওপর গুরুত্ব দেবেন। সকলের জন্য একই কর্মসূচি সুপারিশ করা শিক্ষামনোবিজ্ঞানসম্মত নয়।
(6) বৃদ্ধি নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া:
একটা স্তর পর্যন্ত বৃদ্ধি নিরবচ্ছিন্ন এবং ধারাবাহিক। বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আবার একই সঙ্গে অসুবিধাজনক। শিশুর বৃদ্ধি নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে। বয়সভেদে বৃদ্ধির হারের পরিবর্তন ঘটতে পারে, কিন্তু কোনো বয়সে থেমে গিয়ে আবার শুরু হয়-এমনটি ঘটে না। তাই বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিকতা একটি অন্যতম শর্ত। শিক্ষাক্ষেত্রে এটি তাৎপর্যপূর্ণ এই অর্থে যে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। অসুবিধাজনক এই অর্থে যে, বৃদ্ধি নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক হওয়ার জন্য স্তরভিত্তিক ভাগ করা বিজ্ঞানসম্মত হয় না।
বৃদ্ধির নীতিসমূহ [Principles of Growth]
বৃদ্ধি বলতে মানব শরীরের পরিমাণগত পরিবর্তনকে বোঝানো হয়, যা দেহের উচ্চতা, ওজন এবং শরীরের ভর (mass)-এর দিক থেকে পরিমাপ করা যায়। বৃদ্ধি কেবলমাত্র শারীরিক পরিবর্তনের উপর জোর দেয়। এখানে বৃদ্ধি সম্পর্কিত কয়েকটি মূলনীতি আলোচনা করা হল-
(1) মাথা থেকে পায়ের দিকে অগ্রসরের নীতি:
এই নীতি অনুসারে, মানুষের বৃদ্ধি শিশুর মাথা এবং শরীরের উপরের অংশ থেকে শুরু হয় এবং তারপর নীচের দিকে অগ্রসর হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জন্মের সময় একটি শিশুর মাথা শরীরের তুলনায় অনেক বড়ো হয় কিন্তু বৃদ্ধি ঘটার সাথে সাথে শরীরের অন্যান্য অংশও বড়ো হয়।
(2) মধ্য থেকে দূরবর্তীতে অগ্রসরের নীতি:
বৃদ্ধি মূলত শরীরের কেন্দ্র থেকে শুরু হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিকে অগ্রসর হয়। এর অর্থ হল, প্রথমে শরীরের কেন্দ্র বৃদ্ধি পায়, তারপর বাহু এবং পা, এবং শেষে হাতের আঙুল এবং পায়ের আঙুল। এই নীতির মাধ্যমে বোঝা যায় যে, শিশুরা প্রথমে তাদের ধড়ের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে, তারপর আঙুলের নড়াচড়া।
(3) ব্যবস্থার স্বতন্ত্রতার নীতি:
মানব শিশুর বিভিন্ন শারীরিক ব্যবস্থা বিভিন্ন হারে বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্নায়ুতন্ত্র, কঙ্কাল তন্ত্র এবং পেশি ব্যবস্থা তাদের নিজস্ব সময়সীমা অনুযায়ী বৃদ্ধি পায়। এই নীতি থেকে বলা যায় যে, শরীরের সব অংশের বৃদ্ধি একসাথে হয় না।
(4) অসমতার নীতি:
ব্যক্তির বৃদ্ধির হার সারাজীবন জুড়ে একইপ্রকার থাকে না। যেমন-শৈশব এবং কৈশোরকালে দ্রুত বৃদ্ধি হয়, কিন্তু মধ্য শিশুকালে বৃদ্ধি ধীর গতিতে হয়। এই নীতি বিভিন্ন সময়ে বৃদ্ধির বিভিন্ন গতির স্বীকৃতি দেয়।
(5) জিনগত এবং পরিবেশগত প্রভাবের নীতি:
বৃদ্ধির উপর জিনগত এবং পরিবেশগত উভয় প্রকার প্রভাবই থাকে। জিনগত প্রভাব সম্ভাব্য উচ্চতা এবং শরীরের গঠন নির্ধারণ করতে পারে, অন্যদিকে পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা এবং বাসস্থানের মতো পরিবেশগত কারণগুলি বৃদ্ধির প্রকৃত ফলাফলের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
(6) হরমোনঘটিত নিয়ন্ত্রণের নীতি:
ব্যক্তির বা শিশুর বৃদ্ধিতে হরমোন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সোমাটোট্রফিক হরমোন দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। এই হরমোন কম ক্ষরণ হলে বৃদ্ধি-হ্রাস পেতে পারে, আবার বেশি ক্ষরণ হলে অতিকায়ত্ব দেখা দিতে পারে। অন্তঃক্ষরাতন্ত্র তাই স্বাভাবিক বৃদ্ধির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
(7) ক্রমাগত ও পূর্বাভাসযোগ্য ধরন অনুসরণের নীতি:
বৃদ্ধি একটি ক্রমাগত এবং পূর্বাভাসযোগ্য ধরন অনুসরণের নীতি মেনে চলে। যার অর্থ বেশিরভাগ শিশু শারীরিক বৃদ্ধির একই ধাপ অতিক্রম করে। এই ধরনগুলি বৃদ্ধির মাইল ফলকগুলির পূর্বাভাস দিতে সহায়তা করে, যেমন-একটি শিশুর হাঁটা বা কথা বলার গড় বয়স।
(8) ব্যক্তিগত বৈষম্যের নীতি:
সাধারণ ধরন সত্ত্বেও, বৃদ্ধি হারের এবং ধরনের ব্যক্তিগত পার্থক্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ। জিনগত, জাতিগত, স্বাস্থ্যগত, এমনকি লিঙ্গের মতো কারণগুলি ব্যক্তিদের মধ্যে বৃদ্ধির বৈচিত্র্যে অবদান রাখতে পারে।
বৃদ্ধির শিক্ষাগত প্রভাব [Educational Implication of Growth]
শিক্ষার বিভিন্ন দিক শিশুর বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে। শিশুদের শারীরিক, মানসিক (বৌদ্ধিক), সামাজিক এবং আবেগীয় বৃদ্ধিতে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(1) শারীরিক বৃদ্ধি
- শারীরশিক্ষা: স্কুলে শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এটি তাদের শরীরের সঠিক বিকাশ এবং শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- স্বাস্থ্যশিক্ষা: স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, সঠিক ঘুম এবং নিয়মিত ব্যায়াম সম্পর্কে শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা তাদের শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে শেখে।
(2) মানসিক বৃদ্ধি
- বৌদ্ধিক: পাঠ্যক্রম এবং সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটে। এটি তাদের চিন্তাশক্তি, যুক্তি এবং সমস্যা-সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
- গবেষণা ও অনুসন্ধান: শিশুরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা এবং অনুসন্ধান করে নতুন তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে পারে, যা তাদের মানসিক বৃদ্ধিকে তরান্বিত করে।
(3) সামাজিক বৃদ্ধি
- সহযোগিতা ও দলগত কাজ: স্কুলের পরিবেশে শিশুরা সহযোগিতা এবং দলগত কাজের মাধ্যমে সামাজিক দক্ষতা অর্জন করে। এটি তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি এবং বন্ধুত্বের মানসিকতা গড়ে তোলে।
- সামাজিক নিয়ম ও মূল্যবোধ: শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা সমাজের নিয়ম ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সেগুলো অনুসরণ করতে শেখে।
(4) আবেগীয় বৃদ্ধি
- আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রকাশ: শিক্ষা শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রকাশ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সৃজনশীল কার্যক্রম ও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি: শিক্ষা শিশুদেরকে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে যুক্ত হতে সাহায্য করে এবং তাদেরকে পেশাগত দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করে।
(5) নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গঠন
- শিক্ষা ও মূল্যবোধ: শিক্ষার প্রভাবেই শিশুরা সৎ, ন্যায় পরায়ণ এবং দায়িত্বশীল হতে শেখে।
এইভাবে শিক্ষা শিশুর বৃদ্ধির প্রতিটি ধাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ সফলতার ভিত্তি তৈরি করে।
আরও পড়ুন | Link |
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
আগুন নাটকের বড়ো প্রশ্ন উত্তর | Click Here |