অষ্টম শ্রেণির প্রথম পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়নে ইতিহাস বিষয়ে মোট 15 নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হবে। এই 15 নম্বরের মধ্যে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অধ্যায় থেকে মোট 12 নম্বরের প্রশ্ন থাকবে। পরীক্ষায় এখান থেকে একটি বড়ো প্রশ্নের উত্তর করতে হবে। বড়ো প্রশ্নের ধরন হবে 5 নম্বরের এবং মাঝারি প্রশ্নের ধরন হবে 3 নম্বরের। ছোটো প্রশ্নের ধরন হবে গোটা 2 ও 1 নম্বরের। আজকের এই প্রশ্নোত্তর পর্বে অষ্টম শ্রেণির প্রথম পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন ও তৃতীয় পর্বের পরীক্ষার জন্য এই অধ্যায় থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উত্তরসহ তুলে ধরা হল।
ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা
১। সংস্কারক হিসেবে লর্ড বেন্টিঙ্ক-এর ভূমিকা লেখো।
লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ছিলেন একজন উদারবাদী শাসক। ইংল্যান্ডের হিতবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় জনগণের সার্বিক উন্নতি ও মঙ্গলসাধনের জন্য তিনি শাসন, বিচার, অর্থনীতি, শিক্ষা, সমাজ – সর্বত্র বেশ কিছু সংস্কারসাধন করেছিলেন।
শাসনসংস্কার
- উদারবাদী শাসক লর্ড বেন্টিঙ্ক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে ভারতীয়দের উচ্চ সরকারি পদ, যেমন- ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর প্রভৃতি নানা পদে নিয়োগ করেন।
- বেন্টিষ্কের শাসনকালে যে আইন তৈরি হয় সেখানে বলা হয় ব্রিটিশ কোম্পানি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণের পরিবর্তে শুধুমাত্র যোগ্যতা বিচার করবে।
- লর্ড উইলিয়ম বেন্টিষ্কের শাসনকালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোম্পানির জন্য সনদ আইন প্রবর্তন করে এবং তিনি কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেন।
বিচারসংস্কার
- লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক-এর উদ্যোগে এ সময় ভারতীয় দণ্ডবিধি (Indian Penal Code) প্রবর্তিত হয়।
- তিনি ভ্রাম্যমান আদালত ও প্রাদেশিক আপিল আদালত তুলে দিয়ে তার পরিবর্তে এলাহাবাদে সর্বোচ্চ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া ভারতীয়দের দেওয়ানি মামলার বিচারক পদে নিয়োগ করেন।
- উচ্চ আদালতগুলিতে যাবতীয় কাজকর্ম ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় চালু করেন।
অর্থনৈতিক সংস্কার
- লর্ড বেন্টিঙ্ক-এর শাসনকালে কোম্পানির বার্ষিক করের ঘাটতি পূরণের জন্য তিনি কর্মচারীদের বেতনের পরিমাণ হ্রাস করেন।
- মাদ্রাজে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি করেন।
সমাজসংস্কার
- লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা রদ করে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
- উত্তর ও মধ্য ভারতে সক্রিয় ‘ঠগি’ দস্যুদের দমন করার জন্য কর্নেল স্লিম্যানের নেতৃত্বে বেন্টিঙ্ক একটি বিশেষ বিভাগ তৈরি করেন। এর পাশাপাশি পিন্ডারি দস্যুদেরও তিনি দমন করেন।
শিক্ষাসংস্কার: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক আইনসচিব মেকলের নেতৃত্বে ভারতে পাশ্চাত্য – শিক্ষার বিস্তার ঘটান। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ডাক্তারি শিক্ষার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও বোম্বাইতে এলফিনস্টোন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
এইভাবে সংস্কারক হিসেবে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক উল্লেখযোগ্য ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।
২। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে নতুন পুলিশি ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণ কী ছিল? কোম্পানির আমলে পুলিশি ব্যবস্থার কী সংস্কার করা হয়েছিল?
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সূচনাকালে এদেশে মুঘল পুলিশি ব্যবস্থা চালু ছিল। পরে ওয়ারেন হেস্টিংস, কর্নওয়ালিস পুলিশি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করেন।
কোম্পানির নতুন পুলিশি ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণ: ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুলিশি ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণগুলি হল-
- আইনশৃঙ্খলার উন্নতিসাধন: ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছিল। মুঘল আমলের পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে এই অবস্থার মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। তাই কোম্পানি পুলিশি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে সচেষ্ট হয়।
- আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা: ব্রিটিশ কোম্পানির লক্ষ্য ছিল ভারতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আর এজন্য প্রয়োজন ছিল প্রচলিত পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার করে নতুন ধাঁচের পুলিশি ব্যবস্থার প্রবর্তন করা।
- ইংল্যান্ডের অনুকরণ: দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটিয়ে কোম্পানি নতুন শাসনকাঠামো গড়ে তোলে। এর গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল পুলিশবাহিনী। এক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের অনুকরণে প্রচলিত পুলিশি ব্যবস্থার পুনর্গঠন করা হয়।
সংস্কার
- ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস ফৌজদারের জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেটদের পুলিশবিভাগের দায়িত্ব দেন।
- ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে কর্নওয়ালিস প্রত্যেক জেলাকে কয়েকটি থানায় ভাগ করে পুলিশি ব্যবস্থা চালু করেন- ① প্রতি থানায় একজন করে দারোগা নিযুক্ত করেন। ② জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দারোগাদের নিয়ন্ত্রণ করতেন।
- ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে দারোগাব্যবস্থার বিলোপ করে তার জায়গায় কালেক্টরদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
- ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুপ্রদেশ অঞ্চলে নতুন ধাঁচের পুলিশি ব্যবস্থা চালু করা হয়। পরবর্তীকালে আলাদা পুলিশ আইন তৈরি হয়।
ক্রমশ এই পুলিশি ব্যবস্থা ভারতে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রদর্শনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার রূপে আত্মপ্রকাশ করে।
৩। ভারতে কোম্পানি শাসনের বিস্তার ও সেনাবাহিনীর বৃদ্ধির মধ্যে কি সরাসরি সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয়? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।
ভারতে কোম্পানি শাসনের বিস্তার ও সেনাবাহিনীর বৃদ্ধির সম্পর্ক: ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিস্তারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বৃদ্ধি সমানুপাতিকভাবে বেড়েছিল। অর্থাৎ ভারতে কোম্পানির সাম্রাজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর বৃদ্ধি ঘটেছিল।
সমানুপাতিক বৃদ্ধির কারণ :
(i) সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রয়োজনে: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামনে যখনই নতুন এলাকা দখলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তখনই কোম্পানির প্রয়োজন হয়েছিল আরও সেনাবাহিনীর।
(ii) অধিকৃত অঞ্চল দখলে রাখার জন্য: ব্রিটিশ কোম্পানি নতুন যে যে এলাকা দখল করেছিল সেই এলাকার নিরাপত্তার জন্য এবং অধিকৃত অঞ্চলে কোম্পানির কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার জন্য সেনাবাহিনীর বৃদ্ধি করা হয়েছিল।
(iii) বিভিন্ন বিদ্রোহের মোকাবিলা করার জন্য: ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের ক্ষোভও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ক্ষুব্ধ জনগণ ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের জন্য বারবার বিদ্রোহ ঘোষণাও করত। ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্রোহের মোকাবিলা করার জন্য কোম্পানি সেনাবাহিনী বৃদ্ধি করেছিল।
ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ছিল সেনাবাহিনী। ১৮৮০-র দশকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে ২ লক্ষ ৫০ হাজার সেনা ছিল। দেশীয় ও ইউরোপীয়দের নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছিল।
৪। কর্নওয়ালিস কেন সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা চালু করেছিলেন?
প্রথমদিকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং মূলত বাণিজ্যিক কাজকর্মের জন্যই কোম্পানি বিভিন্ন কর্মচারী নিয়োগ করত। এরপর বাংলায় কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে এইসব কর্মচারীরাই বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নানাবিধ অসুবিধা দেখা দেওয়ায় কোম্পানি প্রশাসনিক কর্মচারী নিয়োগ করা শুরু করলে ভারতে সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থার সূচনা হয়। লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থার প্রবর্তক ছিলেন।
সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা প্রবর্তনে কর্নওয়ালিসের উদ্দেশ্য
- লর্ড কর্নওয়ালিস আমলাতন্ত্রকে সংগঠিত করার জন্য এবং কোম্পানির প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা চালু করেন।
- কর্নওয়ালিস উপলব্ধি করেছিলেন যে কর্মচারীদের উপযুক্ত বেতন না দিলে তাদের কাছ থেকে সততা ও দক্ষতা লাভ করা সম্ভব নয়।
- সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে সংগঠিত করতে ও কর্মচারীদের দুর্নীতিমুক্ত করতে তিনি কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও উপহার নেওয়া বন্ধ করে দেন।
- কর্নওয়ালিস প্রশাসনিক কর্মচারীদের বেতনের হার বৃদ্ধি করেন। এ সময় ভারতে কোম্পানির বে-সামরিক কর্মচারীদের বেতনের হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ছিল অনেক বেশি
- প্রশাসনিক কাজে ভারতীয়দের সততা ও দক্ষতা সম্পর্কে লর্ড কর্নওয়ালিস অত্যন্ত হীন মনোভাব পোষণ করতেন, তাই সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থায় তিনি ইউরোপীয়দের নিয়োগের নীতি গ্রহণ করেন।
এভাবে কোম্পানি-প্রশাসনের অধীনে আমলাতন্ত্রকে সংগঠিত করা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্তভাবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে লর্ড কর্নওয়ালিস সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা চালু করেন।
৫। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কীভাবে সিভিল সার্ভিসের সূচনা হয়? অথবা, কোম্পানির আমলে ভারতে কীভাবে আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠে?
বাণিজ্যিক কাজের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিভিন্ন কর্মচারী (কেরানি, ফ্যাক্টর, অ্যাপ্রেনটিস) নিয়োগ করত। পরে কোম্পানি বাংলাদেশে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করলে এইসব কর্মচারীরাই প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত হয়। এর ফলে কার্যক্ষেত্রে বিভিন্ন অসুবিধা দেখা দেওয়ায় কোম্পানি প্রশাসনিক কর্মচারী নিয়োগ করে। ফলে সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থার সূচনা হয়।
সিভিল সার্ভিস- প্রথম পর্যায়: ব্রিটিশ রাজনীতিকরা এবং জনগণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে ব্যবসায়ীদের শাসন বলে বিদ্রুপ করত। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের পিট-এর ভারত আইন এবং ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতীয় আমলাতন্ত্রের গুণমান ও দক্ষতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়। এর ফলে কোম্পানির ডাইরেক্টর সভার সুপারিশক্রমে ইংল্যান্ড থেকে রাজকর্মচারী বা সিভিল সার্ভেন্ট নিয়োগের ব্যবস্থা হয়।
কভেন্যান্ট সিভিল সার্ভিস: কোম্পানির ডাইরেক্টর সভার সুপারিশক্রমে কর্মচারী নিয়োগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়। এর বদলে যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ ব্যবস্থা বা কভেন্যান্ট সিভিল সার্ভিস চালু হয়। এক বিশেষ নিয়োগ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই রাজকর্মচারীরা ভারতীয় আমলাতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। তারাই ছিল আই সি এস-এর পূর্বসূরি। লর্ড কর্নওয়ালিস এই ব্যবস্থা চালু করেন। এজন্য তিনি আই সি এস-এর জনক নামে পরিচিত।
প্রশিক্ষণ : এইভাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর (রাজস্ব আধিকারিক), জজ (বিচারক), পুলিশকর্তাদের নিয়োগ করা হয়। ইংল্যান্ডের এইসব রাজকর্মচারীদের ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি ও জনজীবন সম্বন্ধে শিক্ষাদানের জন্য লর্ড ওয়েলেসলি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে। এরপর একই উদ্দেশ্যে লন্ডনের কাছে হেইলবেরিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮০৬ খ্রি.)।
নতুন প্রশাসন : লর্ড কর্নওয়ালিস প্রশাসনে বিশেষীকরণ চালু করে শাসন, রাজস্ব ও বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ করেন। ‘কর্নওয়ালিস কোড’ চালু করে, উচ্চ বেতনের ব্যবস্থা করে তাদের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ করেন। প্রশাসনে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ হয়।
এই ব্যবস্থার ফলে প্রশাসনের উচ্চপদগুলি ইংরেজদের হাতে ন্যস্ত হয় এবং যোগ্যতাই ছিল এই পদপ্রাপ্তির মানদণ্ড।
৬। ব্রিটিশ কোম্পানির প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা কী ছিল? কীভাবে আমলারা একটি সংকীর্ণ গোষ্ঠী হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল?
ব্রিটিশ কোম্পানির প্রশাসন ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা: ঔপনিবেশিক প্রশাসনে আমলাতন্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
- আমলাতন্ত্র ছিল ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রধান স্তম্ভ।
- আমলাদের প্রধান কাজ ছিল সরকার যে নীতি গ্রহণ করত সেই নীতিগুলি প্রয়োগ করা বা কার্যকর করা। তবে সরকারি নীতি নির্ধারণে আমলাদের স্বাধীনতা ছিল না।
ঐক্যবদ্ধ সংকীর্ণ গোষ্ঠী হিসেবে আমলাতন্ত্র
লর্ড কর্নওয়ালিসের ভূমিকা: লর্ড কর্নওয়ালিস সিভিল সার্ভিস বা আমলাতন্ত্রকে সংগঠিত করেছিলেন। কর্নওয়ালিস ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি ব্যবস্থা নেন। যথা-
- বিধিবদ্ধ চাকরি: আমলাদের নির্দিষ্ট মেয়াদের চাকরিতে নিয়োগ করেন।
- পদোন্নতি: আমলাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হয়।
- বেতন বৃদ্ধি: প্রশাসনের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যাবসা ও উপহার নেওয়া বন্ধ করেন ও তাদের বেতন বৃদ্ধি করেন।
- অভারতীয় নিয়োগ: লর্ড কর্নওয়ালিস সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের নিয়োগ বন্ধ করেন।
লর্ড ওয়েলেসলির ভূমিকা: এরপর লর্ড ওয়েলেসলি ইউরোপীয় প্রশাসকদের ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
- ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ: লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে সিভিল সার্ভেন্ট বা অসামরিক প্রশাসকদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
- হেইলবেরি কলেজ: ব্রিটিশ কোম্পানির পরিচালক সভা কলকাতার বদলে ব্রিটেনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। হেইলবেরি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এরপর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সব প্রার্থীদেরই এই কলেজে পড়াশোনা করতে হত।
সিভিল সার্ভেন্টরা একই কলেজে পড়ত বলে তাদের মধ্যে ঐক্যবোধ তৈরি হয়। তারা নিজেদের একটি আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে ভাবতে শুরু করে। ভারতীয় সমাজের মূল ধারার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
৭। ‘আইনের শাসন’ বলতে কী বোঝায়? ইংরেজরা কি ভারতবর্ষে আইনের শাসন সঠিকভাবে চালু করেছিল? ‘কর্নওয়ালিস কোড’ কী?
আইনের শাসন: ভারতে ইংরেজ শাসনের সবচেয়ে বড়ো অবদান হল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। আইনের শাসন বলতে বোঝায়- দেশের সকলকে একই আইন মেনে চলতে বাধ্য করা এবং আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় -এই নীতি মেনে চলা।
ভারতে আইনের শাসনের প্রয়োগ: ইংরেজরা ভারতে আইনের শাসনের উচ্চ আদর্শ প্রচার করলেও তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করেনি। বিচারব্যবস্থা ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত। বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় বিচারকরা ইউরোপীয়দের বিচার করতে পারত না। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়রা উচ্চপদ পেত না।
কর্নওয়ালিস কোড: ভারতের বড়োলাট লর্ড কর্নওয়ালিস কর্মচারীদের অসাধুতা ও দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য যে আচরণবিধি ও আইন প্রণয়ন করেছিলেন, তাকে কর্নওয়ালিস কোড বলা হয়। কর্নওয়ালিস কোডে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার কথা বলা হয়।
ভারতে কোম্পানির ঔপনিবেশিক আধিপত্যকে আইনের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয় এবং আমলাতন্ত্রের দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়।
৮। ভারতে ইংরেজ কোম্পানির আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা উল্লেখ করো।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনায় রাজ্যবিস্তার ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণে বেশি মনোযোগী হয়েছিল। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টি পড়েছিল বিলম্বে। ভারতে সরকারিভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হয় বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে।
উনিশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা: ভারতে সরকারি প্রচেষ্টায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনের পূর্বে বেসরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয় খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে।
খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টা: খ্রিস্টান মিশনারিগণ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়ম কেরি, মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যাপটিস্ট মিশন ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। তৈরি হয় শ্রীরামপুর ছাপাখানাও।
- বিশপ মিডলটন শিবপুরে বিশপস্ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
- স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইন্সটিটিউশন, যা বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ নামে পরিচিত। তিনি অনেকগুলি মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
- লন্ডন মিশনারি সোসাইটি বহু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল।
- তা ছাড়া বোম্বাই-এর উইলসন কলেজ (১৮৩২ খ্রি.), মাদ্রাজের খ্রিস্টান কলেজ (১৮৩৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা ছিল এদের উল্লেখযোগ্য কর্তৃত্ব।
এইভাবে মিশনারিদের উদ্যোগে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে।
৯। পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে সরকারি উদ্যোগগুলি লেখো।
প্রথমদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ না করলেও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে।
পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে সরকারি উদ্যোগ :
(i) চার্টার আইন: ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত চার্টার আইনে জনশিক্ষার জন্য সরকার প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করবে বলা হয় এবং এই উদ্দেশ্যে গঠিত হয় ‘কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন।’
(ii) মেকলের প্রতিবেদন: ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতবর্ষের শিক্ষা প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন, যা মেকলে মিনিটস নামে পরিচিত। তিনি এই প্রতিবেদনে ভারতবর্ষে প্রচলিত সনাতন জ্ঞানচর্চাকে হেয় করেন এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্ব দেন।
(iii) বেন্টিঙ্কের ঘোষণা: ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিষ্কের উদ্যোগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, এলফিনস্টোন ইন্সটিটিউট প্রভৃতি স্থাপিত হয়।
(iv) কাউন্সিল অফ এডুকেশন প্রতিষ্ঠা: ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় সরকারি উদ্যোগে ‘কাউন্সিল অফ এডুকেশন’ তৈরি হয়। ক্রমশ কাউন্সিল নিয়ন্ত্রিত বিদ্যালয় ও তার ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।
(v) উডের ডেসপ্যাচ: ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অফ কন্ট্রোলার সভাপতি চার্লস উডের নেতৃত্বে শিক্ষাসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পেশ করা হয়, এটি উডের ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত। এই নির্দেশনামার উপর ভিত্তি করে বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এই নির্দেশনামা অনুসারে একটি শিক্ষাবিভাগ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। উডের সুপারিশ অনুসারে কলকাতা, বোম্বাই এবং মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
এইভাবে সরকারি উদ্যোগে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে।
আরও পড়ুন | Link |
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
আগুন নাটকের বড়ো প্রশ্ন উত্তর | Click Here |