লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ
লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ

জাতীয়তাবোধের আর-এক নাম ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা। এর চূড়ান্ত রূপ ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান। বিদেশি শাসক ভারতবাসীর স্বার্থ দেখত না। ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভূমির স্বার্থে ভারতকে শোষণ করা। এই অবস্থায় ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছিল অনিবার্য। সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষ ইংরেজ শাসনে যুক্ত ছিল। তাদের প্রত্যেকের ক্ষোভ অবশ্যই একরকম ছিল না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভ ও কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির ক্ষোভের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিল। জমিদার ও পুঁজিপতি শ্রেণির ক্ষোভের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির ক্ষোভের কোনো মিল ছিল না।

আবার মুসলমান সম্প্রদায়ের ক্ষোভের চেহারা ছিল অন্যরকম। জাতীয়তাবোধের উন্মেষে অবশ্য শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভের ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। তাদের মধ্যেই জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটেছিল। তারাই চেয়েছিল মাতৃভূমির শাসনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও পরিশেষে স্বাধীনতা। ইংরেজ শাসকরাও এই বিষয়ে অবহিত ছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে ভারতীয় জনগণকে কিছুটা খুশি করার জন্য শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণের সীমিত সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় জনগণ তাতে খুশি হয়নি। আসলে এই চেষ্টার মধ্যে কোনো আন্তরিকতা ছিল না। বাদামি বর্ণের ভারতীয়দের শ্বেতাঙ্গ ইংরেজরা মানুষ বলেই মনে করত না। তাদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই ইংরেজদের ছিল না।

কেবলমাত্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ থাকলেই জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটে না। তার মধ্যে চাই মানসিক প্রস্তুতি ও চেতনা। সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে। জাতীয়তাবোধের পাঠ তারা গ্রহণ করেছে পশ্চিমের ইতিহাস থেকে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, ইটালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। ভারতীয় সাহিত্য তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের সঞ্চার করেছিল।

বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রভৃতি সাহিত্যিক, অহমিয়া ভাষায় লক্ষ্মীকান্ত বেজবডুয়া, মারাঠি ভাষায় বিন্নুশাস্ত্রী চিপলংকার, তামিলে সুব্রহ্মণ্য ভারতী, হিন্দিতে ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র এবং উর্দুতে আলতাফ হুসেন আলি প্রমুখের নাম আমাদের মনে পড়ে। সাহিত্য ছাড়া সংবাদপত্রও জাতীয়তাবোধের বিকাশে সহায়ক হয়েছিল। সংবাদপত্র ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের হাতিয়ার। সংবাদপত্রের মধ্যে হিন্দু প্যাট্রিয়ট, অমৃতবাজার कि? ধারাবাহিক-ভাবে আনন্দমঠ প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকা (প্রথমে বাংলায়, পরে ইংরেজিতে), ইন্ডিয়া মিরর, সোমপ্রকাশ, বেঙ্গলি, মারহাট্টা, কেশরী, হিন্দু প্রভৃতি অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। জাতীয়তাবোধের বিকাশে রেখা বা ছবির ভূমিকা অবশ্যই সাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয় নয়।

সীমিত সুযোগ সত্ত্বেও চিত্রশিল্পীরা ছবির মাধ্যমে জাতীয়তাবোধের আদর্শ তুলে ধরেছিলেন। এই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর ছোটো ভাই গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম সবিশেষে উল্লেখযোগ্য।

জাতীয়তাবোধের বিকাশে আনন্দমঠ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর (১২৮৯ বঙ্গাব্দ)। ইতিহাসের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসটি স্বদেশপ্রেমের এক জ্বলন্ত নিদর্শন। এই উপন্যাসের বিশিষ্ট সম্পদ হল বন্দেমাতরম সংগীত। এই উপন্যাসে সন্তান দলের মুখ দিয়ে উচ্চারিত বন্দেমাতরম ধ্বনি শুধু বাংলার নয় সমগ্র ভারতবাসীকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আদর্শে উদ্দীপ্ত করে। আনন্দমঠের কাহিনি বাংলার ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণের দুটি ঘটনা অবলম্বনে রচিত। এই দুটি ঘটনা হল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০ খ্রি.) ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। উপন্যাসটির কয়েকটি বিশিষ্ট চরিত্র হল ভবানন্দ, জীবানন্দ, কল্যাণী, সত্যানন্দ, মহেন্দ্র প্রমুখ।

এই উপন্যাসটির কাহিনি বিশ্লেষণে দেখা যায় মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের জন্য একদল বাঙালি যুবক এক বৃদ্ধ সাধকের শিষ্যত্ব নেয়। তারা অত্যাচারী নবাবি শাসনের ধ্বংসের শপথ নেয়। এই লক্ষ্যে তারা গভীর অরণ্যে আশ্রম তৈরি করে বাস করে। আশ্রমে তারা মাতৃমূর্তি (অর্থাৎ দেশজননী) প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে দেখা যায় উপন্যাসের মূলপ্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে ওঠে দেশভক্তি। এই দেশভক্তির পটভূমিকাই আনন্দমঠ উপন্যাসের বোধন ও বিসর্জন। এই যুবক সন্তান দলের ত্যাগ, বৈরাগ্য ও মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব সমর্পণের আদর্শ পরবর্তীকালের বাংলা তথা ভারতের বিপ্লবীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়।

সমালোচকদের ধারণা হল, ওয়াল্টার স্কটের লেখা ‘ওল্ড মরটালিটি’ উপন্যাসের প্রভাব রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে। দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে ‘কভেনান্টার’ নামে স্কটল্যান্ডের সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ইংল্যান্ডের রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শামিল হয়। স্কটের লেখা এই বিদ্রোহের কিছুটা মিল রয়েছে বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের কাহিনিতে। জন্মভূমিকে মাতৃদেবীর সঙ্গে তুলনা করায় স্বদেশবাসীর অন্তরে দেশাত্মবোধের সঞ্চার ঘটে। বিপ্লবী আন্দোলনের পর্বে দেখা যায় বিপ্লবীরা একহাতে আনন্দমঠ আর অন্য হাতে গীতা নিয়ে মাতৃমুক্তি যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকালে আনন্দমঠের বন্দেমাতরম মন্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। স্বদেশি আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলিতে বন্দেমাতরম মন্ত্র বিপ্লবীদের বীজমন্ত্র হয়ে ওঠে। আনন্দমঠ উপন্যাসে ভারতের জাতীয় সংগীত ‘বন্দেমাতরম’ ইংরেজদের ‘গড সেভ দ্য কিং’, ফরাসিদের ‘দাস মারসেই-মেইজ’ জার্মানদের ‘হেইল-ডির সিয়োজারভান্‌ন্জ’, ইতালীয়দের ‘লা মারসিয়া রিয়েল’ প্রভৃতি জাতীয় সংগীত অপেক্ষা এগিয়ে থাকবে। কারণ বন্দেমাতরম-এর মধ্যে যেভাবে এক বৃহৎ জাতির আত্মজাগরণের মন্ত্র লুকিয়ে ছিল, অন্য দেশের জাতীয় সংগীতে তা ছিল না। তাই আনন্দমঠ উপন্যাসকে জাতীয় জাগরণের অন্যতম উৎস বললে ভুল বলা হবে না।

জাতীয়তাবোধের বিকাশে বর্তমান ভারত

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মুখপত্র উদ্বোধন পত্রিকার প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে কয়েকটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় স্বামী বিবেকানন্দের লেখা বর্তমান ভারত (১৮৯৯ খ্রি.)। পরে এটি গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয় (১৯০৫ খ্রি.)। ভারতবর্ষের ইতিহাস বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের স্বামীজির মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে।

এই গ্রন্থে ভারতে আগত জাতিসমূহের দ্বারা এদেশের আচার-ব্যবহার ও কার্যপ্রণালীর পরিবর্তন ও তার ভবিষ্যৎ-এর ওপর আলোকপাত করাই এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন দিক বর্ণনার পাশাপাশি ইংরেজদের এদেশ অধিকার, সমাজে বৈশ্যশক্তির অভ্যুদয়। পুরোহিতদের অবস্থান, ক্ষত্রিয় শক্তির স্বরূপ, ভারতের শাসনপ্রণালীর দোষ- গুণ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংঘর্ষ, স্বদেশমন্ত্র- “আমায় মানুষ কর” প্রভৃতি বিষয়ের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই গ্রন্থে।

‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটি কেবলমাত্র সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাসমাত্র নয়, এটি একটি দর্শন গ্রন্থ। প্রাচীন ভারতের বৈদিক যুগের পর ব্রাহ্মণ্য শক্তির আধিপত্যের সময় থেকে আধুনিক যুগের শূদ্র জাগরণের সময় পর্যন্ত ভারতীয় ধর্ম ও সমাজজীবনের সারকথা এতে বর্ণিত হয়েছে। শুদ্রজাগরণ বলতে বিবেকানন্দ সাধারণ মানুষের উত্থানকে চিহ্নিত করেছেন। এই গ্রন্থের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানবপ্রেম ও দেশভক্তি। এই গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ দেশবাসীকে স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছেন। তিনি পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা প্রভৃতি দাসসুলভ দুর্বলতা ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি সমাজের সকলকে নিজের ভাই বলে ভাবতে শিখিয়েছেন। পাশ্চাত্যের স্বামী বিবেকানন্দ অন্ধ অনুকরণমোহ তিনি ত্যাগ করতে বলেছেন।

প্রাচীন ভারতের দিকে তাকিয়ে স্বামীজি বলেছেন রামচন্দ্র, অশোক বা আকবরের মতো প্রজা কল্যাণকামী শাসকের ভীষণ অভাব। তিনি বলেছেন বৌদ্ধ বিপ্লবের পর ব্রাহ্মণ্যশক্তির বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে রাজশক্তির সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। স্বামীজির ধারণায় বিদ্যা, অস্ত্র ও অর্থ এই তিন বলের প্রভাবেই যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের আধিপত্য গড়ে উঠেছে সমাজে। আলোচ্যে গ্রন্থে স্বামীজি প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংঘর্ষের স্বরূপ বর্ণনা করেছেন।

স্বামীজি আলোচ্য গ্রন্থের একেবারে শেষে মানুষ হয়ে ওঠার পথ নির্দেশ করেছেন। নারী জাতির প্রতি সম্মান রক্ষার পাশাপাশি দেশবাসীকে স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন। স্বামীজি বলেছেন, ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা সকলেই জন্ম থেকে মাতৃভূমির জন্য আত্মবিসর্জনে প্রস্তুত। আমাদের সমাজের নীচু জাতিভুক্ত, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ মানুষেরা সকলেই আমাদের কাছে ভাইয়ের মতো। তিনি আরও বলেছেন, সমস্ত ভারতবাসীই আমার প্রাণ, ভারতের সমাজ আমাদের জীবনের সবকিছু, ভারতের মাটি আমাদের কাছে স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমাদের সকলের কল্যাণ।

জাতীয়তাবোধের বিকাশে গোরা

১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গোরা উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। সুবিশাল উপন্যাস ‘গোরা’- তে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও বিশ্বাত্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। উপন্যাসটির কয়েকটি চরিত্র হল-গোরা, আনন্দময়ী, পরেশবাবু, বিনয়, ললিতা, সুচরিতা, কৃস্নদয়াল প্রমুখ। এই উপন্যাসের পটভূমি রচনাকালের ২৫ বছর আগের সমকালীন সমাজের সনাতন হিন্দুধর্ম ও নবজাত ব্রাহ্মণ ধর্মের মানুষের দ্বন্দ্ব সংঘাতে সমাজজীবন যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল তারই প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে এই উপন্যাসে। একইসঙ্গে এই উপন্যাসটিতে সমসাময়িক যুগের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারা ধরা পড়ে। গোরা উপন্যাসটির সূচনা ধর্মে ও সাম্প্রদায়িকতায় এবং এর সমাপ্তি ঘটেছে ধর্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষতায়।

গোরা উপন্যাসটিতে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ধর্মের এবং ধর্মের সঙ্গে মানবসত্যের বিরোধ ও সমন্বয়ের ছোঁয়া রয়েছে। গোরা উপন্যাসের মূল চরিত্র গোরা ইংরেজবিদ্বেষী কিন্তু সে হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের মূঢ়তা সহ্য করতে পারে না। গোরা পারিবারিক গন্ডির মধ্যে এবং বৃহত্তর ভারতবর্ষে আত্মানুসন্ধান করেছে। দেখা যায় প্রথমে সে হিন্দু আচারবিদ্বেষী হলেও পরে একজন গোঁড়া হিন্দু আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছে। মানবতাই হল তার ধর্ম ও মানুষ হল তার জাতি। আনন্দময়ী (পালিতা মা)-র মধ্যেই সে সমগ্র ভারতবর্ষকে খুঁজে পায়।

উপন্যাসের মূল সুরটি হল-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরা একজন আইরিশম্যানের পুত্র। সে বিদেশি, বিধর্মী, নিজের জন্ম পরিচয় না জেনে একজন হিন্দুর ঘরে মানুষ হয়। নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসেবেই সে একজন ইংরেজবিদ্বেষী, খ্রিস্টান ধর্মবিরোধী হয়ে ওঠে। তার কাছে হিন্দু ধর্মের সবকিছুই পবিত্র। এখানেই গোরা চরিত্রটি উপন্যাসকে মহিমাময় করে তুলেছে। জাতীয়তাবোধ ও হিন্দুত্ব একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে ধরা পড়েছে। গোরার দেশপ্রেম শুধু দেশমাতৃকা সমাজে কোনো ধারণার মধ্যে আবদ্ধ নয়, তা দেশের সমগ্র মানবগোষ্ঠীর মধ্যেই প্রসারিত।

জাতীয়তাবোধের বিকাশে ভারতমাতা চিত্র

ভারতীয় চিত্রশিল্পের জগতে এক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর চিত্রশৈলীর একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল ওয়াশ চিত্ররীতি। এই চিত্ররীতি অবলম্বনে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতমাতা চিত্র আঁকেন। যদিও এই চিত্রটির প্রথমে নাম ছিল বঙ্গমাতা। ভগিনী নিবেদিতা এর নামকরণ করেন ভারতমাতা। এই চিত্রের মধ্যে দিয়ে শান্ত, অভয় ও সমৃদ্ধি প্রদানকারী মাতৃদেবীর রূপকে কল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে ভারতমাতার মাতৃরূপ ধরা পড়ে। এই চিত্রটি একাধারে মানবী ও দেবী হিসেবে কল্পিত হয়েছে। একইসঙ্গে চিত্রটিতে পরিচিত ও অতিপ্রাকৃত রূপের সমন্বয় ধরা পড়েছে। সমকালীন বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনে মিছিলের সামনে আন্দোলনকারীদের হাতে থাকত এই চিত্রটি। বলা যায় জাতীয়তাবোধের উজ্জীবনে ও স্বদেশি কথার প্রসারে এই চিত্রটির যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রে উপনিবেশিক সমাজের সমালোচনা

উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী হিসেবে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মপ্রকাশ ঘটে। একরঙা ও একাধিক রং দিয়ে আঁকা তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে সমকালীন বাংলার ও ঔপনিবেশিক সমাজের ছবি ধরা পড়ে। মূলত সামাজিক অসঙ্গতিকে মূল বিষয় করে তিনি তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে তাঁর চিত্রগুলি আঁকেন। তাঁর এই ব্যঙ্গচিত্রগুলির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, যিনি এই ব্যঙ্গচিত্রগুলি ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকাতে প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রগুলি ভারতী, নারায়ণ, আগমনী ও বার্ষিক বসুমতীতে প্রকাশিত হয়।

তাঁর আঁকা ব্যঙ্গচিত্রগুলি তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। সেগুলি হল-সামাজিক সমস্যামূলক, ব্যক্তিবিশেষে ক্রিয়াকর্মমূলক ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গমূলক ব্যঙ্গচিত্র। তাঁর জীবদ্দশায় আঁকা ব্যঙ্গচিত্রগুলির তিনটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই তিনটি সংকলন হল-বিরূপ বজ্র, অদ্ভূত লোক, নব হুল্লোড়। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় আর-একটি সংকলন। মৃত্যুর পরবর্তী সংকলনটি হল মরণোত্তর ব্যঙ্গচিত্র সংকলন। তাঁর আঁকা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ব্যঙ্গচিত্র হল জাতাসুর (Millstone of Caste), পরভূতের কাকলি (Courtesy to country- men), বিদ্যার কারখানা (Cramming Machine), বাক্যন্ত্র (The Auto Speechola) প্রভৃতি। জাতাসুর নামে ব্যঙ্গচিত্রে আমাদের সমাজের জাতপাত তথা বর্ণবৈষম্যের ভয়াবহ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। সমাজের উচ্চবর্ণের রক্ষণশীল মানুষদের অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামির জন্য কীভাবে সামাজিক ঐক্য ভেঙে পড়েছে তার ইঙ্গিত দেয় এই ব্যঙ্গচিত্রটি।

আরও পড়ুন – পরিবেশ দূষণ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment