ভারতে বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ফলাফল (ক্লাস 12 রাষ্ট্রবিজ্ঞান)

ভারতে বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ফলাফল

ভারতে বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ফলাফল
ভারতে বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ফলাফল

ভারতে বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ফলাফল

বিশ্বায়ন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। এটি মূলত অর্থনৈতিক একীকরণের উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে আবির্ভূত হয়। বিশ্বায়নের ফলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, পরিবেশগত এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও অর্থনৈতিক প্রভাব সর্বাধিক। ভারতে বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাবকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রভাবগুলি হল

ইতিবাচক ফলাফল

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: বিশ্বায়নের প্রভাবে ১৯৯০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, মুক্ত বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির গতিকে ত্বরান্বিত করেছিল। এই সময় থেকে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির বার্ষিক গড় সূচক পূর্বেকার ৩.৫% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭.৭%-এ পৌঁছায়। ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক গড়ে ৯.৫%। যদিও বর্তমানে বিশ্বায়ন উত্তরযুগে তা নেমে ৬%-এ এসেছে।

যাইহোক সরাসরিভাবে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতীয় অর্থনীতির সাবেকি চেহারায় বদল এসেছে। নাগরিকদের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের জিডিপি বা মোট জাতীয় উৎপাদন (Gross Domestic Product-GDP)-এর ক্রমবর্ধমানতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার এবং নীতি আয়োগ প্রদত্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ।

বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ: বিশ্বায়নের ফলে ভারতের বাণিজ্য ক্ষেত্রটি সম্প্রসারিত হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী ভারতীয় পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ওষুধ, বস্ত্র, কৃষিপণ্য ইত্যাদি রফতানির কথা বলা যায়। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সুযোগে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী রফতানির ক্ষেত্রে ভারত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগীমূলক হতে পেরেছে। বিশ্ব বাজারে ভারতের অবস্থান দৃঢ়তর হয়েছে। পাশাপাশি কৃষি বাণিজ্যকরণেও গতি এসেছে অর্থাৎ কৃষিজ পণ্যের রফতানির পরিসর ও পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এপ্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণের ফলে, ভারত ব্যাবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও ব্যাপক উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করেছে।

বিনিয়োগ বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের মাধ্যমে ভারতে শিল্পখাতে বিদেশি বিনিয়োগ তথা FDI-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিদেশি পুঁজির প্রবাহ সহজতর হয়েছে।

আবার ভারতও বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করে কলকারখানা স্থাপন করেছে। যেমন- টাটা গোষ্ঠী শ্রীলঙ্কায় তাজ হোটেল স্থাপন করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিস, টিসিএস (TCS)-ও বর্তমানে MNC কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।

কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন: বিশ্বায়নের কারণে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কৃষকরা আন্তর্জাতিক বাজারে ফসল বিক্রয় করে তাদের আয় বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছে। এজন্য তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। পাশাপাশি, ভারত সরকার বিশ্বায়নের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য কৃষি ভরতুকি, কৃষির সরঞ্জাম কেনার জন্য ঋণপ্রদান, কৃষি প্রযুক্তিজ্ঞান প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।

শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি: বিশ্বায়নের ফলস্বরূপ বহু বিদেশি কোম্পানি বা বহুজাতিক সংস্থাগুলি ভারতে তাদের ইউনিট স্থাপন করেছে। ফলে ভারতের শ্রমবাজারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যেমন-মার্কিন কোম্পানি অ্যাপেল ব্যাঙ্গালোরে কারখানা স্থাপন করেছে, এ ছাড়া গুগল, মাইক্রোসফ্ট, অ্যামাজন, টেসলা, সুইস কোম্পানি নেস্টলে ইত্যাদির কথা বলা যায়।

মেটা, কগনিজেন্ট ইত্যাদি তথ্যপ্রযুক্তি (IT) সংস্থাও ভারতে তাদের ইউনিট স্থাপন করেছে। পণ্য পরিসেবার বাজারে ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি, সফ্টওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ক্রেতা সহায়তা ইত্যাদি নতুন ক্ষেত্রগুলি সম্প্রসারিত হয়েছে ফলে নতুন নতুন পেশায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তি বা ম্যানেজমেন্ট-এর মতো ‘হোয়াইট কলার জব’ মধ্যবিত্তের শিক্ষিত অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও উদ্ভাবন: বিশ্বায়ন ভারতের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও উদ্ভাবনকে আরও বিকশিত করেছে। ভারত বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি পরিসেবায় নিজেকে পাওয়ার হাউস হিসেবে তুলে ধরেছে। বর্তমানে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম আই টি (IT) আউটসোর্সিং হাব। ২০২২-২০২৩ সালে অর্থবর্ষে ভারতের আই টি রফতানি ১৯৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। এর ফলে আউটসোর্সিং এবং বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (BPO)-এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে ভারত মহাকাশ প্রযুক্তিতেও ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। উদাহরণ হিসেবে ‘ইসরো’ (ISRO)-র ‘চন্দ্রযান ৩’-এর সফল উৎক্ষেপণের কথা বলা যায়।

অন্যদিকে বিশ্বায়নের ফলে ভারতে ব্যাংকিং ও আর্থিক ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। নেট বা মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম-এর মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে UPI-এর মাধ্যমে ‘ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম’ ভারতকে আর্থিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে তুলে ধরেছে।

জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন: অনেকে মনে করেন, বিশ্বায়নের ফলে ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মান পূর্বের তুলনায় উন্নত হয়েছে। কারণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতীয়দের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রভাবে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে, যারা এই বিকাশজনিত অর্থনীতির প্রভাবে ভোগ্যপণ্য ও পরিসেবা ক্রয়ের ক্ষমতার অধিকারী, তাই ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা ২০২০-২১-এর সময় ছিল ৪৩২ মিলিয়ন, ২০৩০-৩১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৭১৫ মিলিয়ন অর্থাৎ, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৭%।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার প্রদত্ত ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক আউটলুক (WEO)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত অতি দ্রুত উদীয়মান বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

উন্নত পরিকাঠামো ও নগরায়ণ: বিশ্বায়নের ফলে বিদেশি বিনিয়োগ ভারতের উন্নত পরিকাঠামো নির্মাণে ও নগরায়ণে যেভাবে সহায়তা করেছে তার ফলে জাতীয় সড়ক এবং অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা-সহ শহরগুলির আধুনিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। স্মার্ট সিটি মিশন (Smart Cities Mission) অনুযায়ী ভারতে ১০০টি স্মার্ট সিটি তৈরি করার কথা ঘোষিত হয়েছে। দিল্লি ও মুম্বাইয়ের মতো শহরে বিদেশি প্রযুক্তির সহায়তায় মেট্রো রেল প্রকল্পগুলি দ্রুত বাস্তবায়িত করা হচ্ছে।

ভোগ্যপণ্যের বিকল্প বৃদ্ধি: বিশ্বায়ন ভারতীয় ভোক্তাদের কাছে বিকল্প পণ্যের পথ সুগম করেছে। একদিকে ব্যাবসাতে প্রতিযোগিতা আসায় নির্মাতারা কম দামে ভালো পণ্যের জোগান দিয়ে ক্রেতাকে পছন্দের পণ্য ক্রয় করার সুযোগ করে দিয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমি ব্র্যান্ড ও পণ্যগুলির প্রবাহ বেড়েছে। ভারতীয় ভোক্তারা নতুন পণ্য ও পরিসেবার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। তাদের বিশ্বমানের পণ্য ও পরিসেবা ক্রয়ের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন-টেলিভিশন সেট, মোবাইল ফোন অথবা অনলাইন পণ্য পরিসেবা এর অন্তর্ভুক্ত। অনলাইন পরিসেবার মধ্যে ওলা (Ola), উবার (Uber), ফ্লিপকার্ট-এর মতো সংস্থাগুলি উল্লেখযোগ্য।

প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি: বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বায়ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের আধুনিকীকরণ করতে সহায়তা করেছে। এর ফলে ভারত যে শুধু নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে তাই নয়, সেইসঙ্গে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিদেশে রফতানির ক্ষেত্রে রেকর্ড লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। ২০২৩-২০২৪ সালের অর্থবর্ষে ২১ হাজার ৮৩ কোটি টাকার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি করে রেকর্ড গড়েছে ভারত।

নেতিবাচক ফলাফল

ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বায়নের ইতিবাচক তথা সুফলগুলি পরিলক্ষিত হলেও ভারত-সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বিশ্বায়নের কুফলের পরিমাণটাই বেশি। অর্থাৎ বিশ্বায়ন ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনলেও প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো বিশ্বায়নেরও কিছু নেতিবাচক প্রভাব ভারতে লক্ষ করা যায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের নেতিবাচক ফলাফলগুলি হল-

অর্থনৈতিক বৈষম্য: বিশ্বায়নের ফলে ভারতীয় সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। মুক্ত বাজার ব্যবস্থা এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে উদারীকরণ মোট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করলেও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে। কর (Tax) ব্যবস্থার সংস্কার কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ছাড় দিলেও মধ্যবিত্তের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করভার বৃদ্ধি করেছে ফলে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

শুধু তাই নয় গ্রাম ও শহরের মধ্যেও আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় শহরের অভিজাত মধ্যবিত্ত মানুষেরা অনেক বেশি উপকৃত হয়েছে, সেই তুলনায় গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজন অনেকটা পিছিয়ে পড়েছেন। বিশ্বায়নের ফলে ধনীদের হাতে দেশের সিংহভাগ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। অক্সফ্যামের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতে সবচেয়ে ধনী ১ ভাগ মানুষের কাছে মোট সম্পদ রয়েছে ৪০ শতাংশ।

বেকারত্ব বৃদ্ধি: বিশ্বায়ন নতুন নতুন ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু দেশীয় শিল্পের ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষের নিয়োগের পরিবর্তে কর্মীছাঁটাই করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া বহুজাতিক সংস্থাগুলি উৎপাদন ও পরিসেবা দানের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ার ফলে অর্ধ দক্ষ ও অদক্ষ (Unskilled) শ্রমের বাজারে কর্মহীনতা (Unemployment) ও কর্মচ্যুতি (Job displacement) দেখা দিয়েছে।

দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়: শুল্ক শিথিলকরণ ও বিদেশি পণ্যের জন্য বাজার উন্মুক্ত করায় বহুজাতিক ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারীরা এদেশে উৎপাদন ও বিপণনের অবাধ সুযোগ পেয়েছে। এর ফলে উপভোক্তা (Consumer)-দের পণ্য পছন্দ ও দরাদরির সুযোগ বৃদ্ধি পেলেও, দেশীয় উৎপাদনকারীরা বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি অনেক দেশীয় কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮০-র দশকে ভারতে যে দেশীয় টেলিভিশন কোম্পানিগুলি যেমন-ওয়েস্টন, টেলরাড, টেলিরামা ইত্যাদি বন্ধ হয়ে গেছে এবং তার জায়গা নিয়েছে সোনি, এলজি, স্যামসাঙ্, প্যানাসনিক-এর মতো বহুজাতিক ব্র্যান্ড। ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের প্রায় সবক্ষেত্রেই বিশ্বায়ন MNC-গুলির আধিপত্যের সুযোগ করে দিয়েছে। দেশীয় কোম্পানি ছাড়াও ভারতের যেসব ঐতিহ্যবাহী হস্ত শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ছিল সেগুলিও অস্তিত্ব হারাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ভারতের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পরিপন্থী। কারণ বিশ্বায়নের ফলে আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলের উপরে ভারতের নির্ভরতা অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল ও ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে এই নির্ভরতা বেশি করে দেখা যাচ্ছে।

কৃষিব্যবস্থার উপরে নেতিবাচক প্রভাব: কর্পোরেট দুনিয়া দ্বারা চালিত এই নয়া বিশ্বব্যবস্থা ভারতের চিরাচরিত কৃষিব্যবস্থাকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে। কৃষিব্যবস্থায় রাসায়নিক সার ও বীজের ক্ষেত্রে বিদেশি বহুজাতিক কর্পোরেশনের আধিপত্য ভারতের চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজের পদ্ধতিকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। ঐতিহ্যবাহী ফসল থেকে কৃষকগণ মুখ ফিরিয়ে রফতানিমুখী ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে পড়ছে। কারণ বিদেশি কোম্পানিগুলি অত্যাধিক মুনাফার স্বার্থে স্থানীয় কৃষকদের দিয়ে রফতানিমুখী ফসল উৎপাদন করানোর ফলে মৃত্তিকার উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে ভবিষ্যতের খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পায়, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করার সম্ভাবনা ঘটায়।

বিশ্বায়ন ভারতের সচ্ছল ও ধনী কৃষকদের অনেক সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করলেও প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের অবস্থা আরও খারাপ করে দিয়েছে। ফলে কৃষক সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।

অনেক অনিচ্ছুক দরিদ্র কৃষকদের উপর বিভিন্নরকম চাপ আসে, যা সহ্য করতে না পেরে অনেক কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ ছাড়া ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় প্রায় প্রতিবছর বহু কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনার কথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শোনা যায়।

শ্রমিক শোষণ: বিশ্বায়নের ফলে ভারত সরকার বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলির জন্য তার বাণিজ্য দ্বার উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে এবং ভারতব্যাপী বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া প্রসারিত হয়েছে। ফলে বর্তমানে বিশ্বের প্রথম সারির শিল্পগুলি এদেশে সস্তা শ্রমিক ও অন্যান্য সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে পণ্য, পরিসেবা জোগান দিচ্ছে। এর ফলে আমরা কম দামে পণ্য, পরিসেবা পেয়েছি, কিন্তু বেসরকারি সংস্থা মাত্রই প্রধান লক্ষ্য মুনাফা অর্জন করা বা অধিক ‘লাভ’-কে সুনিশ্চিত করা। কখনোই শ্রমিক কল্যাণ নয়। ফলে কম পারিশ্রমিকে অধিক কাজ করানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আসলে শ্রমিক শোষণকে দীর্ঘস্থায়ী করছে। বিশ্বায়নের এই কুপ্রভাবটি কখনোই উপেক্ষনীয় নয়।

চাকরির অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের অন্যতম কুফল হল চাকরির অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি। বেসরকারিকরণের ফলে সরকারি ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ হ্রাস পেয়েছে, সাবেকি দেশীয় শিল্পকারখানা থেকে কর্মীছাঁটাই-এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার বেসরকারি, সরকারি নির্বিশেষে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক বা কর্মী নিয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কর্মীছাঁটাই, চুক্তিভিত্তিক কাজ ইত্যাদির ফলে চাকরি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যাবসার ক্ষতিসাধন: ভারত উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু ধীরে ধীরে ভারত অর্থনৈতিক দিক থেকে পৃথিবীর মানচিত্রে উপরের দিকে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের বাজারে যেমন খুচরো বিক্রেতা আছে তেমনি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীও আছে। বরং ভারতের বাজারে খুচরো বিক্রেতারাই বিশালভাবে বিরাজ করছে। ভারত পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় এখানে ক্রেতার সংখ্যা অন্য দেশের তুলনায় বহু গুণ বেশি। ফলে পৃথিবীর বড়ো বড়ো শিল্পগোষ্ঠীরা ভারতের বাজারকে দখল করতে তৎপর। ব্যাবসায়িক গোষ্ঠীগুলি ভারতে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তুলতে অনেক বেশি আগ্রহী। ভারতে বিনিয়োগ করে তারা যে মুনাফা অর্জন করতে পারে, সেই পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে গেলে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে তাদের বিনিয়োগ করতে হয়। এই অবস্থায় দেখা যাচ্ছে বিগত কয়েক দশক ধরে ছোটো ছোটো ব্যাবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি তারা বাজার থেকে হারিয়েও যাচ্ছে।

সাইবার অপরাধ: বিশ্বায়নের মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তির যে অবাধ চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে ও প্রাযুক্তিক অগ্রগতি ঘটেছে তার ফলে সাইবার অপরাধ এবং এর হুমকি অনেক গুণ বেড়ে গেছে। ভারতে সাইবার আক্রমণের ঘটনা, অনলাইন লেনদেনে সাইবার জালিয়াতির ঘটনা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রতিরক্ষা খাতে অত্যধিক ব্যয়: বর্তমানে প্রতিরক্ষাগত ক্ষেত্রে ভারত উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রের আদানপ্রদানে সমর্থ হয়েছে ভারত। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস্ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) প্রদত্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০-২০২৪ বর্ষে ভারত দ্বিতীয় সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। রাশিয়া, ফ্রান্স, ইজরায়েল থেকে ভারত প্রভৃত পরিমাণ সামরিক অস্ত্র আমদানি করছে। তবে ভারতের মতো একটি দারিদ্র্যপিড়ীত দেশ যেখানে ক্ষুধা, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলি দিন দিন উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, সেখানে প্রতিরক্ষা খাতে প্রয়োজন ব্যতীত অত্যধিক ব্যয় করা হচ্ছে। এর ফলে উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলির প্রতি সরকারের মনযোগ কমে যাচ্ছে।

উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, বিশ্ব অর্থনীতির থেকে ভারতীয় অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন রাখা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। তবে এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। যাতে ভারতের স্বার্থের অনুকূলে বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থা ভারত সরকার এখনও গ্রহণ করেনি, সেই বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। সাধারণত ভারত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মিশ্র অর্থনীতি (Mixed Economy)-র ধারাকে অনুসরণ করে, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্র অভিন্ন ছত্রছায়ায় সহাবাস্থান করে।

এই অর্থনৈতিক মডেল সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সুফলগুলিকে একত্রিত করতে চেয়েছিল কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে পুঁজিবাদের অবাধ প্রবেশ মিশ্র অর্থনীতিকে সফল হতে দেয়নি। তবে একথা বলা যায়, প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় প্রথমদিকে নাগরিকদের বিদেশি পণ্যের চাহিদা থাকলেও, কোভিড অতিমারির পরবর্তী পর্বে সাধারণ নাগরিকদের ভোগব্যয় কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন প্রশ্ন উত্তর

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment