স্বাধীনতা উত্তর ভারত প্রশ্ন উত্তর (ষষ্ঠ অধ্যায়) | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার ইতিহাস | HS 4th Semester History Long Question answer 6th Chapter

১। ভারতীয় সংবিধানে কীভাবে আর্থসামাজিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি সুরক্ষিত হয়েছে?
ভারতবর্ষের সমস্ত নাগরিকদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার দ্বারা বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা এবং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রগঠনের উদ্দেশ্যে সংবিধানের মৌলিক অধিকারসমূহ ও নির্দেশমূলক নীতিগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়।
আর্থসামাজিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত নীতিসমূহ:
মূলত যে নীতিগুলির মাধ্যমে ভারতীয়দের আর্থসামাজিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি সুরক্ষিত হয়েছে, সেগুলি আলোচনা করা হল-
(i) জনগণের মঙ্গলসাধনের জন্য রাষ্ট্র এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে যেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে (৩৮(১) নং ধারা) এবং যেখানে অর্থনৈতিক সামাজিক মর্যাদা ও সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রে কোনোরকম বৈষম্য থাকবে না [৩৮(২) নং ধারা)]।
(ii) রাষ্ট্র এমনভাবে তার নীতিগুলিকে পরিচালনা করবে যাতে- [৩৯ নং ধারা]
- স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিক পর্যাপ্ত জীবিকা অর্জনের অধিকার ভোগ করতে পারে।
- দেশের সম্পদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সর্বসাধারণের কল্যাণে বণ্টিত হয়।
- সম্পদের উৎসগুলি যাতে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয় এবং সর্বসাধারণের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়।
- একই কাজের জন্য নারী-পুরুষ উভয়ই সমান মজুরি পায়।
(iii) রাষ্ট্র নাগরিকদের কাজের ও শিক্ষার অধিকার প্রদান করবে এবং বেকার, বার্ধক্য ও অসুস্থ অবস্থায় সাধ্যমতো সাহায্য করবে [৪১ নং ধারা) ইত্যাদি।
উন্নয়নমূলক ব্যবস্থাদি :
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন: সংবিধানের ৪৬ নং ধারায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের শিক্ষাগত ও সামাজিক মান উন্নয়ন এবং বৈষম্য ও শোষণমুক্তির কথা বলা হয়েছে। গঠিত হয়েছে আদিবাসী উপদেষ্টা পর্ষদ (Tribal Advisory Council)। এই পর্ষদের উদ্দেশ্য হল- প্রান্তিক ও উপজাতিদের শিক্ষা, চাকুরি, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নতি এবং বিকাশ, প্রশাসনিক পদে সংরক্ষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।
সংবিধানের ষোড়শ অংশে (Part-XVI) কতিপয় শ্রেণির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা-র কথা বলা হয়েছে। ৩৩০-৩৪২ নং ধারায় পশ্চাৎপদ শ্রেণির জন্য উন্নয়নমূলক বিশেষ ব্যবস্থার উল্লেখ আছে। তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য-
- জনসংখ্যার অনুপাতে আইনসভাগুলিতে আসন সংরক্ষিত থাকবে। তপশিলিভুক্ত মানুষেরা সংরক্ষিত আসনের বাইরে অসংরক্ষিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পাবেন।
- এঁদের জন্য কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষিত থাকবে। তপশিলিদের জন্য পদ সংরক্ষণ বিষয়ে কেন্দ্র যেসকল ব্যবস্থা নেবে, সাধারণভাবে রাজ্যগুলি তা অনুসরণ করবে।
- অনুন্নত শ্রেণির জন্য সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন সংরক্ষিত থাকবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বয়সের ঊর্ধ্বসীমার ক্ষেত্রে এঁরা বিশেষ সুবিধা পাবেন ইত্যাদি।
জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ: ভারতীয় সংবিধানের ১৭ নং ধারায় অস্পৃশ্যতা বিলোপের কথা বলা হয়েছে। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত The Untouchability (Offences) Act-এর মাধ্যমে অস্পৃশ্যতাকে দন্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
গ্রামের উন্নয়ন: গ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত হয় দুধরনের কর্মসূচি, যথা- সমষ্টি উন্নয়ন কর্মসূচি (১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর) এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থা (১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর)। গ্রামীণ কৃষি, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি প্রায় সবকিছুই ছিল সমষ্টি উন্নয়ন কর্মসূচির অন্তর্গত। জওহরলাল নেহরু এই কর্মসূচিকে মহান বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন। তবে এই সমষ্টি উন্নয়ন কর্মসূচির কিছু ত্রুটি ছিল। সেই ত্রুটিগুলিকে সংশোধন করে পরবর্তীতে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রবর্তিত হয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা।
২। ভারতীয় সংবিধানে কীভাবে নারী অধিকার বিষয়টি সুরক্ষিত করা হয়েছে?
ভারতীয় সংবিধানে নারী অধিকার: নারী অধিকার বলতে বোঝায় সকল বয়সের নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য একধরনের স্বাধীনতা। পিতৃতান্ত্রিকতা থেকে ভারতীয় সমাজ তথা নারীদের রক্ষা করার জন্য ভারতীয় সংবিধানে একাধিক ব্যবস্থার বিধান আছে। এক্ষেত্রে পুরুষদের মতো মহিলাদেরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই সকল অধিকারগুলি লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে এবং সমাজে নারীদের সুযোগসুবিধা ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
সামাজিক ক্ষেত্রে অধিকার:
- সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে ১২ থেকে ৩৫ নং ধারায় মৌলিক অধিকারসমূহের উল্লেখ রয়েছে।
- মহিলাদের বিশেষ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ আইন প্রণয়নের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
- নারীর সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ও ক্ষমতায়নের উপযোগী বিভিন্ন আইনগুলি হল-
(a) বিবাহব্যবস্থা সংক্রান্ত আইনসমূহ: বিধবা বিবাহ আইন (Widow Remarriage Act, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ); বিশেষ বিবাহ আইন (Special Marriage Act, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ); হিন্দু বিবাহ আইন (Hindu Marriage Act, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ) ইত্যাদি। এই আইনসমূহ বিবাহের বয়স, বহুবিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, খোরপোশের অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে মহিলাদের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করে।
(b) দত্তকগ্রহণ সংক্রান্ত আইন: হিন্দু দত্তক ও ভরণপোষণ আইন (Hindu Adoptation and Maintenance Act, ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ) দ্বারা বিধবা মহিলা, অবিবাহিত মহিলা এবং বিবাহ বিচ্ছিন্নাদের শিশু দত্তক গ্রহণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে দত্তক হিসেবে যাকে গ্রহণ করা হবে তার বয়স হতে হবে ১৫ বছরের নীচে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অধিকার:
মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে একাধিক আইন প্রণয়ন করে সংবিধানের উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। আর্থনীতিক স্বার্থ ও আর্থনীতিক আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলি হল-সম্পত্তির অধিকার, উত্তরাধিকার, সমমজুরি, চাকুরির নিরাপত্তা, মাতৃ কল্যাণমূলক সুযোগসুবিধা, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি।
(a) সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার: হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ) দ্বারা সম্পত্তিতে মহিলাদের অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। পিতার সম্পত্তিতে পুত্রের সঙ্গে সঙ্গে কন্যাকেও দেওয়া হয়েছে সমান অধিকার। বিবাহিতা এবং বিধবা কন্যাও এই অধিকারের যোগ্য।
(b) কারখানায় নারী শ্রমিকের সুযোগসুবিধা: ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত হয় কারখানা আইন। এতে মহিলাদের চাকুরির নিরাপত্তা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ইত্যাদির বিধান আছে।
(c) সমমজুরির অধিকার: ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের সমমজুরি আইন দ্বারা মহিলারা একই কাজের জন্য পুরুষদের সমান বেতন পাওয়ার অধিকারী বলে দাবি করা হয়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অধিকার: ভারতীয় সংবিধানে নারীজাতির রাজনৈতিক অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক অধিকার হল- নারীর ভোটাধিকার এবং আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের অধিকার। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে মহিলাদের ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার স্বীকার করা হয়। স্বাধীন ভারতের সংবিধানের আদর্শ অনুসারে জাতি, ধর্ম, ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেওয়া হয়। বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত স্তর থেকে সংসদ পর্যন্ত সকল পরিষদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত আসনের বাইরেও মহিলারা প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার পান।
৩। স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পরে ভারতের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি কী কী ছিল?
অথবা, স্বাধীনতালাভের মুহূর্তে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা কেমন ছিল?
স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পরে ভারতের অর্থনৈতিক সমস্যা:
প্রায় ২০০ বছরব্যাপী ঔপনিবেশিক শাসনের পর একটি খণ্ডিত, বিবাদপূর্ণ দেশ হিসেবে ভারত স্বাধীনতা পায়। সেই মুহূর্তে ভারতের অর্থনীতি ছিল ঔপনিবেশিক শোষণে জর্জরিত, সম্পূর্ণ দুর্বল, মেরুদন্ডহীন একটি ব্যবস্থা। সীমাহীন এবং অবাধ শোষণে কৃষি-অর্থনীতি ছিল গতিহীন এবং দুর্বল। এই সময় ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দেয়, যথা-
(i) উদ্দ্বাস্তু ও পুনর্বাসন সমস্যা: দেশভাগের পরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহুসংখ্যক হিন্দু ও শিখ মানুষজন এদেশে চলে আসেন। এই বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর আগমন ও পুনর্বাসনের সমস্যা নবগঠিত রাষ্ট্রের কাছে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হয়।
(ii) দারিদ্র্য সমস্যা: ইংরেজরা ভারতবর্ষ ত্যাগের সময় দেশ প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হয়। দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান করতে ভারত সরকারকে নানা পদক্ষেপ নিতে হয়। > খাদ্য সংকট: দেশভাগের দরুন বিপুল পরিমাণ কৃষি এলাকা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে দেশে প্রবল খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং এই খাদ্যসমস্যাকে জটিলতর করে তোলে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর আগমন। iv> বেকার সমস্যয়: স্বাধীনোত্তর পর্বের এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল সীমাহীন বেকারত্ব। দেশভাগ হওয়ার পর কৃষিভিত্তিক ও খাদ্য উৎপাদনের এলাকাগুলি মূলত পাকিস্তানে এবং শিল্পভিত্তিক ভূখণ্ডগুলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে কাঁচামালের (পাট, গম, তুলা ইত্যাদি) অভাবে ভারতের কলকারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পে মন্দা দেখা দেয়। দেশভাগ ও বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমনে বেকার সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
(c) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি: স্বাধীনোত্তর ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সমস্যা হল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। কাপড়, কেরোসিন এবং ওষুধপত্র দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য হয়ে ওঠে।
উপরোক্ত এই সমস্ত অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য ভারত সরকার ১৯৫০-এর দশকে এক বিশেষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনা মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশের কাজে সকল শ্রেণির মানুষকে নিয়োগের সুযোগ দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা।
৪। টীকা লেখো: নেহরু-মহলানবিশ মডেল।
অথবা, দ্বিতীয় পণ্যবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভূমিকা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
নেহরু মহলানবিশ মডেল / দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এর ভূমিকা:
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি মডেল বা রূপরেখা প্রণয়ন করেন (১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ)। কিছু সংশোধনী-সহ পণ্ডিত নেহরু সেই রূপরেখাটি গ্রহণ করেন। তাই এটি নেহরু-মহলানবিশ মডেল নামে খ্যাত। এই মডেলই ছিল দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূলভিত্তি।
বৈশিষ্ট্য: নেহর-মহলানবিশ মডেলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যথা-
(i) ভারী ও মূলধনি শিল্পে গুরুত্ব আরোপ: এই পরিকল্পনাটিতে ভারী ও মূলধনি শিল্পের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকার ভারতে নিজস্ব প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি, ইস্পাত ইত্যাদি উৎপাদনের উপর উপর জোর দেয়, যা ভবিষ্যতে নতুন শিল্পের প্রসারে সহায়তা করবে। এসময় বৈদেশিক সাহায্যে ভারতবর্ষে কয়েকটি আধুনিক ইস্পাত-শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে। তার মধ্যে রাশিয়ার সাহায্যে ভিলাই স্টিল প্ল্যান্ট, ইংল্যান্ডের সহায়তায় দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট এবং পশ্চিম জার্মানির সহায়তায় রৌরকেল্লা স্টিল প্ল্যান্ট অন্যতম।
(ii) নদীবাঁধ নির্মাণ ও জলসেচের উন্নতি: দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নদীবাঁধ নির্মাণ ও জলসেচের উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ হয়। উত্তর ভারতে কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধ পরিকল্পনা রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জলসেচের পরিকল্পনা সফল করে। ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে দামোদর সেচ প্রকল্প, ময়ূরাক্ষী ও কংসাবতী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় এই পরিকল্পনার মাধ্যমে।
(iii) পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসাধন: দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে অন্যতম অন্তরায় ছিল উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। সেই উদ্দেশ্যে এই খাতেও ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ করা হয়। জাতীয় রাজপথগুলির উন্নতিসাধন এবং তার সঙ্গো সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
(iv) শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ: এই পরিকল্পনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, চিকিৎসা পরিসেবা ইত্যাদি বৃদ্ধির জন্য স্থাপিত হয় বহু সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি-র অধীনে গড়ে ওঠে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন।
তবে, নেহরু-মহলানবিশ মডেল পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত ছিল না। এই পরিকল্পনায় ভারী শিল্প বেশি গুরুত্ব পায়। কৃষি, কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্রশিল্প তুলনামূলকভাবে অবহেলিত থেকে যায়। তবে এই পরিকল্পনার মাধ্যমে সুতি বস্ত্রশিল্প, পাটশিল্প এবং গ্রামীণ কুটিরশিল্পের উন্নয়ন, সহযোগিতা ও সমন্বয় স্থাপনের জন্য সর্বভারতীয় শিল্পপর্ষদ গঠন করা হয়েছিল। তাই একথা বলাই যায় যে, ভারতের শিল্পায়নে ভিত্তি স্থাপনকারী হিসেবে এই মডেলটির এবং সেইসঙ্গে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৪। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা কীরূপ ছিল?
অথবা, ভারতের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মূল্যায়ন করো।
অথবা, ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতির সাফলা ও বার্থতা আলোচনা করো।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়ন:
স্বাধীন ভারতের বিদেশনীতির অন্যতম অলা হল জোটনিরপেক্ষ নীতি (Policy of Non-Alignment)। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভারত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সাফল্য:
(i) কোরিয়ার যুদ্ধে ভূমিকা: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধসংক্রান্ত যে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল তার সমাধানে ভারতের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এসময় রাশিয়া ও আমেরিকা কোরিয়ার যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে কোনও পক্ষ ভারতকে গুরুত্ব না দিলেও পরে তারা যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে ভারতের উদ্যোগকে স্বাগত জানায়।
(ii) ভিয়েতনাম যুদ্ধে ভূমিকা : ইন্দোচিন বা ভিয়েতনামে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারত স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করেছে। তাছাড়া ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধানে তথা এই উদ্দেশ্যে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত জেনেভা সম্মেলনেও ভারতের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক।
(iii) চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ লাভে সমর্থন: ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে চিনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর মার্কিন জোট প্রজাতন্ত্রী চিনকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়নি। বিবাদ সত্ত্বেও ভারত চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্য করার পক্ষে সওয়াল করে।
ব্যর্থতা:
(i) ভারত-চিন সম্পর্ক: ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতি চিন ও ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতের ধর্মগুরু দলাই লামা-কে ভারতের আশ্রয়দান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের প্রভাববিস্তারের পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর চিন ভারত আক্রমণ করে এবং পরে নিজেরাই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে।
(ii) ভারত-পাকিস্তান বিরোধ: ভারত তার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে সদা আগ্রহী হলেও উভয় দেশের মধ্যে চূড়ান্ত মতবিরোধ আজও বর্তমান। কাশ্মীর সমস্যা, ভারত-পাক আন্তর্জাতিক সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ প্রভৃতি বিষয় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে তিক্ত করে তোলে। বর্তমানেও এই সমস্যা এবং তিক্ততা সমানভাবে লক্ষণীয়। তাই বলা যায়, এই বিষয়টির সমাধানে জোটনিরপেক্ষ নীতি তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
তবে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে, ভারতের নেতৃত্বে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্বরাজনীতিতে নতুন পথের দিশা দেখায়। বস্তুত, এই নীতির মাধ্যমে ভারত সর্বদা সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।
৫। বিশ্বশান্তি রক্ষার প্রচেষ্টায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অবদান মূল্যায়ন করো।
অথবা, জোটনিরপেক্ষ/নির্জোট আন্দোলনের মূল্যায়ন করো।
বিশ্বশান্তি রক্ষার প্রচেষ্টায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অবদান / নির্জোট আন্দোলনের মূল্যায়ন: ১৯৬০-এর দশকের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারত তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করে। বিশ্বশান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে নির্জোট আন্দোলনের অবদান নিম্নরূপ-
(i) উপনিবেশবাদের অবসান: উপনিবেশবাদের অবসানে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এ ছাড়া এশিয়া-আফ্রিকার জাতীয় আন্দোলনের সাফল্য, জাতিপুঞ্জের অভ্যন্তরে নিরন্তর চাপ সৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।
(ii) অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি: জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি অস্ত্র প্রতিযোগিতার কুফল ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে চলেছে। বস্তুত, জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি প্রথম থেকেই সর্বাত্মক নিরস্ত্রীকরণের দাবিতে সোচ্চার থেকেছে।
(iii) দ্বিমেরুকেন্দ্রিকতার অবসান: জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে দ্বিমেরুকেন্দ্রিকতার অবসান ঘটাতে সাহায্য করেছে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ। আকারে ছোটো হলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের একসূত্রে গড়ে ওঠা যৌথ প্রতিবাদকে আমেরিকা বা রাশিয়া-কোনও রাষ্ট্রই অগ্রাহ্য করতে পারেনি।
(iv) বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদ: জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি বর্ণবৈষম্য প্রথার তীব্র বিরোধী ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ বিভিন্ন দেশের বর্ণবিদ্বেষী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মানবাধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(v) জাতিপুঞ্জে চাপসৃষ্টিকারী একক হিসেবে ভূমিকা: জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি জাতিপুঞ্জে একটি চাপসৃষ্টিকারী একক হিসেবে কাজ করেছে। New International Economic Order, United Nations Development Programme প্রভৃতি উন্নয়নমূলক কর্মসূচি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহের চাপেই গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।
মূল্যায়ন: জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্বরাজনীতিতে এক নতুন পথের সন্ধান দেয়। কিন্তু সদস্য রাষ্ট্রগুলির স্বার্থ, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং প্রতিষ্ঠানিক ত্রুটি সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। তবে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
৬। অর্থনৈতিক উদারীকরণ বলতে কী বোঝো ? এর বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, ১৯৯০-এর দশকের অর্থনৈতিক সংস্কার বলতে কী বোঝো?
অর্থনৈতিক উদারীকরণের ধারণা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঠান্ডা বৃদ্ধের আবহাওয়া সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছিল। মর্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে। হারই ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। বিশ্ব অর্থব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে দেশগুলি নিজেদের অর্থনীতিকে পরিচালিত করতে সচেষ্ট হয়। এই নতুন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উদারীকরণ (Economic Liberalisation) নামে পরিচিত। বস্তুত, এটি হল অবাধ, উন্মুক্ত ও জটিলতাহীন একধরনের গতিশীল অর্থনৈতিক কর্মসূচি।
ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণ: ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রবল অর্থনৈতিক সংকট নিয়ন্ত্রণের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. পি ভি নরসিমহা রাও-এর নেতৃত্বে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ভারতে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করেন।
নতুন এই আর্থিক নীতির মাধ্যমে ভারত সরকার নীতিগতভাবে সংরক্ষণমুক্ত অবাধ বাণিজ্যনীতি, বৈদেশিক মূলধন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করে বিশ্বায়নের ধারণাকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের পথ খুলে দেয়। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদি অর্থব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রকে এই উদার অর্থনীতি বা উদারীকরণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অর্থনৈতিক উদারীকরণের বৈশিষ্ট্য: উদার অর্থনীতি হল মূলত বাজারের শক্তির (চাহিদা + জোগান) উপর নির্ভরশীল একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। উদারীকরণের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল-
- আমদানি- রফতানির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা। এজন্য শুল্ক সংরক্ষণ নীতি বর্জন করে বাণিজ্যিক লেনদেন অবাধ করে দেওয়া হয়।
- শিল্পবাণিজ্যে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সীমা বাতিল করা হয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার বা তৃতীয় পক্ষের শর্ত আরোপ নিষিদ্ধ হয়।
- রাষ্ট্র পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারি করার উপর জোর দেওয়া হয়।
- বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষতা, উৎপাদন ক্ষমতা এবং গুণমান বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করা হয়।
- লাইসেন্স প্রথার সরলীকরণ দ্বারা ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগসমূহকে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশীদার করার ব্যবস্থা-সহ নানাবিধ উদ্যোগ গৃহীত হয়।
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর