ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার ইতিহাস

সূচিপত্র

ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার ইতিহাস | HS 4th Semester History Long Question answer 4th Chapter

ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর
ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর

১। মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসনসংস্কারের (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) বৈশিষ্ট্য এবং ত্রুটিগুলি সম্পর্কে লেখো।

মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসনসংস্কারের বৈশিষ্ট্যসমূহ:

(ⅰ) কেন্দ্রীয় আইনসভার গঠন ও তার সদস্যসংখ্যা : এই আইনে কেন্দ্রে দুইকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়, যথা-উচ্চকক্ষ বা রাষ্ট্রীয় পরিষদ (Council of State) এবং নিম্নকক্ষ বা কেন্দ্রীয় আইনসভা (Central Legislative Assembly)। উচ্চকক্ষের সদস্যসংখ্যা ৬০ জন এবং নিম্নকক্ষের সদস্যসংখ্যা ১৪৫ জন।

(ii) প্রদেশের শাসনব্যবস্থা: প্রাদেশিক সরকারের দ্বারা অধিকৃত বিষয়গুলিকে সংরক্ষিত (Reserved) ও হস্তান্তরিত (Transferred) – এই দুভাগে ভাগ করা হয়। সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ, অর্থ, বিচার -এগুলি সংরক্ষিত বিষয় এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি হস্তান্তরিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ছাড়া পৌরসভা, ইউনিয়ন বোর্ড গড়ে তুলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাও চালু করা হয়। আপন

(iii) ভারত-সচিবের কাউন্সিল : ভারত-সচিবের কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা ৮ থেকে ১২-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয় এবং তাদের কার্যকালের মেয়াদ ছিল ৫ বছর। এতদিন পর্যন্ত সদস্যদের বেতনের ব্যয়ভার ভারতীয় রাজস্ব থেকেই মেটানো হত। কিন্তু এই নতুন আইনে স্থির হয়, এই বেতনভার বহন করবে ব্রিটিশ সরকার -যা ছিল মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসনসংস্কারের ত্রুটিসমূহ:

মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসনসংস্কারে দায়িত্বশীল সরকার গঠনের কোনও প্রচেষ্টাই পরিলক্ষিত হয়নি। এই আইনের ত্রুটিগুলি হল-

(i) সরকারি নিয়ন্ত্রণ: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রে বড়োলাট প্রভৃত ক্ষমতার অধিকারী হন। ভারতীয় আইনসভার কাছে তাঁর কোনও দায়বদ্ধতা ছিল না। একইভাবে প্রদেশগুলিতে ছোটোলাট অনুরূপ ক্ষমতা লাভকরেন। কেন্দ্র ও প্রদেশে সরকার পক্ষেরই সংখ্যাধিক্য বজায় থাকে।

(ii) দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সূচনা: প্রাদেশিক শাসনকার্য সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত- এই দুটি ভাগে ভাগ করে একদিকে ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং অন্যদিকে দায়িত্বহীন ক্ষমতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর ফলে শাসনকাঠামোর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে ও দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়।

(iii) সীমিত ভোটাধিকার ও পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন দ্বারা কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় বিত্তবান ভারতীয়রাই ভোটাধিকার লাভ করেছিলেন। আবার মর্লে-মিন্টো আইনে যে সাম্প্রদায়িক নির্বাচন পদ্ধতি গৃহীত হয়েছিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনেও তা বজায় থাকে। এর ফলে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঐক্য ক্ষুণ্ণ হয়। তাই বলা যায়, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের আইন ভারতবাসীর আশাপূরণে ব্যর্থ হয়েছিল।

(iv) সীমিত অর্থ বরাদ্দ: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের আইনে জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য খুবই সীমিত অর্থ ধার্য করা হয়। সীমিত অর্থে জনকল্যাণের মতো বিশাল কর্মপরিচালনা করা কখনোই সম্ভবপর ছিল না।

পরিশেষে বলা যায়, মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে কিছু ভালো দিক থাকা সত্ত্বেও তা সমস্ত শ্রেণির ভারতবাসীকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। স্বয়ং লোকমান্য তিলক এই প্রস্তাবকে বিবেচনার অযোগ্য বলে দাবি করেছেন। জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে (১৯১৮ খ্রি.) মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনকে তুচ্ছ, বিরক্তিকর ও নৈরাশ্যজনক বলে সমালোচনা করা হয়। অ্যানি বেসান্ত আবার এই আইনকে দাসত্বের পরিকল্পনা বলে অভিহিত করেন। তবে কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃবৃন্দের একাংশের কাছে এই আইন ছিল স্বাধিকার অর্জনের পথে এক নব পদক্ষেপ।

২। সত্যাগ্রহ আদর্শ বলতে কী বোঝো?

দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধিজি বর্নবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এক অভিনব কৌশল বা কর্মদর্শন গড়ে তোলেন, যা ইতিহাসে সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত।

সত্যাগ্রহ আদর্শ: বিশিষ্ট বুশ লেখক লিও টলস্টয়ের Kingdom of God is Within You, ব্রিটিশ লেখক জন রাসকিন রচিত Unto This Last, হেনরি ডেভিড থরোর Civil Disobedience, এডুইন আর্নল্ডের The Light of Asia (বুদ্ধের জীবনী)-সহ বিভিন্ন চিন্তাবিদদের রচনা ও নানা ধর্মদর্শন থেকে গান্ধিজি তাঁর সত্যাগ্রহ আদর্শ রূপায়ণের প্রেরণা পেয়েছিলেন।

ধারণা: মহাত্মা গান্ধির দৃষ্টিতে সত্য হল ইতিবাচক গুণসম্পন্ন এমন একটি শক্তি যা নেতিবাচক উপাদানের বিপরীতে অবস্থান করে। তাঁর কাছে সত্য হল আত্মশক্তি, নির্ভীকতা, নিঃস্বার্থপরতা, সম্প্রীতি, ভালোবাসা ইত্যাদির প্রতীক। অন্যদিকে অসত্য হল পাশবিকতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা ও পরাধীনতার প্রতীক। নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গান্ধিজি এই সত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন সত্য দিয়ে তিনি অসত্য-কে জয় করতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, গান্ধিজির কাছে অহিংসার ধারণা বহুক্ষেত্রেই সত্য ধারণার সমার্থক বা পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

সহজ ভাষায় বললে, অহিংস উপায়ে আত্মকষ্টের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে জয় করাই হল সত্যাগ্রহ। মহাত্মা গান্ধির মতে, সত্যের প্রতি যে ব্যক্তির কোনও ঘৃণা বা বিদ্বেষ নেই সেই প্রকৃত সত্যাগ্রহী।

রাজনীতিতে প্রয়োগ: রাজনীতিতে সত্যাগ্রহ আদর্শের প্রয়োগ তথা সাফল্যের বিষয়টি বেশ কঠিন বলে গান্ধিজি মনে করতেন। এই সত্যাগ্রহের প্রয়োগ সম্পর্কিত তিনি কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করেন-

  • গান্ধিজির মতে, সত্যাগ্রহ হল আত্মার শক্তি বা প্রেমের শক্তি। এর উৎস হল সত্য ও অহিংসা।
  • তিনি বলতেন, অহিংসা কাপুরুষের ভূষণ নয়; অহিংসা বীরত্বের মহান প্রকাশ।
  • অহিংসার সঙ্গে সত্যাগ্রহের যোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রতিক্ষেত্রে আঘাত না করে দুঃখবরণ করে নিয়ে সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলেই তিনি মনে করতেন।
  • অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় একজন সত্যাগ্রহীকে সকল রকম দুঃখকষ্ট, নির্যাতন হাসিমুখে সহ্য করতে হবে।
  • হিংসার পথ দুর্বল ও তা কাপুরুষের হাতিয়ার। কিন্তু একজন চরিত্রবান আত্মসংযমী, নৈতিক বলে বলীয়ান ও সাহসী ব্যক্তিই সত্যাগ্রহের পথে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম।
  • গান্ধিজি বলেছেন, প্রেমের দ্বারা ঘৃণাকে, সত্যের দ্বারা অসত্যকে এবং নির্যাতন ভোগের দ্বারা হিংসাকে জয় করাই হল প্রত্যেক সত্যাগ্রহীর আদর্শ।

৩। রাওলাট আইন’ কী? এই আইনে কী বলা হয়েছিল?

রাওলাট আইন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে ভারতবর্ষে চরম অসন্তোষ ও অসহিমুতার পরিবেশ লক্ষ করা যায়। আলোচ্য পর্বে অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা, বৈপ্লবিক তৎপরতা অনুসন্ধান ও তা দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার স্যার সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে (১০ ডিসেম্বর, ১৯১৭খ্রিস্টাব্দ)। এটি রাওলাট কমিটি নামে পরিচিত। সভাপতি রাওলাট ছাড়াও এই কমিটিতে আরও ৫ জন সদস্য ছিলেন। এই রাওলাট কমিটির পোশাকি নাম হল সিডিশন কমিটি।

সিডিশন কমিটির কাজ ছিল- ভারতে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের প্রকৃতি, তার ব্যাপকতা অনুসন্ধান করা। ভারতে বৈপ্লবিক তৎপরতা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনের সুপারিশ করা। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে এই কমিটি তার রিপোর্ট পেশ করে এবং ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় আইনসভায় কমিটির সুপারিশ উত্থাপিত হয়।

রাওলাট আইনের বক্তব্য/ধারাসমূহ:

সিডিশন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ Anarchical and Revolutionary Crimes Act of 1919 (নৈরাজ্য এবং বৈপ্লবিক অপরাধ) নামক দুটি কুখ্যাত আইন বিধিবদ্ধ করা হয়। সাধারণভাবে এগুলিই রাওলাট আইন নামে পরিচিত।

রাওলাট আইনের প্রথম আইনে রাজদ্রোহ মামলার বিচারের জন্য নতুন একটি বিচারালয় গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। এই কোর্ট বা বিচারালয়ের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনও সুযোগ ভারতীয়দের ছিল না।

দ্বিতীয় আইনে ফৌজদারি দণ্ডবিধির পরিবর্তন করা হয় এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হয় বিশেষ ক্ষমতা।

আইন দুটিতে বলা হয় যে-

  • জেলাশাসক ও পুলিশের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন যে-কোনো ব্যক্তিকে বিনা পরওয়ানায় গ্রেফতার এবং বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল কারারুদ্ধ করা ও নির্বাসন দেওয়া যাবে।
  • সরকার যে-কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির বাড়ি বিনা পরওয়ানায় তল্লাশি করতে পারবে।
  • আদালতে বিচারকগণ কোনও জুরির সহায়তা এবং কোনোরকম সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই বিচার সম্পন্ন করতে পারবেন।
  • সরকারবিরোধী সব ধরনের প্রচারকার্য দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোনও সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারবে না। এ ছাড়া বলা হয় রাওলাট আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনীতি, শিক্ষা বা ধর্মসংক্রান্ত কোনও কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, রাজদ্রোহিতা দমনের নামে ভারতবাসীর যে-কোনো রকম উপনিবেশবাদ-বিরোধী আন্দোলন স্তব্ধ করার লক্ষ্যে এই কুখ্যাত আইন প্রণয়ন করা হয়। অমৃতবাজার পত্রিকা তাই রাওলাট আইনকে “a gigantic blunder” (এক ভয়াবহ ভ্রান্তি) বলেছে। প্রতিক্রিয়াশীল ও দমনমূলক রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

৪। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড বলতে কী বোঝায়? 

ব্রিটিশ ভারতের কুখ্যাত ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম হল জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ড। পাঞ্জাবে রাওলাট আইনবিরোধী প্রতিবাদী আন্দোলন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, যা প্রতিহত করতে সরকার চরম দমননীতির আশ্রয় নেয়। এরই পরিণতি ছিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড:

বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম নিন্দাজনক ও নৃশংস ঘটনা হিসেবে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড আজও স্মরনীয়।

পটভূমি: ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন জারি করলে সারা পাঞ্জাব সর্বাধিক প্রভাবিত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে পাঞ্জাব থেকে বলপূর্বক, সেনাসংগ্রহ, গদর পার্টি-র আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিরীহ মানুষদের উপর সরকারের দমনপীড়ন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে গোটা পাঞ্জাবে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এর উপর ছিল পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক মাইকেল ও’ ডায়ার (Michael Francis O’Dwyer)-এর স্বৈরাচারী শাসন। এইরূপ পরিস্থিতিতে ইংরেজ সরকার পাঞ্জাবের দুই স্থানীয় জাতীয়তাবাদী নেতা ড. সত্যপাল ও সৈফুদ্দিন কিচলুকে ১০ এপ্রিল গ্রেফতার ও অন্তরিন করলে জনগণ অসন্তুষ্ট হয় ও বিক্ষোভ দেখায়। অপরদিকে ব্রিটিশ সরকার জনসাধারণের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার করে এই বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করে।

১৩ এপ্রিল: হত্যাকান্ডের সূচনা ও নির্মমতা:

জালিয়ানওয়ালাবাগ হল পাঞ্জাবের অমৃতসরে অবস্থিত একটি উদ্যান। চারিদিকে বড়ো বড়ো অট্টালিকা ও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই উদ্যানটির প্রবেশপথ ছিল বেশ চওড়া। কিন্তু প্রস্থান পথ ছিল ৪টি ও সেগুলি ছিল খুব সংকীর্ণ।

গান্ধিজি-সহ পাঞ্জাবের নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩ এপ্রিল বৈশাখীর দিনে অমৃতসরের অসংখ্য মানুষ (প্রায় ১০ হাজার) শান্তিপূর্ণভাবেই জালিয়ানওয়ালাবাগে এক সমাবেশে একত্রিত হন। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বৈশাখী উৎসবে যোগ দিতে আসা গ্রামীণ নারী, বয়স্ক মানুষ ও শিশু। সভা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই জেনারেল ডায়ার (Reginald Dyer) সেখানে হাজির হয়ে কোনোরূপ প্ররোচনা ছাড়াই কিংবা সভায় উপস্থিত মানুষজনকে সতর্ক না করেই এই নিরস্ত্র শিশু-নারী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু উদ্যানের চারিদিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকায় মাঠ থেকে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করার কোনও সুযোগই ছিল না নিরস্ত্র অসহায় মানুষগুলির। সেনাবাহিনীর ৫০টি রাইফেল থেকে নির্গত ১৬৫০ রাউন্ড গুলিতে কিছু মিনিটের মধ্যেই ঝাঁঝরা হয়ে যায় অসংখ্য মানুষের দেহ। চারিদিকে হাজার হাজার মানুষ দিশাহীনভাবে ছুটতে থাকেন। অনেকে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় ঝাঁপ দেন পাতকুয়োতে। অনেকে পদপিষ্ট হয়েই মারা যান।

সরকারি মতে, জালিয়ানওয়ালাবাগে সেদিন মারা গিয়েছিলেন ৩৭৯ জন এবং ১২০০ জন = আহত হয়েছিলেন। কিন্তু বেসরকারি মতে, এই সংখ্যা ছিল দ্বিগুণেরও বেশি।

ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া:

এই অমানবিক ও নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এহেন বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ ব্রিটিশদের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে গান্ধিজি তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন, ‘এই শয়তান সরকারের সংশোধন করা যাবে না, একে ধ্বংস করা প্রয়োজন।’

৫। অসহযোগ আন্দোলন কেন প্রত্যাহার করা হয়? অথবা, গান্ধিজি কেন অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন?

অথবা, ‘চৌরিচৌরা-র ঘটনা কী?

অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের কারণ:

মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে অহিংস আদর্শের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত প্রথম গণ আন্দোলন ছিল অসহযোগ আন্দোলন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে গান্ধিজি এই আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।

চৌরিচৌরার ঘটনা: অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরাতে এক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে (৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ)। পুলিশ সত্যাগ্রহী নেতা ভগবান আহীরকে গ্রেফতার করলে স্বেচ্ছাসেবীরা থানা ঘেরাও করেন। পুলিশ অকস্মাৎ জনতার উপর গুলি চালায়। ক্ষিপ্ত জনতা থানায় অগ্নিসংযোগ করলে ২২ জন পুলিশের মৃত্যু হয়। এটিই চৌরিচৌরার ঘটনা নামে পরিচিত। জনতার হিংসাত্মক আচরণে মর্মাহত হয়ে গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। বারদৌলিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় (১২ ফেব্রুয়ারি) গান্ধিজির সিদ্ধান্ত অনুমোদিতও হয়।শা দিলেচষ্টা

আন্দোলন প্রত্যাহার বিষয়ে গান্ধিজির মুক্তি:

অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পিছনে মহাত্মা গান্ধির নিজস্ব কিছু যুক্তি ছিল। সেগুলি হল-

(i) হিংসার প্রবেশ: গান্ধিজির আন্দোলনের নীতি ছিল অহিংস। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বেশকিছু স্থানে সেই নীতি মেনে চলা হয়নি। গান্ধিজির ভাষায়, ‘তখন যদি একে বন্ধ না করা হত তাহলে অহিংস আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা হিংসাত্মক আন্দোলনেরই দায়িত্ব নিয়ে ফেলতাম।’

(ii) জনগণের ধৈর্যচ্যুতি : আন্দোলনের ফলে স্কুলকলেজ বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন। সরকারি চাকুরি ও অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন।

(iii) দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও বস্ত্রের জনপ্রিয়তা হ্রাস:

অসহযোগ আন্দোলনের ফলে গড়ে ওঠা জাতীয় বিদ্যালয় ও দেশীয় কাপড়ের জনপ্রিয়তা কমে আসছিল।

এইসব কারণের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। এরপর ১০ মার্চ ব্রিটিশ সরকার গান্ধিজিকে কারারুদ্ধ করে।

৬। স্বরাজ্য দলের উদ্ভবের পটভূমি লেখো।

অথবা, কারা, কবে, কী উদ্দেশ্যে স্বরাজ্য দল গঠন করে?

স্বরাজ্য দল গঠনের পটভূমি/কারণ :

স্বরাজ্য দল প্রতিষ্ঠার পটভূমি বা কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হল-

(i) জাতীয় রাজনীতিতে সংকট: বারদৌলিতে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত এবং ভাইসরয় লর্ড রিডিং-এর কঠোর দমননীতি তৎকালীন জাতীয় রাজনীতিতে সংকট সৃষ্টি করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের অনেকের মনেই গান্ধিজির কৌশলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। তাছাড়া ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে গান্ধিজি গ্রেফতার হওয়ায় জাতীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মোতিলাল নেহরু প্রমুখ নেতৃবর্গ নতুনভাবে জাতীয় আন্দোলন পরিচালনা করার চেষ্টা করেন।

(ii) কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব: জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাশ, মোতিলাল নেহরু প্রমুখ মনে করতেন, Legislative Council তথা আইন বা ব্যবস্থাপক সভায় কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করা উচিত। তাই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্থির হয় যে, ডিসেম্বর মাসে আসন্ন গয়া অধিবেশনে পরবর্তী নীতি নির্ধারিত হবে। বস্তুত, নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের মধ্যে দুটি গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়- পরিবর্তনের সমর্থক বা পরিবর্তনপন্থী (Pro-Changer) এবং পরিবর্তন-বিরোধী (No-Changer)। হাকিম আজমল খান, বিঠলভাই প্যাটেল, মদনমোহন মালব্য প্রমুখ পরিবর্তনের সমর্থক নেতারা আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মতকে সমর্থন করেন।

অন্যদিকে, পরিবর্তন-বিরোধী গোষ্ঠী অর্থাৎ রাজেন্দ্র প্রসাদ, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী প্রমুখ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আইনসভায় প্রবেশের পক্ষপাতী ছিলেন না।

(iii) কংগ্রেসের গয়া অধিবেশন: কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে (ডিসেম্বর, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ) সভাপতিত্ব করেন চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সম্পাদক হন মোতিলাল নেহরু। কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে গয়ায় ভোটাভুটি হলে Pro-Changer-রা পরাজিত হন (পক্ষে ৮৯০টি এবং বিপক্ষে ১৭৪৮/১৭৪০টি ভোট) এবং প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। মর্মাহত হয়ে দেশবন্ধু ও মোতিলাল নেহরু নিজ নিজ পদে ইস্তফা দেন।

স্বরাজ্য বা স্বরাজ দল গঠন: এরপর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি মোতিলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখের সাহায্যে চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই একটি দল গঠন করেন। এই দলের নাম হয় কংগ্রেস খিলাফৎ স্বরাজ পার্টি বা সংক্ষেপে স্বরাজ বা স্বরাজ্য দল। এই নবপ্রতিষ্ঠিত দলের। সভাপতি হন চিত্তরঞ্জন দাশ এবং মোতিলাল নেহরু অন্যতম সম্পাদক পদে বসেন।

৭। মহম্মদ আলি জিন্নাহ-র ‘চোদ্দো দফা দাবি বলতে কী বোঝায়?

মহম্মদ আলি জিন্নাহ-র উত্থাপিত চোদ্দো দফা দাবি সমূহ:

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত-সচিব লর্ড বার্কেনহেড-এর বক্তব্য ও সর্বদলীয় সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতের সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয় একটি কমিটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন মোতিলাল নেহরু। এই কমিটির অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বরা ছিলেন- সুভাষচন্দ্র বসু, আলি ইমাম, সর্দার মঙ্গল সিং, তেজবাহাদুর সপু, এম আর জয়াকার প্রমুখ। এরপর সর্বদলীয় সম্মেলনের লখনউ অধিবেশনে (আগস্ট, ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ) মোতিলাল নেহরু ভারতীয় সংবিধানের একটি খসড়া পেশ করেন, যা পরিচিত নেহরু রিপোর্ট নামে। ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে মহম্মদ আলি জিন্নাহ উক্ত রিপোর্টের তিনটি সংশোধনী দাবি করলে তা নাকচ হয়ে যায়। এর পরবর্তীকালে জিন্নাহ আগা খানের নেতৃত্বে ‘নিখিল ভারত মুসলিম সম্মেলন’-এ যোগ দেন। ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের সম্মেলনে সভাপতি মহম্মদ আলি জিন্নাহ পেশ করেন তাঁর বিখ্যাত চোদ্দো দফা দাবি। এই দাবিগুলি হল-

  1. ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। অবশিষ্ট ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে।
  2. সমস্ত আইনসভা ও স্থানীয় পরিষদে সংখ্যালঘুদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধি থাকবে।
  3. প্রত্যেক প্রদেশ একই ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে।
  4. কেন্দ্রীয় পরিষদে এক-তৃতীয়াংশ আসন মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
  5. পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। কোনও সম্প্রদায় ইচ্ছা করলে যৌথ নির্বাচনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারবে।
  6. সীমানা বদল করে পাঞ্জাব, বাংলা ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ্রাস করা যাবে না।
  7. প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে।
  8. সম্প্রদায় বিশেষের জন্য কোনও আইনবিধি বা সিদ্ধান্ত ক্ষতিকর এই যুক্তিতে সেই সম্প্রদায়ের যদি তিন-চতুর্থাংশ সদস্য আইন পরিষদ বা অন্য কোনও নির্বাচিত পরিষদে সেই আপত্তিকর বিল বা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে, তবে তা অনুমোদিত হবে না।
  9. বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে সিন্ধু প্রদেশকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
  10. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানে শাসনসংস্কার করতে হবে।
  11. যোগ্যতা ও দক্ষতার মাপকাঠিতে সমস্ত সরকারি চাকুরিতে মুসলমানদের সমানাধিকার দিতে হবে।
  12. ইসলাম ধর্ম, ইসলামি কৃষ্টি, ভাষা, শিক্ষা, আইন প্রতিষ্ঠানগুলির সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে সরকারি সাহায্য ও নিশ্চয়তা দিতে হবে।
  13. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান প্রতিনিধি থাকবে।
  14. প্রদেশগুলির সম্মতি ছাড়া কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না। পরবর্তীকালে মুসলিম লিগের কর্মসূচিতে এই দাবিগুলির প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু এই দাবি হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে। কারণ-জিন্নাহ-র দাবিগুলির অধিকাংশই গণতন্ত্র-বিরোধী হলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে তা সমর্থনযোগ্য বলে মনে হতে থাকে। ফলে, ভারতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি পায়।

৮। লেখো: ডান্ডি অভিযান।

অথবা, গান্ধিজি কীভাবে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন?

অথবা, গান্ধিজি কবে, কেন ডান্ডি অভিযান করেন?

ডান্ডি অভিযান:

অসহযোগ আন্দোলনের পর আইন অমান্য আন্দোলন ছিল গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় সর্বভারতীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ‘পূর্ণ স্বরাজ প্রস্তাব’ পাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য লবন এবং অন্যান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে গান্ধিজি আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ছিল লবণ সত্যাগ্রহ ও ডান্ডি অভিযান।

উদ্দেশ্য: ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দা, সাইমন কমিশনের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি, সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপ-সহ নানান ঘটনা সমগ্র ভারতব্যাপী এক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে।

  • বড়োলাট লর্ড আরউইনের কাছে গান্ধিজি রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, লবণ কর বিলোপ, করের বোঝা হ্রাস-সহ ১১ দফা প্রস্তাব এই রাখলেও সরকার তা অগ্রাহ্য করে।
  • এই পরিস্থিতিতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের সবরমতী আশ্রমে আয়োজিত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আইন অমান্য আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
  • এরপর গান্ধিজি ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় আইন অমান্যর চূড়ান্ত রূপরেখা ঘোষণা করেন। লর্ড আরউইনকে লেখা একটা বড়ো চিঠিতে গান্ধিজি লেখেন (২ মার্চ) যে, গুজরাটের সমুদ্র উপকূলবর্তী ডান্ডি নামক স্থানে তিনি লবণ আইন ভঙ্গ করে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করবেন।

অর্থাৎ, লবণ আইনের বিরোধিতা করে দেশের সর্বত্র আইন অমান্যের বিস্তার, তথা দেশবাসীকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করাই ছিল ডান্ডি অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য।

যাত্রাপথ:

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ লবণ আইন অমান্যের জন্য ৭৮ জন (মতান্তরে ৭১ বা ৭৯ জন) অনুগামী-সহ গান্ধিজি সবরমতী আশ্রম থেকে গুজরাটের সমুদ্র উপকূলবর্তী ডান্ডি অভিমুখে যাত্রা করেন। এই পদযাত্রা ইতিহাসে ডান্ডি অভিযান (Dandi March) নামে খ্যাত। প্রায় দুশো মাইলেরও বেশি দীর্ঘ এই যাত্রাপথে হাজার হাজার নারী-পুরুষ গান্ধিজি ও তাঁর সহগামীদের সংবর্ধনা ও অভিনন্দন জানান। গান্ধিজির অভিযানের খবর সংবাদপত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে ও বিদেশে। লাঠিতে ভর দিয়ে নগ্নপদে এগিয়ে চলা গান্ধিজিকে দেখে ভারতীয়দের মধ্যে প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়। জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম নেত্রী সরোজিনী নাইডু ও অন্যান্যরা তাঁর সহযাত্রী হন। এই সময় গান্ধিজি জনগণকে সরকারি চাকুরি বর্জন ও খাজনা বন্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।

লবণ আইন ভঙ্গ:

মাত্র ২৪ দিনে ২৪১ মাইল পথ অতিক্রম করে ৫ এপ্রিল মহাত্মা গান্ধি ডান্ডির সমুদ্রতীরে পৌঁছান। ৬ এপ্রিল নিজ হাতে সমুদ্রের জল থেকে লবণ তৈরি করে লবণ আইন ভঙ্গ করেন। এরপর গান্ধিজির নেতৃত্বে অন্যান্য সত্যাগ্রহীরাও লবণ প্রস্তুত দ্বারা আইন ভঙ্গ করেন। এইভাবে আইন অমান্য আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে।

গুরুত্ব: গান্ধিজির নেতৃত্বে ডান্ডি অভিযানে সাধারণ মানুষ সত্যাগ্রহীদের বিপুল উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু-র মতে, ডান্ডি অভিযান ছিল একটি মহান আন্দোলনের মহান সূচনা। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, ডান্ডি অভিযান পরিকল্পনা ছিল একটি মহান পরিকল্পনা এবং এটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কার্যকর করা হয়েছিল। তাই ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে ডান্ডি অভিযান-এর গুরুত্ব অপরিসীম।

৯। টীকা লেখো: পুনা চুক্তি।

পুনা চুক্তি: ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড শুধুমাত্র অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেননি, পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়কে বর্ণহিন্দু এবং অনগ্রসর হিন্দু-এই দুটি ভাগে ভাগ করে তাদের জন্যেও পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণার প্রতিবাদে গান্ধিজি মহারাষ্ট্রের যারবেদা জেলে ২০ সেপ্টেম্বর (১৯৩২ খ্রি.) আমরণ অনশন শুরু করেন।

চুক্তি স্বাক্ষর: সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির প্রতিবাদে পুনায় গান্ধিজির আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত সারা দেশে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। মদনমোহন মালব্য, রাজেন্দ্র প্রসাদ, বি আর আম্বেদকর, এম সি রাজা-সহ বিভিন্ন নেতারা সক্রিয় হন। এঁদের উদ্যোগে দলিত শ্রেণির নেতা বি আর আম্বেদকরের সঙ্গে গান্ধিজির আলোচনা শুরু হয়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর সমঝোতার ভিত্তিতে গান্ধিজি ও বি আর আম্বেদকরের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পুনা চুক্তি।

চুক্তির শর্তাবলি: পুনা চুক্তি দ্বারা

  • অনুন্নত শ্রেণির জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি ত্যাগ করা হয়।
  • অনুন্নত শ্রেণির জন্য নির্দিষ্ট আসনসংখ্যা বাড়ানো হয়। এর আগে প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে দলিতদের জন্য ৭১টি আসন সংরক্ষিত ছিল। পুনা চুক্তির পর তা বৃদ্ধি করে ১৪৮টি করা হয়। আবার কেন্দ্রীয় আইনসভাতেও দলিতদের জন্য সংরক্ষিত হয় ১৮ শতাংশ আসন।
  • তাছাড়া যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচন হবে বলে স্থির হয়। ব্রিটিশ সরকার এই চুক্তি মানতে বাধ্য হয়। গান্ধিজি অনশন ভঙ্গ করেন (২৬ নভেম্বর) এবং বিনা শর্তে মুক্তি পান।

মূল্যায়ন:

  • পুনা চুক্তির কঠোর সমালোচনা করেন জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ। তাঁরা মনে করেন যে, পুনা চুক্তি সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে, তাকে নতুনতর ভিত্তি দিয়েছে।
  • লিবার্টি পত্রিকায় লেখা হয় (১৪ আগস্ট, ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ) যে, পুনা চুক্তির ফলে লাভবান হয়েছে শুধুমাত্র ব্রিটিশ-আশ্রিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি।
  • ড. অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মর্লে-মিন্টো তাঁদের শাসনসংস্কার আইন দ্বারা মুসলমানদের যে সুযোগ পাইয়ে দেন, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি পুনা চুক্তি দ্বারা অনুন্নত হিন্দুদের একই সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এখন থেকে ‘মুসলমান ও অনুন্নত হিন্দুরা একজোটে বাঁধা পড়েন।’ বস্তুত, বর্ণহিন্দু ও অনুন্নত হিন্দুদের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন তৈরির কাজে পুনা চুক্তির ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment