আর্য সভ্যতার যুগে প্রবর্তিত এবং আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দু-হাজার বছর থেকে খ্রিস্টপূর্ব তিনশো বছর পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের বেদ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাকে বলা হয় বৈদিক শিক্ষা। শ্রবণ নির্ভর হওয়ায় বেদের অপর নাম শ্রুতি।
বৈদিক যুগের শিক্ষাব্যবস্থা (Vedic Education System)
বৈদিক যুগের শিক্ষাব্যবস্থা (Vedic Education System)
বৈদিক যুগের শিক্ষার উদ্দেশ্য
বৈদিক যুগের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যগুলি আলোচনা করা হল-
(1) আত্মোপলব্ধি:
বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল পরমব্রহ্মকে উপলব্ধি করা। মনে করা হত, ধ্যানের মাধ্যমে সত্যকে উপলব্ধি করা যায়। তাই সে যুগে শিক্ষার মূলে ছিল ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ধর্মীয় ভাবের প্রেরণা। ধর্মের নানা তত্ত্বকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল যাবতীয় শিক্ষাভাবনা। মানব জীবনের চরম লক্ষ্য ছিল আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে মুক্তি লাভ করা বা মোক্ষ লাভ করা ‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’।
(2) চরিত্রের গঠন:
বৈদিক শিক্ষার অপর একটি উদ্দেশ্য ছিল চরিত্র গঠন। বনাঞ্চলে প্রকৃতির উন্মুক্ত স্থানে ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে গুরুগৃহে শিক্ষা পরিচালিত হত।
(3) ব্যক্তিত্বের বিকাশ:
আত্মসম্মানবোধ, আত্মবিশ্বাস গঠন, আত্মসংযমী হওয়া এবং আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো ছিল বৈদিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
(4) ইতিবাচক মনোভাবের বিকাশ:
এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সৌন্দর্য জ্ঞান বৃদ্ধি, সংসার জীবনের প্রস্তুতি, বিভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, গৃহপালিত পশুপাখিদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গঠন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করার ওপর জোর দেওয়া হত।
(5) ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও সঞ্চালন:
প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সরক্ষণ, উন্নয়ন ও সঞ্চালনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান করা হত এই শিক্ষাব্যবস্থায়।
বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য
শ্রবণনির্ভর হওয়ায় বেদের অপর নাম শ্রুতি। বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ হল-
(1) গুরুকুল:
বৈদিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বলতে গুরুকুল বা গুরুর আশ্রমকে বোঝাত। উপনয়নের পর শিক্ষার জন্য শিষ্যরা গুরুগৃহে সমবেত হত। এক-একজন গুরুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত আবাসিক-আশ্রমিক গৃহ-বিদ্যালয়। এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থাকে বলা হত গুরুকুল শিক্ষাব্যবস্থা।
(2) উপনয়ন ও ব্রহ্মচর্যাশ্রম:
বৈদিক শিক্ষায় গুরুরা উপনয়ন নামক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিষ্যকে ব্রহ্মচারী হিসেবে দ্বিতীয় জন্ম দিতেন। গুরুগৃহে থাকাকালে শিষ্যকে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হত। কয়েকটি শারীরিক ও আধ্যাত্মিক নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে মেনে চলতে হত এবং তার মধ্য দিয়েই শিষ্যের শিক্ষালাভ ঘটত।
(3) শিক্ষাকাল:
উপনয়নের মাধ্যমে বৈদিক শিক্ষা শুরু হত। বারো বছরের শিক্ষাক্রমটি শেষ হত ‘সমাবর্তন’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
(4) সংরক্ষিত শিক্ষা:
বৈদিক যুগে কেবল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের শিক্ষাধিকার ছিল। শূদ্রদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। তাই বলা যায়, বৈদিক শিক্ষা সর্বজনীন ছিল না।
(5) শিষ্যের দায়িত্ব:
পুরুগৃহে থাকাকালীন শিষ্যকে অনেকগুলি দায়িত্ব পালন করতে হত। যেমন-গুরুর সেবা করা, গুরুগৃহ পরিষ্কার করা, গো-পালন করা, পূজার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা, গুরুর পরিবারের জন্য ভিক্ষা করা, গুরুর নির্দেশ পালন করা ইত্যাদি।
(6) পাঠক্রম:
বৈদিক শিক্ষায় গুরুরা শিষ্যকে বেদ পাঠ করার পাশাপাশি শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ছন্দ, তর্ক প্রভৃতি বিষয়েও শিক্ষাদান করতেন। পরবর্তীকালে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য সমাজে বর্ণাশ্রম চালু হওয়ায় শূদ্র ছাড়া তিনটি উচ্চবর্ণের জন্য বৃত্তি অনুযায়ী আলাদা আলাদা পাঠক্রমের ব্যবস্থা করা হয়। ব্রাহ্মণদের বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ, নক্ষত্রবিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, ইতিহাস, পুরাণ ইত্যাদি; ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধবিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, রাজনীতি, দণ্ডনীতি, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি এবং বৈশ্যদের পশুপালন, কৃষিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান করা হত।
(7) পদ্ধতি:
শ্রবণ, মনন এবং নিবিষ্টচিত্তে ধ্যান বৈদিক শিক্ষাদানের প্রধান পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হত।
(8) গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক:
গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো। গুরু শিষ্যকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন, শাসন করতেন। শিষ্য গুরুকে পিতার মতো শ্রদ্ধা ও সমীহ করত।
(9) গুরুকেন্দ্রিকতা:
বৈদিক শিক্ষা ছিল গুরুকেন্দ্রিক। গুরুর কথাই ছিল শেষ কথা। কোনো প্রতিবাদের অবকাশ ছিল না।
বৈদিক যুগের শিক্ষাদান পদ্ধতি
বৈদিক যুগে পঠনপাঠনের বিষয় ছিল যজ্ঞের ‘মন্ত্র’। লিখিত পুস্তক তখন ছিল না। শিক্ষণপদ্ধতি ছিল আবৃত্তি। শিক্ষক বা আচার্য যথাযথ ছন্দ ও ধ্বনিতে মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, ছাত্র বা শিষ্যরা তা শুনে মনন ও অনুধাবনের সঙ্গে আয়ত্ত করত। সুতরাং, শিক্ষা-শিখন প্রক্রিয়ায় ছাত্র অর্থাৎ শিষ্যদের ভূমিকা ছিল মুখ্য।
বৈদিক যুগের ঋষিরা মনে করতেন প্রকৃত জ্ঞান কেবল অনুশীলনের দ্বারাই অর্জন করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন আকাঙ্ক্ষার নিরসন। সমস্ত জাগতিক কামনা, বাসনার উর্ধ্বে উঠতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সন্ন্যাস ও যোগ। তাই সন্ন্যাস ও যোগ শিক্ষণ পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষাদান পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে কয়েকটি স্তর পাওয়া যায়।
যেমন-
(1) উপক্রম: পূর্বজ্ঞান পরীক্ষা করে শিক্ষার্থীর জ্ঞানের স্তর অনুধাবন করা হত।
(2) শুশ্রূষা: আচার্যের মন্ত্রোচ্চারণ শোনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করাই ছিল শুশ্রুষা।
(3) শ্রবণ: শিষ্যরা যেভাবে মনোযোগের সঙ্গে আচার্যের পাঠদান গ্রহণ করত তাকেই বলা হত শ্রবণ।
(4) গ্রহণ: গ্রহণ হল বিষয়বস্তুর উপলখি।
(5) ধারণ: অনুশীলনের দ্বারা বিষয়বস্তুকে স্মৃতিতে রাখাকে বলা হত ধারণ।
(6) আলোচনা: গুরু-শিষ্যের আলোচনার মাধ্যমে গভীরভাবে বিষয়বস্তু উপলব্ধির প্রয়াস করা হত।
(7) অভিজ্ঞান: অভিজ্ঞান হল আচার্যের দেয় বিষয়বস্তুকে হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা। একে অর্থাভিজ্ঞানও বলে।
(8) তত্ত্বাভিনিবেশ: আচার্য কর্তৃক ব্যক্ত জ্ঞানের অন্তর্নিহিত সত্য উপলব্ধি করা হল তত্ত্বাভিনিবেশ।
আরও পড়ুন | Link |
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
আগুন নাটকের বড়ো প্রশ্ন উত্তর | Click Here |