মাধ্যমিক শিক্ষা হল শিক্ষার সেই স্তর যার মধ্য দিয়ে শিশু জটিল আধুনিক সমাজের পূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠে। এই শিক্ষাই শিশুর ক্ষমতা, প্রবণতা, আগ্রহ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে চূড়ান্ত রূপ দেয়।
মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পাঠক্রম
মাধ্যমিক শিক্ষার স্বরূপ
প্রকৃতপক্ষে মাধ্যমিক শিক্ষা হল জাতিগঠনের শিক্ষা। তাই এর উন্নত মান বজায় রাখার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। মাধ্যমিক শিক্ষা প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। তাই মাধ্যমিক শিক্ষা শক্তিশালী না হলে মাধ্যমিক পূর্ববর্তী ও পরবর্তী শিক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে। যেহেতু মাধ্যমিক শিক্ষার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বড়ো অংশ প্রথাগত সাধারণ শিক্ষা ত্যাগ ক’রে বাস্তবজীবনে প্রবেশ করে, সেজন্য মাধ্যমিক শিক্ষা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই শিক্ষা এমনভাবে সংগঠিত করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনমতো জ্ঞান ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ হয়ে সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করতে পারে।
মাধ্যমিক শিক্ষার বয়সসীমা
ভারতে মাধ্যমিক শিক্ষার বয়সসীমা সর্বত্র এক নয়। কোনো কোনো রাজ্যে তা এগারো বছর থেকে শুরু হয় আবার কোনো কোনো রাজ্যে বারো বছর থেকে। ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের (1964-66) সুপারিশ অনুযায়ী শিশু প্রথম সাত বা আট বছর প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তী চার বা পাঁচ বছর হবে মাধ্যমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথম দু-বছর নিম্নমাধ্যমিক (নবম ও দশম শ্রেণি) এবং পরের দু-বছর উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) শিক্ষা হিসেবে গ্রাহ্য হয়।
মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
মাধ্যমিক শিক্ষাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকতার বিকাশে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। বৃত্তিমূলক যোগ্যতার বিকাশ, আধুনিক সমাজে নেতৃত্বদানের যোগ্যতার বিকাশে মাধ্যমিক শিক্ষাকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে মাধ্যমিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যগুলি হল-
(1) সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সহায়তা:
প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সহায়তা করা।
(2) নাগরিকতার বিকাশে সহায়তা:
শিক্ষার্থীকে গণতান্ত্রিক সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করা এই শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
(3) সামাজিক সংস্কৃতি বিকাশে সহায়তা:
মাধ্যমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ ও সামাজিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো।
(4) বৃত্তিশিক্ষায় সহায়তা:
এই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও ক্ষমতা অনুযায়ী তাকে বৃত্তি-শিক্ষায় শিক্ষিত করা। কারণ এই স্তরের শিক্ষা শেষ করার পর শিক্ষার্থীদের একটা বড়ো অংশ কর্মজীবনে প্রবেশ করে।
(5) স্বাস্থ্যাভ্যাস গঠনে সহায়তা:
শিক্ষার্থীর মধ্যে স্বাস্থ্যাভ্যাস গঠন করা মাধ্যমিক শিক্ষার আর-একটি পুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্যাভ্যাস বলতে দৈহিক এবং মানসিক উভয় প্রকৃতির স্বাস্থ্যকেই বোঝায়। বিভিন্ন ধরনের শরীরচর্চা, খেলাধুলা, যোগব্যায়াম প্রভৃতির মাধ্যমে এটি সম্পন্ন হয়।
(6) সৃজনশীলতার বিকাশে সহায়তা:
এই শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশে সহায়তা করা। বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কাজের মাধ্যমে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়।
(7) বিজ্ঞানসম্মত মনোভাব গঠনে সহায়তা:
মাধ্যমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রগতিশীল, বিজ্ঞানসম্মত মনোভাব গড়ে তোলা।
(8) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশে সহায়তা:
এই শিক্ষার আর-একটি লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশে সহায়তা করা।
মুদালিয়ার কমিশনের মতে মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য
1952 সালে ড. লক্ষ্মণস্বামী মুদালিয়ারের নেতৃত্বে গঠিত মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন তৎকালীন মাধ্যমিক শিক্ষার সংস্কারের জন্য কয়েকটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য স্থির করে। যেমন-
(1) গণতান্ত্রিক নাগরিকতার বিকাশসাধন:
শিক্ষার্থীকে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উপযোগী দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার সাহায্যে তার অভ্যাস এবং চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশসাধন করতে হবে।
(2) বৃত্তিমুখী ও উৎপাদনশীল দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা:
মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে বাস্তবজীবনের উপযোগী বৃত্তিমুখী ও উৎপাদনশীল বিভিন্ন কাজে শিক্ষিত করতে হবে। এই ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে নিজেরাই অর্থ উপার্জনে সক্ষম হবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়তা করবে।
(3) নেতৃত্বদানের উপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা:
মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে এমনভাবে শিক্ষিত করা হবে, যাতে তারা আগামী দিনে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশকে নেতৃত্বদানের উপযোগী হয়ে ওঠে। দেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে এই ধরনের শিক্ষার প্রয়োজন।
(4) সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশসাধন:
মাধ্যমিক শিক্ষার আর-একটি উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ক্ষমতার যথাযথ বিকাশ ঘটানো; ছেলেমেয়েদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া।
মুদালিয়ার কমিশনের মতে, মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ছেলেমেয়েদের শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত করা নয়। এই শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হল ছেলেমেয়েদের কঠিন বাস্তবের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার উপযোগী করে তোলা।
কোঠারি কমিশনের মতে মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য
1952 সালে প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন তৎকালীন মাধ্যমিক শিক্ষার ত্রুটিগুলি উল্লেখ করে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য নির্দেশ করেছে। পরে ভারতীয় শিক্ষা কমিশনও (1964-66) প্রায় একই কথা বলেছে। মাধ্যমিক শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যগুলি হল-
(1) জাতির লক্ষ্যপূরণ:
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের জাতীয় লক্ষ্যপূরণের সহায়ক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
(2) শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী করা:
মাধ্যমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী করা, যাতে তারা ভবিষ্যতে স্বনির্ভর হয়ে দেশের প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করতে পারে।
(3) কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা দূরীকরণ:
আমাদের দেশের মানুষের একটা বিরাট অংশ নিরক্ষরতার অভিশাপে অভিশপ্ত। মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে শিক্ষার্থীদের সর্বপ্রকার কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করা।
(4) বয়ঃসন্ধিক্ষণের বিকাশে সহায়তা ও চাহিদাপূরণ:
বয়ঃসন্ধিক্ষণের বিকাশ ও চাহিদার কথা মনে রেখে মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ওপর দৃষ্টি দেওয়া বাঞ্ছনীয়-
- বয়ঃসন্ধিকালে দৈহিক বিকাশের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সক্রিয়তার চাহিদা দেখা যায় তার পূরণে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
- এই সময়ে সামাজিক চেতনার বিকাশ ঘটে, এই বিকাশ যাতে সুষ্ঠুভাবে ঘটতে পারে সেজন্য শিক্ষার্থীদের সহযোগিতামূলক যৌথকর্মের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
- বয়ঃসন্ধিকালে আত্মপ্রকাশের চাহিদা এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চাহিদা দেখা যায়। তাই এই সময়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষার আয়োজন করা বাঞ্ছনীয়।
- এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মনে যৌন কৌতূহল প্রকাশ পেতে থাকে। তাই এই সময় তাদের সৃষ্টিমূলক সাংস্কৃতিক কার্যাবলিতে যুক্ত করা প্রয়োজন।
- বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ, প্রবণতা ও সামর্থ্যের পার্থক্য সুস্পষ্ট রূপ পেতে শুরু করে। তাই এই সময় পাঠক্রমের মধ্যে পৃথকীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীর আগ্রহ, গ্রহণক্ষমতা, প্রবণতা অনুসারে শিক্ষার ব্যবস্থা করাই হল শিক্ষার প্রকৃত অর্থ। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় এই লক্ষ্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম
মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনে (1952) মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলি হল- ভাষা, সমাজবিদ্যা, ও সাধারণ বিজ্ঞান, গণিত, কলা ও সংগীত, ও হাতের কাজ এবং শারীরশিক্ষা।
1964 সালে গঠিত ভারতীয় শিক্ষা কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার যে পাঠক্রমটি সুপারিশ করেছে তা নিম্নরূপ-
(1) ভাষা:
ত্রিভাষা সূত্র প্রযোজ্য হবে। এই সূত্র অনুযায়ী- [i] মাতৃভাষা বা স্থানীয় ভাষা, [ii] সরকারি ভাষা হিন্দি বা সহযোগী সরকারি ভাষা ইংরেজি, [iii] আধুনিক ভারতীয় ভাষা বা আধুনিক বিদেশি ভাষা যা [i] বা [ii]-এ নেই তা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে।
(2) বিজ্ঞান:
আবশ্যিক হিসেবে বিজ্ঞান ও গণিত থাকবে। এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হল গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও জীবনবিজ্ঞান।
(3) সমাজবিজ্ঞান:
এই বিভাগে আছে ইতিহাস ও ভূগোল। এই দুটি বিষয়ের মাধ্যমে ভারত এবং তার জনগণ সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হবে।
(4) কর্ম-অভিজ্ঞতা:
এই বিভাগের মধ্যে আছে উৎপাদনমূলক কাজ, শারীরশিক্ষা ও সমাজসেবা।
(5) ঐচ্ছিক বিষয়:
এই বিভাগে একাধিক বিষয় আছে যার মধ্যে থেকে শিক্ষার্থীরা যে-কোনো একটি বিষয়কে বেছে নিতে পারে।
মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান
মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে চারটি বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে ভাগ করা যায়, যথা- শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব-গ্রহণভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক, সময়কালভিত্তিক এবং অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক।
(1) শিক্ষার্থীদের দায়িত্বগ্রহণভিত্তিক:
এই বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
- দিবা বিদ্যালয়: এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি থেকে যাতায়াত ক’রে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
- আবাসিক বিদ্যালয়: এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট বাসস্থানে থাকতে হয়। থাকা, খাওয়া, পঠনপাঠন সবই ‘বিদ্যালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়।
(2) লিঙ্গভিত্তিক:
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যালয়গুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
- বালকদের বিদ্যালয়: এইসব বিদ্যালয়ে কেবল বালকদের ভরতি এবং পঠনপাঠনের সুযোগ থাকে।
- বালিকাদের বিদ্যালয়: এসব বিদ্যালয়ে কেবল বালিকাদের ভরতি এবং পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা হয়।
- সহশিক্ষা বিদ্যালয়: এইসব বিদ্যালয়ে বালক ও বালিকা উভয়ই ভরতি হতে পারে এবং পঠনপাঠন করতে পারে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে আংশিক সহশিক্ষা বিদ্যালয় আছে। এসব বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কেবল বালকদের জন্য এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি সহশিক্ষামূলক।
(3) সময়কালভিত্তিক:
শিক্ষার সময়কালকে ভিত্তি করে এই বিভাগ করা হয়, যেমন-
- জুনিয়র বিদ্যালয়: এখানে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকে।
- মাধ্যমিক বিদ্যালয়: এখানে সাধারণত পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠনের ব্যবস্থা থাকে।
- উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়: এখানে পঞ্চম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠনের ব্যবস্থা থাকে।
(4) অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক:
উপরিউক্ত বিদ্যালয়গুলি ছাড়াও আরও মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। যেমন-
- পাবলিক স্কুল: ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলের অনুকরণে এই বিদ্যালয় গঠিত। এখানে জ্ঞানের বিকাশ ছাড়াও অন্যান্য গুণাবলি বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
- সরকার পরিচালিত বিদ্যালয়: এই সমস্ত বিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে সরকার দ্বারা পরিচালিত। আর্থিক দায়দায়িত্ব, প্রশাসনিক নিয়মকানুন সব সরকার নিয়ন্ত্রিত।
- সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়: এক্ষেত্রে সরকার আর্থিক সাহায্য করলেও বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন প্রশাসনে [ হস্তক্ষেপ করে না। সেজন্য আলাদা বিদ্যালয় পরিচালন সমিতি আছে।
- বেসরকারি বিদ্যালয়: এই ধরনের বিদ্যালয়ে সরকার কোনো আর্থিক সাহায্য করে না। ব্যয়ের জন্য আর্থিক সংস্থান বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই করতে হয়। শিক্ষক নিয়োগ এবং যাবতীয় প্রশাসনিক নিয়মকানুন কর্তৃপক্ষই স্থির করে।
- ধর্মীয় সংস্থা পরিচালিত বিদ্যালয়: বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা স্থাপিত এবং পরিচালিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা এখানে দেখা যায়।
আমাদের দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকারভেদ থাকলেও যে-কোনো বিদ্যালয়কেই বিদ্যালয়ের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য কোনো স্বীকৃত সংস্থা কর্তৃক অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়।
কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত অভিযোজনে মাধ্যমিক শিক্ষার গুরুত্ব
মাধ্যমিক শিক্ষা হল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাস্তর। এই শিক্ষাস্তরটি কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত অভিযোজনে নানাভাবে সহায়তা করে। কারণ কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের দেহ ও মনে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। ফলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন চাহিদা জাগ্রত হয়। বাস্তবে সবসময় ওইসব চাহিদা তৃপ্ত হয় না। অনেক চাহিদাই অপূর্ণ থাকে। এর ফলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। যথাযথ শিক্ষাই বিভিন্ন চাহিদাপূরণের দ্বারা তাদের ব্যক্তিগত অভিযোজনে সহায়তা করে। কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত অভিযোজনে মাধ্যমিক শিক্ষার গুরুত্ব কতখানি তা উল্লেখ করো হল-
(1) গণতান্ত্রিক নাগরিকতার বিকাশে সহায়তা:
মাধ্যমিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সু-অভ্যাস, সু-মনোভাব গড়ে তোলে। এ ছাড়া তাদের চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশেও সাহায্য করে। ফলে তারা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।
(2) ব্যক্তিসত্তার বিকাশে সহায়তা:
মাধ্যমিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশে সহায়তা করে। কর্মশিক্ষা, বিদ্যালয় কৃত্যালি প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটে।
(3) যৌনজীবন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা:
মাধ্যমিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের যৌন কৌতূহল নিবারণের ব্যবস্থা করে। শিক্ষার্থীরা জীবনবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে মানুষের যৌনজীবন সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায়।
(4) শিক্ষার্থীদের আত্মবিকাশের চাহিদাপূরণে সহায়তা:
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতার চাহিদাপূরণের পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও বাড়ে।
(5) প্রাক্ষোভিক বিকাশে সহায়তা:
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো বা সহায়কের মতো ভূমিকা পালন করলে শিক্ষার্থীদের প্রাক্ষোভিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ফলে সু-সংহত প্রাক্ষোভিক বিকাশ সম্ভব হয়।
(6) জ্ঞান আহরণের চাহিদাপূরণে সহায়তা:
কৈশোরে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জ্ঞান আহরণের চাহিদা প্রবল থাকে। মাধ্যমিক শিক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরণের সুযোগ ঘটে। ফলে শিক্ষার্থীদের কৌতূহল ও অতিরিক্ত জ্ঞান আহরণের চাহিদা পুরণ হয়।
(7) জীবনাদর্শের চাহিদাপূরণে সহায়তা:
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় বিদ্যালয়ে বিভিন্ন মহাপুরুষদের জীবনীপাঠের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের জীবনাদর্শের চাহিদা পূরণ হয়।
(8) দলবদ্ধভাবে থাকার চাহিদাপূরণে সহায়তা:
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন বিষয়ের প্রকল্প রূপায়ণের কাজে দলগতভাবে কাজ করার ওপর জোর দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধভাবে কাজ করতে গিয়ে তাদের দলবদ্ধভাবে থাকার চাহিদা কিছুটা পুরণ হয়।
মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যা
পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকগুলি সমস্যা লক্ষ করা যায়। এইসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে, আগামী দিনে এই শিক্ষার অগ্রগতি পদে পদে ব্যাহত হবে। এই শিক্ষার উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলি হল-
(1) বিদ্যালয়ের অভাব:
মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক বিদ্যালয় পশ্চিমবঙ্গে নেই। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব একটি বড়ো সমস্যা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মাধ্যমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব আছে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে সমগ্র দেশে আরও প্রায় সাত লক্ষ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজন।
(2) শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব:
মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে আজও শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব লক্ষ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়েই বছরের সবসময় কয়েকটি শিক্ষকপদ খালি থাকে। ফলে শিক্ষা দান ও গ্রহণ ব্যাহত হয়।
(3) উপযুক্ত পাঠক্রমের অভাব:
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রম আজও বাস্তবকেন্দ্রিক নয়। তত্ত্বভারাক্রান্ত পাঠক্রমে শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
(4) আর্থিক সমস্যা:
পশ্চিমবঙ্গে বহু ছাত্রছাত্রী আর্থিক সমস্যার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। টিউশন ফি কম হলেও অন্যান্য ফি এবং শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে।
(5) বিভিন্ন শিক্ষান্তরের সঙ্গে যোগাযোগের অভাব:
মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমের সঙ্গে শিক্ষার অন্যান্য স্তরগুলি সঠিকভাবে যুক্ত করার ব্যবস্থা না থাকায়, মাধ্যমিক শিক্ষা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
(6) অবৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা:
আমাদের দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা সংকীর্ণ, তাত্ত্বিক ও পুথিনির্ভর। বাস্তবজীবনের সঙ্গে এর খুব একটা যোগ নেই। এই শিক্ষা গ্রহণ ক’রেও বহু ছাত্রছাত্রী বেকার হয়ে জীবন কাটায়, ফলে এই শিক্ষা ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় নয়।
(7) পাঠ্যপুস্তকের সমস্যা:
মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকগুলির দাম বেশি হওয়ায় বহু ছাত্রছাত্রী তা কিনতে পারে না, ফলে শিক্ষার কাজ ব্যাহত হয়।
(8) মূল্যায়নের সমস্যা:
গতানুগতিক লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার মূল্যায়নের পদ্ধতিটি যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যা সমাধানের উপায়
মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত, তা হল-
(1) উদ্দেশ্যের পুনর্গঠন:
মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলিকে বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে পুনর্গঠিত করতে হবে।
(2) বৃত্তিমুখীকরণ:
এই শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থে বৃত্তিমুখী ও উৎপাদনশীল করে তুলতে হবে।
(3) চাহিদাভিত্তিক পাঠক্রম:
এই শিক্ষার পাঠক্রম প্রণয়ন করার সময় শিক্ষার্থীদের চাহিদা এবং সমাজের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সময়ের সাপেক্ষে পাঠক্রম সংস্কার করতে হবে।
(4) বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ:
অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক এবং অন্যান্য শিক্ষা-সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
(5) যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক:
উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকশিক্ষিকাদের শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত করতে হবে।
(6) মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষণপদ্ধতি:
শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিক মনোবিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হবে। যথাসম্ভব প্রকল্পনির্ভর শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে হবে।
(7) উন্নত পরিকাঠামো:
উপযুক্ত সংখ্যক বিদ্যালয় ভবন স্থাপন করতে হবে। জল, আলো, বাতাস এবং শৌচাগারের সুব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যানুযায়ী গ্রন্থাগার, পরীক্ষাগার, শিক্ষাসহায়ক উপকরণ, শ্রেণিকক্ষ প্রভৃতির সুব্যবস্থা করতে হবে।
(8) বৃত্তিপ্রদান:
ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ বা স্টাইপেন্ডের ব্যবস্থা করতে হবে।
(9) সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির ব্যবস্থা:
বিদ্যালয়গুলিতে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি পরিচালনার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
(10) নিয়মিত পরিদর্শন:
বিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।
(11) স্বাস্থ্যপরীক্ষার ব্যবস্থা:
বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
(12) পরীক্ষাব্যবস্থার সংস্কার:
পরীক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে আধুনিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
(14) সংশোধনমূলক শিখনের ব্যবস্থা:
দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য সংশোধিত পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
আরও পড়ুন | Link |
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
আগুন নাটকের বড়ো প্রশ্ন উত্তর | Click Here |