ইউরোপে প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ধারা সম্পর্কে লেখো
অথবা, প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক চার্চ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল
অথবা, প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও
ইউরোপে সমগ্র ষোড়শ শতক জুড়ে সংস্কারপন্থীরা যখন রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও ধর্মমতের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, তখন ক্যাথলিক চার্চের অভ্যন্তর থেকেও শুরু হয়েছিল সংস্কারের প্রচেষ্টা- যা Counter Reformation বা প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন নামে খ্যাত। এই প্রতি-ধর্মসংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল- লুথার, ক্যালভিনপন্থী এবং অ্যানাব্যাপটিস্টদের চার্চবিরোধী আন্দোলন প্রতিরোধ এবং চার্চের ঐক্যরক্ষা।
প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ধারা
(1) প্রাথমিক প্রচেষ্টাসমূহ: মার্টিন লুথারের ধর্মসংস্কারের বহু আগে থেকেই ফ্লোরেন্সের সাভোনারোলা, স্পেনের কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো জিমেনেজ (Francisco Jimenez) প্রমুখ ধর্মপ্রাণ মানবতাবাদীগণ এবং জেনোয়ার ক্যাথরিন ফিয়েসচি (Caterina Fieschi Adorno)-এর Oratory of Divine Lone নামক সংস্থা (১৪৯৭ খ্রি.) চার্চ তথা যাজকতন্ত্রের শুদ্ধিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
(2) রোমান পোপদের অবদান: প্রথমদিকে ক্যাথলিক সংস্কারবাদী চেতনা পোপদের খুব বেশি প্রভাবিত না করলেও পরবর্তীতে পোপ ষষ্ঠ অ্যাড্রিয়ান (Pope Adrian VI), তৃতীয় ক্লেমেন্ট (Pope Clement III), দশম লিও (Leo X) চার্চের শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। তবে এই কাজে সক্রিয় পদক্ষেপ নেন পোপ তৃতীয় পল (Pope Paul III)। আলোচ্য সময়কালে চার্চের নৈতিক মানোন্নয়নে কিছু সংস্কারমূলক কর্মসূচিও গৃহীত হয়।
- চার্চের নৈতিক মানোন্নয়নে সংস্কারমূলক কর্মসূচি: আলোচ্য সময়কালে চার্চগুলির নৈতিক মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে বেশকিছু সংস্কারমূলক কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল। যেমন- ভোগবিলাসে আসক্ত অলস যাজকদের পদচ্যুত করা হয়, রোমের ভবঘুরে সন্ন্যাসীরা জাহাজের দাঁড় টানার কাজে নিযুক্ত হন, নতুন ও পুরোনো যাজকদের সদগুণ, আদর্শ ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, • অসহায় ও দরিদ্রদের প্রতি সেবামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
(3) Society of Jesus’ প্রতিষ্ঠা: প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের একজন অক্লান্ত সেনানী ইগনেসিয়াস লয়োলা ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে ‘Society of Jesus’ নামক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার প্রচারকগণ জেসুইট (Jesuit) নামে পরিচিত হন।
(4) ট্রেন্টের ধর্মসভা: প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনকে প্রতিহত করে ক্যাথলিক ধর্মমতকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে পোপ তৃতীয় পল ১৫৪৫-১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইটালির ট্রেন্ট (Trent) শহরে তিনটি ধর্মসভার (Council of Trent) আহ্বান করেন।
- সময়কাল: ট্রেন্টের প্রথম ধর্মসভা চলেছিল ১৫৪৫ থেকে ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দ্বিতীয়টির সময়কাল ছিল ১৫৫১ থেকে ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দ এবং তৃতীয় সম্মেলন চলেছিল ১৫৬২-১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
- উদ্দেশ্য: এই সম্মেলনগুলির উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টান জগতের নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা, ধর্মীয় বিভেদ বা Schism-এর অবসান ঘটানো, চার্চের সংস্কারসাধন, ক্যাথলিক মতবাদকে একটি সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করা ইত্যাদি।
- সভার কাজ: ট্রেন্টের ধর্মসভায় প্রোটেস্ট্যান্টদেরও প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। তবে ক্যাথলিকদের অনমনীয় মনোভাবের জন্য প্রোটেস্ট্যান্টরা ধর্মসভা বর্জন করেন। এখানে ক্যাথলিক ধর্মকে সুসংহত করার জন্য কিছু নীতি-নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়। বলা হয় যে, যাজকেরা সাধুসুলভ পবিত্র জীবনযাপন করবেন। পোপই হবেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান এবং তিনিই খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের প্রধান ব্যাখ্যাকারী। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে খ্রিস্টানরা যেসকল লোকাচার অনুসরণ করতেন, সেগুলি বর্জন করা হয়। ফলে খ্রিস্টান ধর্মের আচারগত আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের বিলোপ ঘটে। এখানে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির ফলে বহু প্রোটেস্ট্যান্ট মতাবলম্বী মানুষ পুনরায় ক্যাথলিক মতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
(5) ইনকুইজিশন ও ইনডেক্স: প্রতি-ধর্মসংস্কারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইনকুইজিশন (Inquisition) ও ইনডেক্স (Index) ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত দমনের অন্যতম হাতিয়ার। স্পেনে প্রথম প্রতিষ্ঠিত ইনকুইজিশন নামক এই বিশেষ ধর্মীয় আদালতের কাজই ছিল রোমান ক্যাথলিক ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদীদের চিহ্নিত করে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করা। অন্যদিকে ইনডেক্স ছিল ক্যাথলিক ধর্মের জন্য ক্ষতিকর নিষিদ্ধ লেখক ও বইয়ের তালিকা (Index of Prohibited Authors and Books) I
(6) জেসুইটদের ধর্মপ্রচার: জেসুইট স্বেচ্ছাসেবকেরা ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারের জন্য দেশে-বিদেশে যাত্রা করেন। এঁরা সক্রিয় রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করতেন। জেসুইটদের সক্রিয় উদ্যোগের ফলে পূর্ব ইউরোপ, ভারত, চিন ও আফ্রিকায় ক্যাথলিক ধর্মের প্রসার ঘটে।
মূল্যায়ন
ক্যাথলিক ধর্মসংস্কার বা প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ভূমিকা আক্রমণাত্মক হলেও এর সাফল্য ছিল সীমিত।
(1) প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা: ক্যাথলিক ধর্মসংস্কার বা প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাগুলি হল- ফ্রান্সের ধর্মযুদ্ধের পর সেখানে ধর্মীয় সহনশীলতা বিরাজ করায় ওখানকার প্রোটেস্ট্যান্টরা আর Heretic বা ধর্মবিরোধী হিসেবে বিবেচিত হতেন না। প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রভাব ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মতো দেশে বিশেষ দেখা যায়নি। এই অঞ্চলগুলিতে প্রোটেস্ট্যান্টবাদ ও ক্যালভিনবাদের ভিত্তি ছিল দৃঢ়। নেদারল্যান্ডেও ক্যালভিনপন্থীরা স্বমহিমাতেই বিরাজ করতেন। তবে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কাউন্টার রিফরমেশন যেমন ক্যাথলিক ধর্মের দুর্নীতি ও অনাচারকে হ্রাস করেছিল, তেমনই সাধারণ জনমানসে রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রতি আস্থাও ফিরিয়ে এনেছিল। তাই এর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর