ফ্রান্সে ধর্মসংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে একটি টীকা লেখো
ফ্রান্সে ধর্মসংস্কার আন্দোলন
ইংল্যান্ডের অষ্টম হেনরি যে সময়ে সেদেশের চার্চগুলির উপর রাজকীয় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে ব্যস্ত, অনুরূপ সময়কালেই ফ্রান্সে লুথারবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ফরাসি ধর্মসংস্কারক জন ক্যালভিন জেনেভায় কর্মকেন্দ্র গড়ে তুলে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু করলে তার প্রভাব ফ্রান্সেও পড়েছিল। প্যারিসের নিকটবর্তী মিউ (Meaux) শহরে স্থানীয় চার্চকে কলুষতামুক্ত করতে কিছু তন্তুবায় শ্রেণির মানুষ উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। জনৈক লুথারপন্থী উইলিয়ম ফেরেল (William Pherel)-এর নেতৃত্বে বাইবেল অধ্যয়নও শুরু হয়েছিল।
(1) প্রথম ফ্রান্সিসের অত্যাচার: প্রাথমিক পর্বে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস (Francis 1) ধর্মসংস্কার আন্দোলনকারীদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি প্রোটেস্ট্যান্টদের উপর নিপীড়ন শুরু করেন। এই অত্যাচার ফরাসি প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে রাজবিরোধী রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করে।
(2) সংস্কারবাদী আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন: ১৫৬০-এর দশক থেকে ফ্রান্সে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল। এই সময় বেশকিছু ফরাসি অভিজাত পরিবার প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদে দীক্ষাগ্রহণ করেন। কিন্তু ফ্রান্সের রাজশক্তি প্রোটেস্ট্যান্টদের এই পুনরুত্থানকে দমন করতে ছিল বদ্ধপরিকর। অবশ্য ফরাসিরাজ দ্বিতীয় হেনরি (Henry II) ও তাঁর উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় ফ্রান্সিস (Francis II)-এর মৃত্যু হলে প্রোটেস্ট্যান্টদের অবস্থার কিছুটা বদল হয়। রাজমাতা ক্যাথরিন (Catherine de Medici)-এর আদেশে ফরাসি প্রোটেস্ট্যান্টদের একটি বড়ো অংশ তথা ফ্রান্সে বসবাসকারী র্যাডিক্যাল ক্যালভিনপথীদের এক অংশ হিউগেনট-রা ধর্মীয় সম্মেলন আহ্বান করার অধিকার লাভ করে। ফলে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনকারী হিউগেনটদের হাত শক্ত হয়ে ওঠে।
(3) ফান্সে ধর্মীয় গৃহযুদ্ধ: হিউগেনটদের আন্দোলনের প্রভাববৃদ্ধি ক্যাথলিকপন্থী অভিজাত শ্রেণি মেনে নিতে পারেননি। এমত পরিস্থিতিতে ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে ভাসি (Vassy) শহরে প্রকাশ্য একটি হিউগেনট সম্মেলনের উপর রাজার সেনাবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা ফ্রান্সে দীর্ঘকালব্যাপী ধর্মীয় গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট সন্ন্যাসী বার্থোলোমিউ-র উপাসনার দিনে একটি নারকীয় হত্যাকান্ড চালিয়ে মেরে ফেলা হয় প্রায় ত্রিশ হাজার হিউগেনটকে। এরপর যদিও ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রোটেস্ট্যান্টরা রাজকীয় নগরগুলি ছাড়া অন্যত্র ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতি পেয়েছিল, কিন্তু তাতে হিউগেনট-ক্যাথলিক সংঘর্ষের পরিসমাপ্তি হয়নি।
(4) গৃহযুদ্ধের অবসান: ফ্রান্সে ধর্মীয় গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে ১৫৯০-এর দশকে, ফরাসিরাজ চতুর্থ হেনরির (Henry IV of France) রাজত্বকালে। চতুর্থ হেনরি আসলে ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট ও বুরবোঁ (Bourbon) বংশীয়। তিনি বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে এডিক্ট অফ নানতেস (Edict of Nantes) ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে হিউগেনটদের কিছু সুযোগসুবিধা দান করেন। ঘোষণাপত্রে ক্যাথলিক ধর্মকেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও হিউগেনটদের স্কুল, ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার অধিকার, সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সমানাধিকার ইত্যাদি প্রদান করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর