মার্টিন লুথারের লোকায়ত দর্শনের মূল বক্তব্য আলোচনা করো
মার্টিন লুথারের লোকায়ত দর্শন
যোড়শ শতকে জার্মানি তথা ইউরোপে সংগঠিত ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন মার্টিন লুথার। তিনি ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত Temporal Authority; To What Extent It Should Be Obeyed শীর্ষক রচনায় লোকায়ত ও আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের পার্থক্য নিরূপণ করার চেষ্টা করেছেন। লুথারের লোকায়ত দর্শনের মূল বক্তব্যগুলি নিম্নরূপ-
(1) দুই রাজ্যের তত্ত্ব: মার্টিন লুথারের মতে, ঈশ্বর পৃথিবীতে তাঁর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দুটি রাজ্যের (Two Kingdoms) মাধ্যমে বজায় রাখেন। প্রথমটি হল খ্রিস্টীয় রাজ্য, দ্বিতীয়টি পার্থিব রাজ্য। এই দুই রাজ্যের প্রজাই হলেন খ্রিস্টানরা।
(2) দুই রাজ্যের শাসন কর্তৃত্ব: লুথার মনে করেন, ধর্মীয় বা খ্রিস্টীয় রাজ্যের সরকার হল, ঈশ্বরের দক্ষিণ হস্ত। এই ধর্মীয় রাজ্য পরিচালিত হয় এক সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ সরকার দ্বারা, যে সরকার হল আত্মার সরকার (A Government of the Soul)। এই সরকারের সঙ্গে পার্থিব জগতের কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। চার্চের সঙ্গে সম্পর্কিত এই রাজ্যের সরকারের লক্ষ্য হল, সম্পূর্ণভাবে খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের মোক্ষলাভে সাহায্য করা।
অন্যদিকে পার্থিব বা লোকায়ত রাজ্যকে লুথার জাগতিক কর্তৃত্বের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরই হলেন লোকায়ত কর্তৃত্বের মূল উৎস। ভগবান এক ধর্মনিরপেক্ষ শাসককে প্রকৃতিতে অসৎ সাধারণ মানুষের এই সমাজে শাসন করতে তরবারি প্রদান করেছেন। এই শাসক সামরিক শক্তি ও আইনের দ্বারা রাজ্য শাসন করবেন। লোকায়ত রাজ্যে আবার পোপ বা বিশপদের কোনও কর্তৃত্ব নেই। চার্চ বা পোপের এখানে কোনোরূপ পার্থিব আইনগত অধিকারের দাবি করা জাগতিক কর্তৃত্বে হস্তক্ষেপ করার শামিল।
(3) রাজশক্তির বিরোধিতা: লোকায়ত রাজ্যে রাজশক্তির বিরোধিতা করার প্রসঙ্গেও লুথার তাঁর স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে, ভগবান যেহেতু পৃথিবীতে শিষ্টকে পালন ও দুষ্টকে দমনের ক্ষমতা দিয়ে পার্থিব রাজশক্তিকে পাঠান, তাই তাঁকে কোনোরকম বাধা দান করা উচিত নয়। তবে ঈশ্বরের প্রতিনিধিস্বরূপ এই ধর্মনিরপেক্ষ শাসক বা রাজা যদি তাঁর কর্তব্যপালনে অক্ষম হন, তাহলে জনগণ সক্রিয় প্রতিরোধ না করে ঈশ্বরের কাছে প্রতিকার প্রার্থনা করবেন। এইভাবে মার্টিন লুথার বাইবেলের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে তাঁর লোকায়ত দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগ থেকে চলে আসা ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ কর্তৃত্বের মধ্যেকার তীব্র তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর