মৌলানা আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা আলোচনা করো
মৌলানা আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা
মৌলানা আজাদ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আজাদের স্বাধীনতার সম্পর্কিত ধারণাকে জানতে হলে তাঁর সার্বিক স্বাধীনতার ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন।
মৌলানা আজাদের স্বাধীনতার ধারণার বিভিন্ন দিক
একজন জাতীয়তাবাদী, স্বাধীনতা সংগ্রামী হওয়ার দরুণ তাঁর বক্তব্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ধারণা ব্যক্ত হলেও এর পাশাপাশি বৌদ্ধিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার কথাও বলেছিলেন, যা সংক্ষেপে আলোচিত হল-
- বৌদ্ধিক স্বাধীনতা : আজাদ শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তার বিকাশের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিকতাকে সমর্থন করতেন এবং শিক্ষা ও জনজীবনে এর বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছিলেন। আজাদ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ইসলামীয় শিক্ষার সঙ্গে সমসাময়িক বিষয়চর্চাকেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তিনি ধর্মান্ধতামুক্ত সমালোচনামূলক মনন বিকাশের জন্য জ্ঞানের পরিধি বিস্তারের কথা বলেন। তাঁর কাছে বৌদ্ধিক বিকাশের অর্থ হল ব্যক্তির মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। এ ছাড়া ভারতীয়দের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে আধুনিকতা গ্রহণে তিনি উৎসাহী ছিলেন। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণ জাতির বৌদ্ধিক বিকাশে অত্যন্ত আবশ্যক। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিপীড়নের ভয় ছাড়াই ব্যক্তি স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার ভোগ করতে পারে।
- সামাজিক স্বাধীনতা: আজাদ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের একজন দৃঢ় প্রবক্তা ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ঐক্যবদ্ধ সমাজই পারে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করতে, যা বাস্তবিক অর্থে ভারতের সামাজিক মুক্তি ঘটাবে। আজাদ জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন আন্দোলন যেমন অসহযোগ, আইন অমান্য, ভারত ছাড়ো প্রভৃতি আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজমুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সুফি পটভূমি, আধ্যাত্মিকতা, সহনশীলতা এবং সকল ধর্মের উপর তাঁর চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল।
- রাজনৈতিক স্বাধীনতা: মৌলানা আজাদ যৌবনকাল থেকেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং ধীরে ধীরে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে শুরু করেন। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সময় থেকে গান্ধিজির নেতৃত্বাধীন অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেন এবং ধীরে ধীরে কংগ্রেস দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন। আজাদ মনে করতেন যে, অহিংসার পথ অবলম্বনের মাধ্যমেই কেবল ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারত স্বাধীনতা লাভ করতে পারে। তিনি গান্ধিজির সঙ্গে মিলিতভাবে খিলাফৎ, অসহযোগ আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টা করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি ডান্ডি অভিযানের মাধ্যমে লবণ সত্যাগ্রহের সূচনা করলে মৌলানা আজাদ সেই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তাঁর আহবানে বেশ কিছু মুসলিম সংগঠন আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। আজাদ মূলত হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মাধ্যমে ভারতকে প্রকৃত রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলেছিলেন।
- গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা: মৌলানা আজাদ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। তিনি মূলত সংখ্যালঘু অধিকার সুরক্ষার স্বার্থে গণতন্ত্রের ধারণার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি একটি মুক্ত সমাজের অনিবার্য উপাদান হিসেবে শিল্প, সাহিত্য এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়কে উৎসাহিত করেছিলেন।
মূল্যায়ন
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে বহুবার বন্দি হওয়া সত্ত্বেও আজাদকে দমিয়ে রাখা যায়নি। কারাগার থেকেই তিনি তাঁর লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধরণকে অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন। স্বাধীন ভারত গঠনের জন্যই দেশের প্রতি তিনি তাঁর তারুণ্য যৌবনকালকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতা এবং আত্মত্যাগ দ্বারা ভারতীয় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরার ক্ষমতার জন্য ভারতের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর