রোমান চার্চের প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্বের কারণগুলি কী ছিল

রোমান চার্চের প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্বের কারণগুলি কী ছিল

রোমান চার্চের প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্বের কারণগুলি কী ছিল
রোমান চার্চের প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্বের কারণগুলি কী ছিল

খ্রিস্টান জগতে রোমান চার্চের মর্যাদাবৃদ্ধির বিষয়টি মধ্যযুগীয় ইউরোপের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যবাহী। রোমান চার্চের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রোমান বিশপও হয়ে ওঠেন প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই পোপ অভিধায় ভূষিত হন। রোমান চার্চ এবং তার বিশপের এই অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্বের মূলে বেশকিছু কারণ সক্রিয় ছিল।

রোমান চার্চের প্রাধান্য / শ্রেষ্ঠত্বের কারণসমূহ

(1) পশ্চিম ইউরোপে প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব: পূর্ব ইউরোপে কনস্ট্যান্টিনোপল, আলেকজান্দ্রিয়া ও অ্যান্টিওক-এর প্রধান বিশপ বা প্যাট্রিয়ার্ক (Patriarch)-দের উপর সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলিতে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত ছিল। ফলত প্রায়শই এই তিন প্রধান বিশপের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিবাদ লেগেই থাকত। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত হওয়ায় রোমান চার্চকে তেমন কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীতার সম্মুখীন হতে হয়নি।

(2) সেন্ট পিটারের ভূমিকা: জিশুখ্রিস্টের প্রধান সহচর সেন্ট পিটার রোমে প্রথম চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রোমান চার্চের প্রথম বিশপ তথা পোপও ছিলেন তিনি। তাঁর মর্যাদা ছিল অসীম। পোপ প্রথম লিও (Pope Leo I) -এর সময়কালে সেন্ট পিটার সম্পর্কে এমন ধারণা প্রচলিত হয় যে, পিটারকে অস্বীকার করার অর্থ হল স্বয়ং প্রভু জিশুকে অস্বীকার করা।  পিটারের আশীর্বাদধন্য হওয়ায় এমনিতেই রোমান চার্চের মর্যাদা অন্যান্য চার্চের থেকে বেশি ছিল। উপরন্তু পিটার ও তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ রোমের শাসক এবং ইহুদিদের শত নির্যাতন সত্ত্বেও রোমে খ্রিস্ট ধর্মের ধ্বজা যেভাবে সমুন্নত রেখেছিলেন, তাতে করে রোমান চার্চ-এর প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(3) রাজধানী হিসেবে রোমের গুরুত্ব: পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী তথা ইউরোপের বৃহত্তম শহর ছিল রোম। তাই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রে অবস্থান করায় রোমান চার্চ খ্রিস্টান জগতে বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী হয়েছিল।

(4) বর্বর আক্রমণ প্রতিরোধে রোমান চার্চ: খ্রিস্টীয় পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে বর্বর জার্মান উপজাতিগুলির ক্রমাগত আক্রমণে রোমের মানুষের জীবন ও সম্পদ সংকটের মুখোমুখি হলে, সেই সময় রোমান পোপই খ্রিস্ট ধর্ম ও সংস্কৃতির একমাত্র রক্ষকরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এর অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ রোমান চার্চ তথা পোপের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। শুধু জার্মান উপজাতিই নয়, পোপ প্রথম লিও দুর্ধর্ষ হুন নেতা অ্যাটিলা (Attila)-কে রোম আক্রমণ হতে বিরত রেখেছিলেন। লোম্বার্ডদের আক্রমণ প্রতিহত করে রোম নগরী রক্ষা করেছিলেন পোপ তৃতীয় গ্রেগরি (Gregory III) 

(5) প্রথম গ্রেগরির অবদান: পোপ প্রথম গ্রেগরি (Pope Gregory I) রোমান চার্চ ও পোপের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্রিটেন, গল, উত্তর ও মধ্য ইউরোপ-সহ বিভিন্ন জায়গায় ধর্মপ্রচার করেন। ফলত এখানকার নবদীক্ষিত খ্রিস্টানরা প্রথম থেকেই রোমান চার্চের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন।

(6) সম্রাটের সঙ্গে পোপের বিবাদ: একাদশ শতকে পোপ সপ্তম গ্রেগরি (Pope Gragory VII) কর্তৃক গৃহীত কিছু পদক্ষেপ (সম্রাটের শাসন বিভাগের অনুকরণে মন্ত্রণাপরিষদ গঠন, আধ্যাত্মিক ও রাজকীয় জীবনে রাজার উপরে পোপের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা) সম্রাটের সঙ্গে পোপের বিবাদকে অনিবার্য করে তোলে। দ্বাদশ শতকে পোপ চতুর্থ অ্যাড্রিয়ান (Pope Adrian IV)-এর আমলে এই দ্বন্দ্ব আরও চরমে ওঠে। যদিও এই পোপ-সম্রাট সংঘাতে শেষপর্যন্ত পোপই জয়ী হন এবং ল্যাটেরান সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজার মনোনীত ব্যক্তিকে পোপ হিসেবে অধিষ্ঠিত করার সম্ভাবনা দূরীভূত হয়।

(7) পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট-এর ভূমিকা: ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় ইনোসেন্ট (Pope Innocent III) পোপের দায়িত্ব গ্রহণ করলে রোমান চার্চ তথা পোপতন্ত্রের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়। *পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট চতুর্থ ক্রুসেডের (১২০২-১২০৪ খ্রিস্টাব্দ) মাধ্যমে জেরুজালেম দখল করেছিলেন। এ ছাড়া ফ্রান্সের অ্যালবিজেনসিয়ান (Albigensians)-দের বিরুদ্ধেও ধর্মযুদ্ধে তিনি জয়ী হন।  পোপের মর্যাদা ও কর্তৃত্ব প্রায় অলঙ্ঘনীয় হয়ে ওঠে। 

(8) পোপের ক্ষমতা বৃদ্ধি: কনস্ট্যান্টিনোপল স্থাপনের পর পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোমের সিংহাসন প্রায়শই শূন্য থাকত। এই পরিস্থিতিতে পোপ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ শুরু করলে রোমান চার্চের প্রধান বিশপ তথা পোপের মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

(9) ফ্রাঙ্ক নৃপতির সঙ্গে পোপের সুসম্পর্ক: ইটালিতে লোম্বার্ডরা আক্রমণ করলে সংকটের মুহূর্তে পোপ দ্বিতীয় স্টিফেন (Pope Stephen II) ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্ক নৃপতি পিপিন (Pepin)-এর সাহায্যপ্রার্থী হন। পোপ এবং ফ্রাঙ্ক শাসকদের মধ্যে স্থাপিত হয় মৈত্রী, যার প্রভাব ছিল দীর্ঘকালব্যাপী। ফ্রাঙ্করাজ লোম্বার্ডদের আক্রমণ রোধ করেন এবং বাইজানটাইন চার্চের ভূসম্পত্তি সেন্ট পিটারের পুণ্যস্মৃতিতে দান করেন। শুরু হয় পোপের নিজস্ব রাজ্য স্থাপনের প্রক্রিয়া।

মন্তব্য

তৃতীয় ইনোসেন্টের সময় রোমের চার্চ তথা পোপের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়ে উঠলেও চতুর্দশ শতকের প্রথম থেকে এই কর্তৃত্ব হ্রাস পেতে থাকে। পোপের বিলাসী জীবন ও দুর্নীতি সীমাহীন হয়ে ওঠে। এসবের ফলে সাধারণ মানুষ পোপের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আস্থা হারায়। আসে ধর্মসংস্কারের যুগ। পরবর্তীতে যদিও ইউরোপীয়দের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে পোপের প্রভাব ছিল, কিন্তু তা আর কখনোই পূর্বের মর্যাদার অনুরূপ ছিল না।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment