পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে নারীসমাজের অবস্থা কেমন ছিল
পঞ্চদশ শতকে নবজাগরণ-প্রসূত মানবতাবাদ ইউরোপকে নতুন আলোয় উজ্জ্বল ও আলোকিত করে তুলেছিল। কিন্তু সেই সময় দাঁড়িয়েও, প্রদীপের নীচে থাকা অন্ধকারের মতোই নারীসমাজও অন্ধকারে থেকে যায়। ব্যতিক্রমী কিছু দৃষ্টান্ত ছাড়া নবজাগরণের আলো তাদের কাছে পৌঁছোয়নি।
নারীদের সামাজিক অবস্থা
(1) শিক্ষার অভাব: সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ইউরোপে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেখানে কেবল ছাত্রদের পঠনপাঠনের ব্যবস্থা ছিল। কোনও ছাত্রীর সেই সুযোগ বা অধিকার ছিল না। এই পর্বে মানবতাবাদী ভাবধারায় মানুষকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার প্রচার হয়। কিন্তু তা সবই ছিল পুরুষদের জন্য, নারীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে।
(2) পণপ্রথা: বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যাপণ বা যৌতুক (Dowry) দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। সেই যৌতুকের অর্থে ছিল স্বামীর একচ্ছত্র অধিকার। বাবা-মা যৌতুকের অর্থ জোগাড় করতে ব্যর্থ হলে কুমারী কন্যার ভবিতব্য ছিল চার্চে সন্ন্যাসিনীর জীবন।
(3) কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা : গৃহকোণের বাইরে সমাজ বা রাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে নারীর প্রবেশ ছিল সীমাবদ্ধ। ষোড়শ শতকে ইউরোপের নারীরা তাঁত বোনা বা পুরুষদের সঙ্গে চাষবাসের কাজের চেয়ে ঘরের কাজেই বেশি সময় ব্যয় করতেন। কারিগরি কাজে দক্ষতা থাকলেও নারীদের কারিগরি গিল্ডে (Guild) সদস্য হওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না। এ ছাড়া যাজকত্ত্বেও নারীদের স্থান ছিল গৌণ। সন্ন্যাস জীবন গ্রহণে আগ্রহী ‘নান’-দেরও পুরুষ যাজকের কাছ থেকে ধর্মীয় পবিত্রতার শপথ (Sacrament) নিতে হত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যায় মঠেও নারীর প্রবেশ অবাধ ছিল না।
(4) নারী নিগ্রহ: আলোচ্য পর্বে নারীরা অত্যাচারের হাত থেকেও রেহাই পায়নি। বাড়িতে গৃহকর্তাদের দাপট এত প্রবল ছিল যে, স্ত্রী নিগ্রহের ঘটনা মাত্রাছাড়া হয়েছিল।
(5) নারীর দায়িত্ব: নারীকে আলোচ্য কালপর্বে কল্পনা করা হয়েছে সাধ্বী স্ত্রী ও সুমাতা হিসেবে। এমনকি লুথারপন্থী, ক্যালভিনপন্থী ও অ্যাংলিকানগণও ধর্ম আন্দোলনে নারীদের ভূমিকাকে বেশ সংশয়ের দৃষ্টিতেই দেখতেন। এঁরা মনে করতেন, প্রধানত একজন কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী এবং মাতা হিসেবে প্রোটেস্ট্যান্ট নারীর দায়িত্ব সীমাবদ্ধ থাকবে। চার্চে তাদের নীরবতা পালনই শ্রেয়। (6)নারীদের ব্যতিক্রমী ভূমিকা: তবে উপরোক্ত পরিস্থিতি সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও দেখা গিয়েছে। যেমন-ব্যবসায়ী ও বণিক পরিবারে বাড়ির মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে ব্যাবসায় সাহায্য করতে পারতেন। বণিক ও ব্যাংকারদের ঘরের বাইরে দূরদেশে কর্মোপলক্ষে থাকার সময় মহিলারা তাদের কাজকর্ম দেখতে পারতেন। বণিক গৃহকর্তার অকালমৃত্যু ঘটলে মহিলারাই সেই কাজ চালাতে বাধ্য হতেন। সেযুগে বস্ত্র বা উলের দ্রব্যাদি বুননের ক্ষেত্রেও নারীদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। তবে এইরূপ কয়েকটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া সর্বত্রই নারীদের অবস্থা ছিল শোচনীয়।
বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের ভূমিকা
বিশিষ্ট লেখক ও কূটনীতিবিদ বালদাসার কাস্টিগলিওনে (Baldassare Castiglione) তাঁর The Book of the Courtier গ্রন্থে (১৫২৮ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন- ‘আমি মনে করি, একজন নারী তার জীবনযাপন পদ্ধতি, ভাবভঙ্গি, আচার-আচরণের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই একজন পুরুষের সাথে তুলনীয় হতে পারে না।’ প্রখ্যাত ফরাসি চিন্তাবিদ বোদাঁও পুরুষের সামাজিক আধিপত্যকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পাশাপাশি নারী এবং পুত্র-কন্যার উপর পুরুষের কর্তৃত্বকে বোদাঁ সোচ্চার কণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন।
মূল্যায়ন
এইভাবে পুরুষশাসিত সমজে অসংখ্য বিধিনিষেধ ও সংস্কারের অধীন নারীজীবন নবজাগরণের যুগেও ছিল গতিহীন, বদ্ধ, একঘেয়ে। ধ্রুপদি সংস্কৃতি পুনর্জাগরণের প্রাণকেন্দ্র ফ্লোরেন্স, ভেনিস, জেনোয়া কোথাও নবসংস্কৃতির চর্চায় নারীদের সামিল করার আন্তরিক প্রয়াস দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর