নবজাগরণ-প্রসূত বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর অবদান উল্লেখ করো
নবজাগরণ শুধুমাত্র একটি যুগ বা সময়ের পরিবর্তন নয়, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা মানবসভ্যতার সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতিতে সহায়তা করে। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের ইউরোপীয় নবজাগরণের রেশ সাহিত্য ও শিল্পের মতো বিজ্ঞানেও দেখা দিয়েছিল। এই পর্বে সায়েনসিয়া (Scientia) বলতে বোঝাত সমগ্র জ্ঞানভাণ্ডারকে আর এই জ্ঞানের বিশেষ বিভাগকে বলা হত প্রাকৃতিক দর্শন (Natural Philosophy) -যার অন্তর্ভুক্ত ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতিষ, অপরসায়ন, ম্যাজিক, গণিত, জ্যামিতি, শারীরবিদ্যা ইত্যাদি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, রেনেসাঁ যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সামাজিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাস ও ধ্যানধারণাকে চুরমার করে বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকগণ নতুন নতুন আবিষ্কারের দ্বারা মানুষকে বিস্মিত করে তুলেছিলেন।
নবজাগরণ-প্রসূত বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বিজ্ঞানীদের অবদান
(1) রজার বেকন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রজার বেকন ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাসংস্কারক। গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, যন্ত্রবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ইত্যাদি নানান শাস্ত্রে তিনি ছিলেন পারদর্শী। সেই কারণেই রজার বেকন বিস্ময়কর ডাক্তার (Doctor Mirabilis) হিসেবে অভিহিত হন। দৃষ্টিবিজ্ঞানের উপর তাঁর গবেষণার সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে চশমা, অনুবীক্ষণ ও দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। মনে করা হয় ইউরোপে তিনিই প্রথম বারুদের ফর্মুলা লিপিবদ্ধ করেন। যুগান্তকারী আবিষ্কার এবং চার্চের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফলস্বরূপ তাঁকে ১৪ বছরের জন্য কারাবরণ করতে হয়েছিল। রজার বেকনের বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হল ওপাস মাজুস (Opus Majus)।
(2) কোপারনিকাস: নবজাগরণের যুগের অপর একজন বড়ো বৈজ্ঞানিক ছিলেন পোল্যান্ডের অধিবাসী নিকোলাস কোপারনিকাস। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে তিনি নানা নতুন তথ্য আবিষ্কার করেন। প্রাচীন কালে পণ্ডিতদের বিশ্বাস ছিল যে, পৃথিবী স্থির এবং সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতি তার চারিদিকে ঘুরছে। কোপারনিকাস বলেছিলেন যে, সূর্য স্থির হয়ে আছে এবং পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহরা তাকে প্রদক্ষিণ করছে। অবশ্য তাঁর এই অভিমত সেই সময় জনসাধারণ বিশ্বাস করেনি। মৃত্যুর আগে ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে লেখা কোপারনিকাসের বিখ্যাত গ্রন্থ অন দ্য রেভলিউশনস অফ দ্য সেলেস্টিয়াল স্পিয়ারস (On the Revolutions of the Celestial Spheres)-এ তিনি যে সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, তাই পরবর্তীতে কোপারনিকাসীয় বিপ্লব (Copernican Revolution)-এর সূচনা করেছিল।
(3) ফান্সিস বেকন: বিজ্ঞানের চর্চা ও সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞানমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে স্যার ফ্রান্সিস বেকনের অবদান উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিজ্ঞানেরও সাধনা করেন। তাঁর উপন্যাসগুলিও ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক। ফ্রান্সিস বেকন অন্ধভাবে কোনও কিছুই বিশ্বাস করতেন না, প্রকৃতিবিজ্ঞান চর্চায় ছিল প্রবল উৎসাহ। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হল নোভাম অর্গানাম (Novum Organum)। ফ্রান্সিস Novum Organum গ্রন্থের প্রচ্ছদ বেকনের মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরে তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইংল্যান্ডে রয়্যাল সোসাইটি (Royal Society) প্রতিষ্ঠিত হয়।
(4) গ্যালিলিও গ্যালিলি: ফ্লোরেন্সের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিদ এবং ইঞ্জিনিয়ার গ্যালিলিও গ্যালিলি। তিনি দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে দূর আকাশের নক্ষত্রের গতিবিধি দেখা সম্ভব হয়। এর দ্বারা গ্যালিলিও প্রমাণ করেন যে, কোপারনিকাসের মত অভ্রান্ত অর্থাৎ পৃথিবী-সহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। বলাবাহুল্য, তাঁর এই আবিষ্কার চার্চের মতের বিরোধী হওয়ায় তাঁকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। শেষজীবনে তিনি অন্ধ হয়ে যান। গ্যালিলিও-র অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পেন্ডুলাম ঘড়ি। এ ছাড়াও নবজাগরণ যুগের বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী ছিলেন লিওন হার্টফুকক্স। শারীরতত্ত্বের উপর ফ্যাব্রিকা নামক গ্রন্থটি লেখেন আন্দ্রেয়াস ভেসালিয়াস। সাইমন স্টেভিন দশমিক পদ্ধতির প্রচলন করেন।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর