নবজাগরণের যুগে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করো
নবজাগরণের যুগে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের অগ্রগতি
নবজাগরণ পর্বে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে যেসকল শিল্পীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন, তাঁদের সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-
(1) জিওতো ডি বনডোনে: ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও স্থপতি ছিলেন জিওওো ডি বনডোনে (Giotto di Bondone, ১২৬৭-১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দ)। অনেকে তাঁকে আধুনিক শিল্পরীতির অগ্রদূত নামে অভিহিত করেছেন। প্রাক্-নবজাগরণ পর্বের এই শিল্পী তাঁর শিল্পে ধর্মের পরিবর্তে বাস্তবজীবনের ঘটনাবলিকে বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে ফ্লোরেন্স ক্যাথিড্রালের ক্যাম্পানিলে বা Bell tower নির্মাণের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন, যা সম্ভবত তাঁর একমাত্র স্থাপত্য প্রকল্প হিসেবে পরিচিত।
(2) ফিলিপ্পো বুনেলেস্কি: অনেকে মনে করেন ফ্লোরেন্সের ফিলিপ্পো ব্রুনেলেস্কি (Filippo Brunelleschi, ১৩৭৭-১৪৪৬ খ্রি.)-ও অন্য শিল্পীদের মতোই রোমের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে ধ্রুপদি স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি এক নতুন স্থাপত্যরীতির জন্ম দেন। ব্রুনেলেস্কির অবিস্মরণীয় কীর্তি হল সেন্ট মেরি ক্যাথিড্রালের (St. Mary’s Cathedral) ডোম। এ ছাড়া পঞ্চদশ শতকের ফ্লোরেন্সের বহু গির্জাই বুনেলেস্কির ধ্রুপদি স্থাপত্যরীতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। তিনি রেনেসাঁ স্থাপত্যের জনক নামেও অভিহিত হন।
(3) দোলাতেল্লো: পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে ভাস্কর্য শিল্পে একটি বিখ্যাত নাম দোনাতেল্লো (Donatello, ১৩৮৬ ১৪৬৬ খ্রি.)। বিভিন্ন চার্চ ও প্রাসাদের বহির্ভাগের অলংকরণের জন্য তিনি যে পাথরের মূর্তিগুলি বানিয়েছিলেন সেগুলিতে ধ্রুপদি শিল্পরীতির প্রভাব স্পষ্ট। তাঁর তৈরি সেন্ট জর্জ (St. George)-এর মূর্তি ছিল মানব শরীরের বাস্তবানুগ প্রতিকৃতি। দোনাতেল্লোর ব্রোঞ্জনির্মিত ডেভিড (David) মূর্তি অসাধারণ শিল্পকর্মের নিদর্শন।
(4) লিও বাতিস্তা আলবার্টি’: মানবতাবাদী শিল্পীদের মধ্যে লিও বাতিস্তা আলবার্টি (Leon Battista Alberti, ১৪০৪ – ১৪৭২ খ্রি.)-র নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি নিজে একজন স্থাপত্যবিদ (Architect) ছিলেন। ফলে ভাস্কর্য ও স্থাপত্য বিষয়ে তিনি বেশকিছু বই লিখেছিলেন। শিল্পীর জগৎ এবং মানবতাবাদী বিদ্যাচর্চার মধ্যে সেতুবন্ধন করে শিল্পীর সামাজিক অবস্থানে রূপান্তর আনেন আলবার্টি।
(5) দোনাতো ব্রামান্ডে: নবজাগরণ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি ছিলেন দোনাতো ব্রামান্তে (Donato Bramante, ১৪৪৪ – ১৫১৪ খ্রি.)। তাঁর অন্যতম সেরা কীর্তি হল রোমে সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকা (St. Peter’s Basilica)-র পরিকল্পনা। তিনি রোমে High Renaissance বা পরিণত নবজাগরণ শিল্পরীতির প্রসার ঘটান। এ ছাড়াও বহু সুন্দর সুন্দর চার্চ ও প্রাসাদ নির্মাণ করেন তিনি।
(6) মাইকেল এঞ্জেলো: নবজাগরণ পর্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর, ভাস্কর ও স্থপতিরূপে মাইকেল এঞ্জেলো বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন রেনেসাঁ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর। মার্বেল খোদাই করে ম্যাডোনা অফ দ্য স্টেয়ারস ভাস্কর্যটি তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। মাইকেল এঞ্জেলোর অপর কালজয়ী একটি ভাস্কর্যের নিদর্শন হল সেন্ট পিটারস গির্জায় প্রতিষ্ঠিত পিয়েতা ভাস্কর্যটি। অপর যে ভাস্কর্য মাইকেল এঞ্জেলোকে অমরত্ব প্রদান করেছিল তা হল ডেভিড-এর নগ্ন মূর্তি ডেভিড এখানে অসীম শক্তির অধিকারী ও গ্রিক দেবতার এক প্রতিরূপ হিসেবে বিবেচিত হন। তাছাড়া বেলজিয়ামের ব্লুজ শহরে সংরক্ষিত ম্যাডোনা ও শিশু জিশুর ভাস্কর্যটি সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে গুইলিয়ানো ও লরেঞ্জো মেডিচির সমাধির নকশা, লরেনন্টিয়ান লাইব্রেরির নকশা প্রস্তুতের ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। জানা যায়, মাইকেল এঞ্জেলো তাঁর জীবনের শেষার্ধে সেন্ট পিটারস গির্জার প্রধান স্থপতির পদে আসীন হন। এই চার্চকে সর্বাশে সুসজ্জিত করার পাশাপশি চার্চের শীর্ষদেশে নির্মিত বিশালাকৃতির গম্বুজ তাঁরই সৃষ্ট।
(7) রাফায়েল: আলোচ্য পর্বের অপর এক স্মরণীয় ইতালীয় চিত্রশিল্পী ও স্থপতি হলেন সানজিও রাফায়েল। রাফায়েলের স্থাপত্যকর্মেরও উল্লেখযোগ্য কিছু নিদর্শন মেলে। এর মধ্যে চ্যাপেল অফ দ্য ম্যাডোনা অফ লরেটো বা চিগি চ্যাপেল, পালাজো ব্র্যাঙ্কোনিও ডেল অ্যাকুইলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর