চিত্রকলায় বত্তিসেল্লির অবদান আলোচনা করো
চিত্রকলায় বত্তিসেল্লির অবদান
ভাষা ও সাহিত্যের মতো নবজাগরণ-প্রসূত মানবতাবাদী চেতনার ছোঁয়া লেগেছিল শিল্পকলার অন্যান্য ক্ষেত্রেও। চিত্রশিল্প এর মধ্যে বিশেষভাবে বিকাশলাভ করেছিল। চিত্রকলার ক্ষেত্রে স্যান্ড্রো বত্তিসেল্লি (Sandro Botticelli, ১৪৪৫-১৫১০ খ্রি.)-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফ্লোরেন্সের বত্তিসেল্লি ছিলেন নবজাগরণ যুগের প্রথম দিকের সুবিখ্যাত চিত্রকর। তিনি নানান বিষয়ের, যেমন- ধর্মীয়, পৌরাণিক, রূপকধর্মী এমনকি প্রতিকৃতি চিত্র অঙ্কনে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
(1) ধর্মীয় চিত্র: বত্তিসেল্লি ধর্মীয় বিষয়ে একাধিক চিত্র অঙ্কন করেছেন। ধর্মীয় চিত্রগুলির মধ্যে ম্যাডোনা বিষয়ক চিত্রকল্পগুলি উল্লেখযোগ্য। যেমন- ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড (Madonna and Child), ম্যাডোনা অফ দ্য ম্যাগনিফিকাট (Madonna of the Magnificat) প্রভৃতি চিত্রগুলিতে মাতৃস্নেহের বিষয়টিই সবথেকে বেশি পরিস্ফুটিত হয়েছে।
(2) পৌরাণিক চিত্র: বত্তিসেল্লি পৌরাণিক বিষয়ে যে চিত্রগুলি অঙ্কন করেছেন, তার মধ্যে বার্থ অফ ভেনাস (Birth of Venus) এবং ভেনাস অ্যান্ড মার্স (Venus and Mars) চিত্রকল্প দুটি উল্লেখযোগ্য। ফ্লোরেন্সের শাসক লরেঞ্জোর পৃষ্ঠপোষকতায় বত্তিসেল্লির বার্থ অফ ভেনাস নামক জীবনমুখী চিত্রটি অঙ্কন করে চিত্রাঙ্কনের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেন। ভেনাস বার্থ অফ ভেনাস ছিলেন সৌন্দর্যের দেবী। এই চিত্রাঙ্কনে বিবস্ত্ররূপে কল্পিত নারীমূর্তি আদৌ কামোদ্দীপক নয়, বরং অনেক বেশি সরল, নিষ্পাপ এবং স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত। নারীকে তিনি মানবী থেকে দেবী, দেবী থেকে প্রতীকে রূপান্তরিত করেছেন। অন্যদিকে বত্তিসেল্লির ভেনাস অ্যান্ড মার্স চিত্রটিতে রোমান পৌরাণিক দেবদেবী ভেনাস ও মার্সের মাধ্যমে সৌন্দর্য ও বীরত্বকে রূপক অর্থে দেখানো হয়েছে।
(3) রূপকধর্মী চিত্র: বত্তিসেল্লির রূপকধর্মী চিত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল প্রাইমাভেরা (Primavera) চিত্রকল্প। এই চিত্রটি পৃথিবীর অন্যতম বিতর্কিত চিত্র। ‘প্রাইমাভেরা’ শব্দের অর্থ বসন্ত। ঐতিহাসিক জর্জিয়ো ভাসারি চিত্রকল্পটিকে প্রথম প্রাইমাভেরা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রূপকধর্মী এই চিত্রটিতে একটি বাগানে পৌরাণিক কিছু চরিত্র একত্রিত হয়েছে। এতে নারীদেহের স্বচ্ছ পোশাকে রোমান্টিক সৌন্দর্য মর্ত হয়েছে।
(4) প্রতিকৃতি চিত্র: নরনারীর প্রতিকৃতি বা Portrait অঙ্কনের ক্ষেত্রেও বত্তিসেল্লি দক্ষ ছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- দান্তের চিত্র, মেডিচি পরিবারের সদস্য গুইলিয়ানো দ্য মেডিচির (Giuliano de’ Medici) চিত্র ইত্যাদি।
মূল্যায়ন
বত্তিসেল্লির চিত্রকল্পগুলির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল, তার অনুভূতি। প্রত্যেকটি চিত্রের অনুভূতি ভীষণ তীব্র। ঐতিহাসিক ভাসারি অনুভূতির দিক থেকে বত্তিসেল্লির চিত্রগুলিকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সমতুল্য বলেছেন। তিনিই প্রথম চিত্রশিল্পের আঙ্গিকে নিও-প্লেটোনিজম এবং পেগান বিষয়ের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। তাঁর সকল ছবিতেই আলো-ছায়া ও রঙের সুষম প্রয়োগ দ্বারা স্বাভাবিকতার পাশাপাশি আত্মার সৌন্দর্যও প্রতিভাত হয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, বত্তিসেল্লির চিত্রকল্পগুলি রেনেসাঁ-পরবর্তী শিল্পীদের প্রভাবিত করে এবং তাঁরা পরিণত নবজাগরণ যুগে (High Renaissance) চিত্রকলার সর্বোত্তম বিকাশ ঘটান।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর