রেনেসাঁ শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
ভাষা ও সাহিত্যের মতো নবজাগরণ-প্রসূত মানবতাবাদী চেতনা শিল্পকলার নানান ক্ষেত্র, যেমন- চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
রেনেসাঁ শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যসমূহ
নবজাগরণ যুগের শিল্পকলা ছিল নানান দিক থেকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, যথা-
(1) মৌলিক সৃষ্টি: মানবতাবাদী শিল্পী-ভাস্করগণ ধ্রুপদি ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করে সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁদের দক্ষতা ও কল্পনার সমন্বয় ঘটিয়ে আরও প্রাণবন্ত ও মৌলিক শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন। পুরোনো বিষয়বস্তুর সঙ্গে নবজাগরিত ভাবধারার এই সুস্থিত মিশ্রণকে জার্মান শিল্প ঐতিহাসিক এরউইন পনোফস্কি (Erwin Panofsky) বলেছেন, Innovatory Synthesis.
(2) বহুমাত্রিক প্রকাশ: মধ্যযুগের চিত্রকলা বা ভাস্কর্যে ধ্রুপদি যুগের শৈলী ও আঙ্গিক অবহেলিত ছিল। ছবিগুলি ছিল একমাত্রিক। নবজাগরণ যুগের শিল্পীরা প্রেক্ষিত (Perspective)-এর ব্যবহার করে শিল্পকর্মকে বহুমাত্রিক রূপ দেন। এই শিল্পশৈলীতে পারিপার্শ্বিক, উঁচুনীচুর আভাস, আলো-ছায়ার ব্যবহার, পার্শ্বরেখা ইত্যাদি চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে ত্রিমাত্রিক প্রকাশ ঘটায়, যা তাঁদের সৃষ্টিকে জীবন্ত ও গতিশীল করে তোলে। দোনাতেল্লোর ব্রোঞ্জ মূর্তি ডেভিড (David) বহুমাত্রিকতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা Virgin of the Rocks চিত্রে আবার Aerial Perspective-এর ধারণাও পাওয়া যায়।
(3) ধর্মীয় ও জীবনমুখী শৈলীর সহাবস্থান: নবজাগরণ পর্বে মানবতাবাদী শিল্পী ও শিল্পচর্চার পৃষ্ঠপোষক যেমন ছিলেন পোপ ও যাজকবৃন্দ, তেমনই ছিলেন নগর-বণিক শ্রেণি ও অভিজাতগণ। ফলে একালের শিল্পচর্চার বিষয়বস্তু হিসেবে ধর্মীয় ভাবনা অর্থাৎ, ক্রুশবিদ্ধ জিশু, ম্যাডোনা, খ্রিস্টান সন্তদের প্রতিকৃতি যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনই ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) বা জীবনমুখী ঘটনাবলি, যেমন- শোভাযাত্রা, হাটবাজার, নৈসর্গিক দৃশ্য ইত্যাদিও রূপায়িত হয়েছে। এমনকি এইসময় অসামান্য সুন্দর বা খুবই সাধারণ মানুষ (পুরুষ ও মহিলা উভয়েই) রেঁনেসা শিল্পীদের প্রতিকৃতি (Portrait) অঙ্কনের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
(4) অন্তর্নিহিত ভাবের প্রকাশ: মধ্যযুগের চিত্র ও ভাস্কর্যগুলির উপস্থাপনা ছিল ভাবাবেগ বর্জিত। দেহগুলির সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত থাকত। তাই দেহসৌষ্ঠবের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য প্রকাশ পেত না। চিত্রকলায় চোখ-মুখ থাকত স্থির, ভাবহীন। নবজাগরণের শিল্পভাবনায় সেই ত্রুটি দূর করা হয়। পোশাকের অন্তরালে শরীরের পেশি ও ভঙ্গিমাগুলি দর্শকের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য হল, মাইকেল এঞ্জেলোর পিয়েতা ভাস্কর্যটি। আবার চিত্রকল্পে চোখ-মুখের অভিব্যক্তি ছবিগুলিকে করে তোলে জীবন্ত। যেমন- লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির শেষ ভোজ (The Last Supper) ছবির চরিত্রগুলির চোখে-মুখে বিস্ময়, আনন্দ, প্রতিহিংসা, বেদনা ইত্যাদি নানা অভিব্যক্তির প্রকাশ সত্যই অভূতপূর্ব।
(5) নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন: রেনেসাঁ শিল্পীগণ তাঁদের শিল্পকীর্তিতে বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করেন। চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে তেল রং-এর ব্যবহার, ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম মার্বেল খোদাই, ব্রোঞ্জ ঢালাই কৌশল, ভাস্কর্য তৈরিতে মোম পদ্ধতি প্রভৃতি নতুন ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার করতেন রেনেসাঁ শিল্পীরা। পরিশেষে বলা যায়, রেনেসাঁর সময়কালে শিল্পক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। ধ্রুপদি ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার ও নতুন কৌশলের উদ্ভাবন করে রেনেসাঁ শিল্পীরা এক নতুন ধারার জন্ম দেন, যা পরবর্তীকালের শিল্পীদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর