মানবতাবাদ সম্পর্কে আলোচনা করো
অথবা, টীকা লেখো- রেনেসাঁ-প্রসূত মানবতাবাদ
মানবতাবাদ
নবজাগরণের যুগে বিজ্ঞান, চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি যেমন সমৃদ্ধ হয়েছিল, তেমনই নতুন নতুন ধারণারও উন্মেষ ঘটেছিল। রেনেসাঁ যুগের এই রকমই একটি ধারণা হল মানবতাবাদ বা Humanism, কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর পন্ডিতগণ ইটালিতে প্রবেশ করলে মানবতাবাদের উন্মেষ ঘটে।
(1) নামকরণ ও ধারণা : ল্যাটিন শব্দ Humanitas থেকে মানবতাবাদ বা Humanism কথাটির উৎপত্তি। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম অব্দে রোমান পণ্ডিত সিসেরোর রচনায় সংস্কৃতি বোঝাতে Humanitas শব্দটির প্রয়োগ লক্ষণীয়। জার্মান শিক্ষাবিদ আধুনিক কালে এফ জে নাইথাম্মের (FJ Niethammer) প্রথম মানবতাবাদ কথাটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে জ্যাকব বুর্খার্ড এই কথাটি জনপ্রিয় করে তোলেন। এককথায় বলতে গেলে, মানবতাবাদ হল মানুষের জীবনের জয়গান। মধ্যযুগে মনে করা হত মানুষ দৈবের অধীন এক অসহায় জীব। তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সবই ঈশ্বরনির্দিষ্ট। ইহজগতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে চার্চ এবং পোপতন্ত্র মানুষের জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তা বা কর্তৃপক্ষ। প্রচলিত এই ধারণাকে নস্যাৎ করে নবজাগরণ যুগের মননশীলতা। এখন থেকে বলা হয়, মানুষের স্রষ্টা ঈশ্বর, কিন্তু মানুষ সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী। তার জীবনকে পরিচালিত করার অধিকারী মানুষ নিজেই। সে আপন সৃজনশীল ক্ষমতা প্রয়োগ করে স্বইচ্ছায় মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। অর্থাৎ মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি এবং তার স্বাধীন প্রকাশ সম্পর্কিত চেতনাই হল মানবতাবাদের মূল শর্ত।
(2) মানবতাবাদী: পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় ইতিহাস, দর্শন, কবিতা ইত্যাদি পাঠদানকারী শিক্ষকদের মানবতাবাদী বলা হত। কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজজীবনে যাঁরা মানবতাবাদী আদর্শের সার্থক প্রয়োগ করেছিলেন, তাঁরাই মানবতাবাদী বা হিউম্যানিস্ট (Humanist) নামে পরিচিত হন। মানবতাবাদীরা অতিলৌকিক, ধর্মীয় কুসংস্কার, যাজকদের দুর্নীতি, সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলেন। তাঁরা তাঁদের লেখনী ও কাজের মাধ্যমে মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার উপর সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মানবতাবাদের জনক ছিলেন ফ্রান্সিসকো পেত্রার্ক। তিনি ছাড়াও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ইরাসমাস, ম্যাকিয়াভেলি প্রমুখের নাম এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
(3) মানবতাবাদের ধারা: ঐতিহাসিকরা মানবতাবাদী আন্দোলনে মূলত দুটি ধারা লক্ষ করেছেন, যথা-
- খ্রিস্টান মানবতাবাদ: ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন হলেও, খ্রিস্ট ধর্মের আদি ও শুদ্ধ আদর্শবাদ থেকে মানবতাবাদীদের প্রেরণা উৎসারিত হয়েছিল। লৌকিক বা বৈষয়িক দৃষ্টিকোণ থেকে মানবতাবাদে সমস্যাসমাধানের প্রয়াস নেওয়া হত। তা সত্ত্বেও, অধ্যাত্মজীবনের ক্ষেত্রে তাঁরা খ্রিস্ট ধর্মের আদর্শ ও বাইবেলের শিক্ষা বিষয়ে পরম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। একেই খ্রিস্টান মানবতাবাদ (Christian Humanism) বলা হয়।
- ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ: আবার ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের (Secular Humanism) ক্ষেত্রে বলা হয়, মানুষ সবমসময় সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে, তাই মানুষের ইতিহাস ধর্মীয় নির্দেশকে মান্য করে লেখা হবে না। ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের অন্যতম অঙ্গ হল নাগরিক মানবতাবাদ (Civic Humanism)। মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মানবতাবাদী ঐতিহাসিকদের একাংশ প্রজাতান্ত্রিক আদর্শকে শ্রেষ্ঠ ও কাম্য বলে প্রচার করেন। সালুতাতি (Salutati), লিওনার্দো বুনি (Leonardo Bruni) ছিলেন এঁদের অন্যতম। এই ধারা ইতিহাসের চরিত্র নতুনভাবে রূপায়িত করে।
(4) মানবতাবাদের আদর্শ: মানবতাবাদের আদর্শ বহু বিস্তৃত মানবতাবাদ শিক্ষা দেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের। মানবতাবাদী ধারণায় মানুষ ঈশ্বর সৃষ্ট জীব কিন্তু সে নিজেই নিজের জীবনের একমাত্র পরিচালক। মানুষের মুক্তচিন্তা ও জীবনমুখী চেতনার প্রকাশ ঘটে মানবতাবাদে। এর অন্যতম আদর্শ হল মানুষের চরম উৎকর্ষ ও মর্যাদাকে তুলে ধরা। মানবতাবাদ ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তিকে প্রাধান্য দেয়।
উপসংহার
রেনেসাঁ যুগে মানুষ নিরপেক্ষ ও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনও বিষয়কে গ্রহণ বা বর্জন করত। মানুষের চিন্তার জগতে এই পরিবর্তনই মানবতাবাদ নামে পরিচিত। Aspects of European History, 1494-1789) গ্রন্থে স্টিফেন জেলি (Stephen J Lee) তাই বলেছেন যে, মানবতাবাদ ছিল রেনেসাঁর যুগে সমস্ত রকম সাংস্কৃতিক অনুপ্রেরণার উৎস, যা সাহিত্য, ইতিহাস, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর