ইউরোপে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে
মধ্যযুগের ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব কোনও আকস্মিক ঘটনা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় বিকাশের ক্ষেত্রে নবম শতকের ক্যারোলিঞ্জীয় রেনেসাঁ ও দ্বাদশ শতকের নবজাগরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গড়ে ওঠার ফলেই শৃঙ্খলাবদ্ধ, যুক্তিনির্ভর এবং সুসংবদ্ধভাবে জ্ঞানার্জন সম্ভব হয়।
ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি
(1) যাজক ও সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতাহাস: মধ্যযুগে চার্চ, যাজক ও সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের। তাই আলোচ্য পর্বে শহরগুলিতে স্থায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উৎসাহ বৃদ্ধি পায়।
(2) আরব পণ্ডিতদের ভূমিকা: ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার পিছনে আরব পণ্ডিতদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। অল মুতামিদ (AI Mutamid), অল কিন্দি (AI Kindi), ইবন বাজ্জা (Ibn Bajja) প্রমুখ পণ্ডিতগণ প্রাচীন ব্যাকরণ, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, অলংকার শাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে চর্চা করতেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টা ইউরোপের মনীষীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল।
(3) বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র: স্পেনীয় পণ্ডিত তারাগো (J Riberay Tarragó) মধ্যযুগে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার পিছনে আরবি শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব লক্ষ করেছেন। মুসলমানরা স্পেন দখল করার পর মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন স্থানে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিচর্চা শুরু হয়। এই সময় টলেডো, কর্ডোভা, ভ্যালেনসিয়া, সারাগোসা, মালোগা ইত্যাদি বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ক্রুসেড শুরু হলে স্পেন থেকে পণ্ডিতেরা ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয় বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়।
(4) সামাজিক প্রয়োজন: আলোচ্য পর্বে ইউরোপীয় নগরগুলিতে ক্রমপ্রসারিত বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিচালনার প্রয়োজনে কেন্দ্রীভূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়। বৃহদাকার বাণিজ্য পরিচালনার জন্য নগরগুলির নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক আইনবিধি, আইনজীবী, চুক্তিপত্রের খসড়া লিখনে দক্ষ কেরানি বা নোটারি (Notary), লিপিকার ইত্যাদির আবশ্যিকতা অনুভূত হয়। এ ছাড়াও সমাজে কূটনীতিবিদ, চিকিৎসক প্রভৃতি শিক্ষিত মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সাধারণ মানুষের কাছে এগুলি নতুন জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে দেখা দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব সহজ হয়।
(5) চার্চের উদ্যোগ: প্রাথমিক পর্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও সংগঠনে চার্চের কোনও ভূমিকা ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে শিক্ষাব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে চার্চ পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, শিক্ষক নির্বাচন, শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মশৃঙ্খলা তৈরি ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় (University) শব্দটি সংঘ বা সংস্থা অর্থেই ব্যবহৃত হত। প্রবাসী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সংঘবদ্ধ হতেন। ইউরোপে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে ইতালীয় নগররাষ্ট্রে। একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে স্থাপিত হয় পাদুয়া (Padua) এবং বোলোনা (Bologna) বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়াও রোম (Rome), পেভিয়া (Pavia), র্যাভেন্না (Ravenna), প্যারিস (Paris) ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ও উল্লেখের দাবি রাখে। মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সমকালীন সমাজজীবনের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। এগুলি সকল শ্রেণির ছাত্রদের আকৃষ্ট করত, ফলে খুব শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অভাবনীয় শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর