ইউরোপে নবজাগরণের কারণ কী ছিল

ইউরোপে নবজাগরণের কারণ কী ছিল

অথবা, ইউরোপে নবজাগরণের পটভূমি আলোচনা করো।

অথবা, চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলি কী ছিল

ইউরোপে নবজাগরণের কারণ কী ছিল
ইউরোপে নবজাগরণের কারণ কী ছিল

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিদের হাতে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটলে ইটালি গ্রিক ও রোমান সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ইউরোপের মানসিক জগতের ভাবপরিবর্তন ঘটে ও নবজাগরণের ক্ষেত্র  প্রস্তুত হয়।

নবজাগরণ বা রেনেসাঁর কারণ / পটভূমি

ইউরোপে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে রূপান্তরের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হল নবজাগরণ বা রেনেসাঁ। রেনেসাঁ সংঘটিত হওয়ার পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল, যেমন-

(1) কুসেডের অবদান: ক্রুসেডের সূত্রে ইউরোপীয় ধর্মযোদ্ধারা প্রাচ্যে এসে এখানকার ভোগবাদী জীবনাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন। প্রাচ্যের মানুষের বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন পদ্ধতি, জীবনকে আনন্দমুখর ও মোহময় করার নানান প্রক্রিয়া, সুস্বাদু খাদ্য প্রভৃতি তাদের আকৃষ্ট করে। প্রাচ্যদেশীয় জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, রসায়ন ইত্যাদি ক্রুসেডারদের মনকে যুক্তিবাদী করে তোলে।

(2) ইটালির নগররাষ্ট্রের পুনবুজ্জীবন: দ্বাদশ শতক থেকে ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী ইতালীয় নগররাষ্ট্রগুলির বাণিজ্যে পুনরুজ্জীবন ঘটে। বাইজানটাইন সাম্রাজ্য এবং ইসলামিক দেশগুলির সঙ্গে ইটালির নবপর্যায়ে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু হলে পশ্চিম ইউরোপের রাজ্যগুলির বাণিজ্যও গতি পায়। ভেনিস, ফ্লোরেন্স, জেনোয়া, পিসা, অ্যামালফি ইত্যাদি স্বাধীন ও প্রজাতান্ত্রিক নগররাষ্ট্রগুলি মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ ও উদারতাবাদের মহত্তর আদর্শের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলে পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে নবজীবনের সূর্যোদয় ঘটে।

(3) নতুন চেতনার উন্মেষ: বাণিজ্যের বিকাশ ও আনুষঙ্গিক আর্থসামাজিক উপাদানের সমন্বয়ে ইটালিতে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই সময় নগরসভ্যতার বিকাশ এবং ধনী পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তার ফলে যুক্তিবাদী সাহিত্যচর্চা, নতুন ধর্মচেতনা, বিজ্ঞানসাধনা, ভৌগোলিক আবিষ্কারের উদ্যোগ ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। প্রকাশিত হয় নতুন নতুন সাহিত্য, গড়ে ওঠে নতুন শিল্পকলা। ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তমনা এই নব-সংস্কৃতি, জগতের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে তাদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলে।

(4) মুদ্রণযন্ত্রের প্রভাব: জার্মানির গুটেনবার্গ আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করলে অল্প সময়ে এবং স্বল্পমূল্যে বই ছাপাবার ব্যবস্থা হয়। ফলে কোনও গুণী ব্যক্তির মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য আর তাঁর কাছে সশরীরে যাওয়ার কিংবা তাঁর সমসাময়িক হওয়ার প্রয়োজন রইল না। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই জ্ঞানলাভের সুযোগ পায়,ফলে নবজাগরণের গতি দ্রুত হয়। 

(5) আদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মানবতাবাদী ধারণা: ইউরোপে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে ইতালীয় নগররাষ্ট্রে। একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যুক্তিনিষ্ঠ, ধর্মনিরপেক্ষ এবং রোমান ও গ্রিক ঐতিহ্যের সমন্বয়ে সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনের পথনির্দেশ করে। ধর্মভাবনার বাইরে এবং ঊর্ধ্বে ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান আহরণের এই প্রাথমিক প্রয়াসকেই পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা মানবতাবাদ Humanism) বলে চিহ্নিত করেছেন।

(6) আরব পন্ডিতদের ভূমিকা: চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রচনাবলির ব্যাপক চর্চা শুরু হয় আরব অনুবাদকদের মাধ্যমে। তাঁরা এই সময়ে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের প্রাচীন নথিপত্র রক্ষণাবেক্ষণ ও অনুবাদ করে ইউরোপীয়দের ধ্রুপদি জ্ঞানভান্ডারের হদিস দেন।

(7) আরবি ও ফারসি সাহিত্যের প্রভাব: আরব পণ্ডিতদের করা গ্রিক সাহিত্যের অনুবাদ পাঠ করে যেমন প্রাচ্যের চিন্তাবিদরা সমৃদ্ধ হন, তেমনই গ্রিক পন্ডিতরাও আরবীয় ও পারসিক সাহিত্য অনুবাদ করে মননশীলতার জগতে রূপান্তর আনেন। এই রচনাগুলির বিষয়বস্তু ছিল মূলত প্রকৃতি বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাবিদ্যা।

মূল্যায়ন

ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনা, ঈশ্বরকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার পরিবর্তে মানবিক চিন্তার প্রসার ইত্যাদি নবজাগরণের পথ প্রস্তুত করেছিল। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ক্রুসেডের প্রভাব, মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদির মতো অনুঘটকও।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment