আধুনিক ইউরোপ গঠনের ক্ষেত্রে ক্রুসেডের কী ভূমিকা ছিল
দুশো বছরব্যাপী ৮টি অভিযান এবং প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের আত্মবলিদান সত্ত্বেও জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করা খ্রিস্টানদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু ক্রুসেড মধ্যযুগীয় ইউরোপের চার্চের প্রাধান্য এবং সামন্তপ্রথার ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক-সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রভূত পরিবর্তনের ফলস্বরূপ আধুনিক ইউরোপ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আধুনিক ইউরোপ গঠনে ক্রুসেডের ভূমিকা
(1) শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উদ্ভব: ক্রুসেডের ফলে সামন্ততন্ত্রের দুটি প্রধান ভিত্তি ম্যানর ব্যবস্থা এবং ভূমিদাসপ্রথা ভেঙে পড়লে ইউরোপের আর্থসামাজিক চিত্রের পরিবর্তন ঘটে। মধ্যযুগীয় ইউরোপে এতদিন রাজা তাঁর পদমর্যাদা ও সামরিক শক্তি নিশ্চিত করার জন্য সামন্তপ্রভুদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু সামন্তদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি, প্রতিপত্তি ও সংখ্যা কমে গেলে রাজতন্ত্রের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ ও সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। উত্তরাধিকারহীন সামন্তদের জমি, অর্থসম্পদ রাজার হস্তগত হয়। রাজার একক অনুচর ও সেনাশক্তি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ সামন্তদের অবর্তমানে রাজার শরণাপন্ন হন। এইভাবে রাজতন্ত্র তার হারানো মর্যাদা ফিরে পায়। শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উত্থান ঘটে। রাজাকে কেন্দ্র করে রাজ্য গঠনের এই মানসিকতা জাতীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি করে।
(2) শিল্প বাণিজ্যের বিকাশ: ক্রুসেড ইউরোপে শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতির পথ সুগম করেছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটে। শিল্পী ও কারিগরি পেশায় নতুন নতুন বহু মানুষের নিযুক্তি ঘটতে থাকে। শিল্পের মধ্যে বস্ত্রবয়ন (সুতি, রেশম, পশম) প্রধান ছিল। ক্রুসেডের হাত ধরে প্রাচ্যের দেশগুলিতে ইউরোপীয় বাণিজ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটে। বাণিজ্যসূত্রে ইউরোপে স্থাপিত হয় বহু নতুন নগর ও শহর। যেমন ভেনিস, জেনোয়া, পিসা, নেপলস, মার্সেই প্রভৃতি।
(3) সামাজিক পরিবর্তন: ক্রুসেডের সূত্রে প্রাচ্যের দেশগুলিতে ইউরোপের সম্প্রসারিত বাণিজ্য ইউরোপের সমাজে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দেয়। যারা বাণিজ্যের হিসাবরক্ষা, সরকারি দফতর পরিচালনা, আইনকানুন চর্চা ইত্যাদি পেশায় যুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে মধ্যযুগের অবসান ও আধুনিক যুগের যে নতুন সূর্যোদয় হয়, তারই ধারক-বাহক ছিল এই নব্য সামাজিক শ্রেণি। ক্রুসেড পরবর্তী সমাজে নারীরা জীবন-জীবিকা, ম্যানর ও জমিদারী প্রভৃতি পরিচালনার দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করে এবং সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
(4) সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি: ক্রুসেড চলাকালীন প্রাচ্য দেশগুলিতে যাওয়া-আসার ফলে খ্রিস্টান জগৎ আঞ্চলিক সংকীর্ণতা মুক্ত হয়। ইউরোপীয় মনীষা ইসলামীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং সৃজনশীল সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় আত্মনিয়োগ করে। ক্রুসেডারদের জীবনী নিয়ে রচিত হয় বীরগাথা। সৃষ্টি হয় সাহিত্য, ইতিহাস, কাব্য। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে জ্ঞানের আদানপ্রদানের সূত্রে এশিয়ার কাগজ, কম্পাস, আতস কাচ প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ইউরোপে পৌঁছোয়। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক নাগাদ ইবন সিনা, ইবন রশিদ ও অন্যান্য আরব পণ্ডিতগণ পশ্চিম ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অধ্যাপনা করতে থাকেন। তাঁদের আরবি ভাষায় রচনাসমূহ ইউরোপে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। ইউরোপীয়দের মধ্যে ভৌগোলিক জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তীকালে সমুদ্রযাত্রা ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের পথ প্রশস্ত করে।
মূল্যায়ন
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ ইউরোপীয়দের চিন্তাভাবনার জগতে আমূল পরিবর্তন এনেছিল। সংকীর্ণ ধর্মচিন্তা, পোপ-সম্রাটের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি গতানুগতিক ঘটনাপ্রবাহের একঘেয়েমি বর্জন করে মানুষ যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়, যা পরবর্তীকালে মধ্যযুগীয় বাতাবরণমুক্ত আধুনিক ইউরোপ গঠনে সহায়তা করেছিল।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর