ক্রুসেডের ধর্মীয় কারণ আলোচনা করো
১০৭১ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক তুর্কিরা আরবদের থেকে প্রভু জিশুর জন্মভূমি জেরুজালেম দখল করে নেয়। এর ফলে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের তীর্থযাত্রায় বাধার সৃষ্টি হয়। এই প্রেক্ষাপটে বিধর্মী তুর্কিদের হাত থেকে পবিত্র জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা পোপ দ্বিতীয় আরবানের আহ্বানে ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডে যোগদান করে। মূলত ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষা থেকেই খ্রিস্টান জগৎ ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করেছিল।
ক্রুসেডের ধর্মীয় কারণসমূহ
(1) পবিত্রভূমি উদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা : প্যালেস্টাইনের অন্তর্ভুক্ত জেরুজালেম (Jerusalem) ছিল খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলমানদের কাছে পবিত্র স্থান। জিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান হিসেবে জেরুজালেম খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্রভূমি। হজরত মুসা ও দাউদ-এর স্মৃতিবিজড়িত হওয়ায় ইহুদিদের কাছেও তা পবিত্রভূমি। আবার হজরত মহম্মদের মিরাজ গমনের স্থান হিসেবে মুসলমানদেরও পবিত্রভূমি ছিল জেরুজালেম। একাদশ শতকের শেষদিকে তুর্কিরা জেরুজালেম দখল করলে খ্রিস্টান জগৎ-ও তৎপর হয়ে ওঠে।
(2) খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের সমস্যা: ইউরোপে একাদশ শতক নাগাদ ন্যান, ম্যাগিয়ার ও ভূমিদাসরা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলে একদিকে যেমন খ্রিস্টানদের সংখ্যা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে পোপ সপ্তম গ্রেগরির মানসিকতার প্রভাবে তারা হয়ে ওঠে উগ্র সাম্প্রদায়িক। তাদের তীর্থযাত্রার প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। ইতিপূর্বে জেরুজালেম আরবদের অধীনে থাকলেও খ্রিস্টানদের তীর্থভ্রমণে কোনও বাধার সৃষ্টি করা হত না। একাদশ শতকের শেষদিকে সেলজুক তুর্কিরা জেরুজালেম দখল করলে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই তুর্কিরা তীর্থযাত্রী খ্রিস্টানদের নানাভাবে বিব্রত করতে থাকে। ফলে খ্রিস্টানদের তীর্থভ্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। এমতাবস্থায় সমস্ত ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান তাদের পবিত্রভূমি উদ্ধারের জন্য আকুল হয়ে ওঠে।
(3) পোপের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা: রোমান চার্চের সঙ্গে গ্রিক চার্চের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে। ফলে শুরু হয় দুই চার্চের মধ্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। রোমান ধর্মগুরু পোপ সমগ্র খ্রিস্টান জগতের উপর তাঁর কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
(4) পিটার দ্য হারমিট-এর প্রভাব: আলোচ্য সময়কালে পিটার দ্য হারমিট (Peter the Hermit) নামে বিখ্যাত এক খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ক্রুশ হাতে, খালি পায়ে ইউরোপের নানান স্থানে ঘুরে জেরুজালেমে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের উপর অত্যাচারের কথা প্রচার করেন। তাঁর প্রচারে ফ্রান্স ও জার্মানির বহু গোঁড়া খ্রিস্টান উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং জেরুজালেমকে তুর্কি দখলমুক্ত করার প্রতিজ্ঞা করে।
(5) মুসলমানদের কর্তৃত্বরক্ষার চেষ্টা: জেরুজালেম কেবলমাত্র খ্রিস্টানদের পবিত্রভূমি ছিল না, হজরত মহম্মদের মিরাজ গমনের স্থান হিসেবে মুসলমানদের কাছেও ছিল পবিত্রভূমি। ফলে, তারাও তাদের তীর্থভূমির পবিত্রতা বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়েছিল। পরিশেষে ঐতিহাসিক মার্গারেট ডিনস্সি (Margaret Deanesly)-র মতানুসারে বলা যায়, ক্রুসেডগুলি ছিল বিধর্মীর হাত থেকে পবিত্র জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য ধর্মযুদ্ধ (The Crusades were religious wars for the capture and defence of Jerusalem.)।
আরও পড়ুন –
১। সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়?
২। ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?
৩। ‘ফিফ’ ও ‘শিভালরি বলতে কী বোঝো?
৪। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো।
৫। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৬। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৭। পোপতন্ত্রের বিকাশের কারণগুলি লেখো।
৮। ইউরোপে মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ (Dark Age) বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
১০। সেন্ট বেনেডিক্ট-এর সংস্কারসমূহ সম্পর্কে লেখো।
১২। টীকা লেখো- ক্লুনির সংস্কার আন্দোলন।
১৩। ওয়ার্মস-এর চুক্তির তাৎপর্য লেখো।
১৪। ক্রুসেড’ কী