ইনভেস্টিচার দ্বন্দ্ব কী
ইনভেস্টিচার দ্বন্দ্ব
৮০০ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট পিটারস গির্জায় উপাসনারত ফ্রাঙ্ক নেতা শার্লাম্যান-এর মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দেন পোপ তৃতীয় লিও। এই প্রতীকী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পোপের সর্বময় কর্তৃত্ব ঘোষিত হয়। সম্রাটপদে মনোনয়নের দায়িত্ব পোপের হাতে ন্যস্ত-এই ধারণা রাজতন্ত্রের উপর পোপতন্ত্রের বিজয় ঘোষণা করে। পরবর্তীকালে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ক্ষমতালোভী পোপদের আমলে পোপ বড়ো না রাজা বড়ো-এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী এক দ্বন্দ্বের, যা ইনভেস্টিচার দ্বন্দ্ব (Investiture Contest) নামে পরিচিত।
(1) পোপ সপ্তম গ্রেগরির প্রচার: ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে সপ্তম গ্রেগরি (Gregory VII) পোপ পদে নির্বাচিত হন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সপ্তম গ্রেগরি নিজেকে খ্রিস্টান জগতের সর্বময় প্রভু বলে মনে করতেন। সম্রাটকে নিয়োগ ও পদচ্যুত করার পূর্ণ ও বৈধ অধিকার একমাত্র পোপেরই আছে বলে তিনি ঘোষণা করেন। এরপর ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে পোপ সপ্তম গ্রেগরি রোমে লেন্ট (Lent)-এ আহ্বান করেন এক সম্মেলনের। এই সম্মেলনে তিনি সিমনি (Simony) F-র অভিযোগে রোমান সম্রাট চতুর্থ হেনরির পাঁচজন প্রধান পরামর্শদাতাকে সমাজচ্যুত করেন। এ ছাড়া অযাজক সামন্তপ্রভু কর্তৃক যাজকদের ক্ষেত্রে ইনভেস্টিচার অনুষ্ঠানকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়। পোপ সপ্তম গ্রেগরি ইনভেস্টিচারের সময় কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবে যে আংটি ও দণ্ড দেওয়া হত, পোপ ঘোষণা করেন যে তা প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র পোপের। এমনকি ও সম্রাট এই আদেশ অমান্য করলে তাঁকেও সিংহাসনচ্যুত করার সতর্কবার্তা দেওয়া হয়।
(2) সম্রাট চতুর্থ হেনরির প্রতিক্রিয়া: রোমান সম্রাট চতুর্থ হেনরি (Henry IV)-ও পোপের আদেশের পাল্টা নির্দেশ জারি করেন। ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্মস শহরে তিনি এক ধর্মীয় সম্মেলন আহ্বান আলোর করেন। সম্রাট তাঁর ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতার বলে সপ্তম গ্রেগরিকে ‘ভণ্ড সন্ন্যাসী’ অভিহিত করে (সপ্তম গ্রেগরির পূর্বনাম হিলডিব্রান্ড। হিলডিব্রান্ড সন্ন্যাস নেননি। কিছুকাল একটি মঠে কর্মচারীরূপে নিযুক্ত ছিলেন) পোপ পদ ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।
(3) দ্বন্দ্বের সূত্রপাত: এইভাবে পোপ সপ্তম গ্রেগরি ও রোমান সম্রাট চতুর্থ হেনরির মধ্যে যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল, তা ইতিহাসে ইনভেস্টিচার দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত। সম্রাটের আদেশের প্রতিবাদে পোপ রোমে লেনটেন (Lenten) ধর্মসভা আহ্বান করে চতুর্থ হেনরিকে সমাজচ্যুত বলে ঘোষণা করেন। এর পাল্টা হিসেবে সম্রাটও মেইনজ (Mainz)-এর এক সভা থেকে পোপকে সমাজচ্যুত ঘোষণা করেন। এর পরিণামে এক সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা হয় (১০৭৬ খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু অধিকাংশ সামন্তই পোপকে সমর্থন জানান। পোপের অনুগামী সম্মিলিত শক্তি জার্মানির বেশকিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। কিন্তু যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে সম্রাট হেনরি পোপের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হন। ক্যানোসার দুর্গে বসে পোপ সম্রাটকে ক্ষমা করেন এবং নিজ শর্তে হেনরিকে সিংহাসন ফিরিয়ে দেন (১০৭৭ খ্রিস্টাব্দ)।
(4) পরবর্তী সংঘাত: ক্যানোসার সমঝোতার পরেও পোপ বনাম সম্রাটের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অব্যাহত ছিল। এমনকি চতুর্থ হেনরি ও পোপ সপ্তম গ্রেগরির দ্বন্দ্ব তাঁদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
(5) ওয়ার্মস-এর চুক্তি: অবশেষে সম্রাট পঞ্চম হেনরি ও পোপ দ্বিতীয় ক্যালিক্সটাস একটি আপসসূত্র বের করতে আন্তরিকভাবে প্রয়াসী হন। ১১২২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্মস-এর কাউন্সিল (Council of Worms)-এ একটি সমাধানসূত্র গৃহীত হয়। এটি Concordat of Worms নামে খ্যাত। এতে স্থির হয় যে, রাজা যাজক-ভূস্বামীদের আংটি ও দন্ড প্রদান করবেন এবং প্রথাগত ইনভেস্টিচারের পরিবর্তে রাজা বিশপকে রাজদণ্ড (Regalia) প্রদান করে Invest করবেন বলে পোপ স্বীকৃত হন। এইভাবে ওয়ার্মসের চুক্তির মাধ্যমে ইনভেস্টিচার দ্বন্দ্বের অবসান হয়। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর পর ইউরোপে তৈরি হয় শান্তির বাতাবরণ।
আরও পড়ুন –
১। সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়?
২। ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?
৩। ‘ফিফ’ ও ‘শিভালরি বলতে কী বোঝো?
৪। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো।
৫। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৬। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৭। পোপতন্ত্রের বিকাশের কারণগুলি লেখো।
৮। ইউরোপে মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ (Dark Age) বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত?