ইউরোপে মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ (Dark Age) বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত
ইউরোপে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ) পরবর্তী সময়কালকে মধ্যযুগ বলা হয়। ধ্রুপদি সভ্যতার অবসান, সর্বব্যাপী খ্রিস্টীয় নিয়ন্ত্রণ, সামন্ততন্ত্রের উত্থান ইত্যাদি ঘটনা ইউরোপের সমাজকে এক গতিহীন, স্থবির ও অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে নিমজ্জিত করেছিল। তাই বহু লেখক ও গবেষক ইউরোপের মধ্যযুগকে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলার পক্ষপাতী। চার্লস ওম্যান (Charles Oman) তাঁর মধ্যযুগের ইতিবৃত্তের নাম দিয়েছেন The Dark Age. তাঁদের দৃষ্টিতে মধ্যযুগ এবং অন্ধকার যুগ সমার্থক। তবে মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ বলা যায় কিনা, সেই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
অন্ধকার যুগ বলার সপক্ষে যুক্তি
(1) জ্যাকব বুর্খার্ড-এর বক্তব্য: মধ্যযুগ সম্পর্কে একই মত পোষণ করেন বিশিষ্ট সুইস পণ্ডিত জ্যাকব বুর্খার্ড (Jacob Burckhardt)। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত The Civilization of the Renaissance in Italy গ্রন্থে তিনি পঞ্চম থেকে চতুর্দশ শতককে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ (Dark Age) বলেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি অন্ধকার যুগ বলার পিছনে যে যুক্তিগুলি দিয়েছেন, সেগুলি হল
- ধ্রুপদি সভ্যতার অবসান: রোমান সাম্রাজ্যের পতন, জার্মান উপজাতির (ভ্যান্ডাল, ভিসিগথ ইত্যাদি) আক্রমণ ইত্যাদির ফলে পশ্চিম ইউরোপ বিদ্ধস্ত হয়ে পড়েছিল। অবসান ঘটেছিল ইউরোপীয় ধ্রুপদি সভ্যতার।
- খ্রিস্ট ধর্মের সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ: মধ্যযুগে খ্রিস্টান চার্চ ও পোপতন্ত্রের সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়। মঠজীবনবাদ ইউরোপীয় সমাজকে করে তুলেছিল অচল, বদ্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
- সামন্ততন্ত্রের দাপট: মধ্যযুগে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে সামন্ততন্ত্রের দাপট পরিলক্ষিত হয়। ভূমিদাসদের শোষণ, সকলপ্রকার মানবিক অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা ইত্যাদি ইউরোপীয় সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
অন্ধকার যুগ বলার বিপক্ষে যুক্তি
আধুনিক অর্থাৎ, ১৯৪০-এর দশকের পরবর্তী ইতিহাসচর্চায় ইউরোপে পঞ্চম থেকে চতুর্দশ শতককে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলার বিরোধিতা করা হয়।
(2) জিওফ্রে ব্যারাক্স-এর বক্তব্য: ইংরেজ ঐতিহাসিক জিওফ্রে ব্যারাক্ল (Geoffrey Barraclough)-এর মতে, অন্ধকার যুগ থেকে হঠাৎ করে নবজাগরণের আবির্ভাব ঘটেনি অর্থাৎ, মধ্যযুগ থেকে নবজাগরণের যুগে উত্তরণকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তথাকথিত মধ্যযুগ এবং যুক্তিবাদী আধুনিক যুগের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা ছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি নবম শতকের ক্যারোলিঞ্জীয় নবজাগরণ ও জার্মানিতে ওটোনিয়ান (Ottonian) রাজত্বের সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন।
(3) চার্লস হোমার হ্যাস্কিন্স-এর বক্তব্য: মার্কিন ঐতিহাসিক চার্লস হোমার হ্যাস্কিন্স (Charles Homer Haskins) তাঁর The Renaissance of the Twelfth Century গ্রন্থে বলেছেন যে, দ্বাদশ শতকীয় ইউরোপের একটা তাজা ও প্রাণবন্ত ইতিহাস ছিল। ক্রুসেডের যুগ, শহরের উত্থান, গথিক শিল্পের সূচনা, ল্যাটিন কাব্য-সাহিত্যচর্চা এবং সর্বোপরি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব ধ্রুপদি সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে গতিময় করে রেখেছিল।
মূল্যায়ন
আলোচনায় উল্লিখিত যুক্তিগুলি বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, মধ্যযুগীয় ইউরোপে সভ্যতা-সংস্কৃতির অনিবার্য ধ্বংসের ভীতি এতটাই প্রবল ছিল যে, ঐতিহাসিকেরা পঞ্চম শতকের পরবর্তী চার শতক সময়কালকে অন্ধকার যুগ বলেছেন। কিন্তু বাস্তবচিত্র এতটাও অন্ধকারময় ছিল না। ঐতিহ্য তার সহজাত নিয়মে নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন –
১। সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়?
২। ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?
৩। ‘ফিফ’ ও ‘শিভালরি বলতে কী বোঝো?
৪। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো।
৫। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?