সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো

সামন্ততন্ত্রের উত্থান যেমন ধীরগতিতে হয়েছিল, সেরকম এর পতনও ঘটেছিল মন্থরগতিতেই। ইউরোপের সর্বত্র একইসঙ্গে সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটেনি।

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণসমূহ

সামন্ততন্ত্রের পতন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানান মত রয়েছে। মরিস ডব, পল সুইজি, মাইকেল পস্টান, রবার্ট ব্রেনার প্রমুখ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সামন্ততন্ত্রের পতনকে ব্যাখ্যা করেছেন-

(1) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব: ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ মরিস ডব তাঁর স্টাডিজ ইন দ্য ডেভেলপমেন্ট অফ ক্যাপিটালিজম (Studies in the Development of Capitalism) গ্রন্থে (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ) দেখিয়েছেন যে, সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই এই ব্যবস্থার পতনের মূল কারণ। তাঁর মতে, সামন্তপ্রভুরা জমিতে নিম্নমানের কৃষি প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার করায় উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়। ফলে সামন্ততন্ত্রের মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ (প্রভু ও দাসশ্রমিক) শুরু হয়, তার ফলে সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটে।

(2) বাণিজ্য ও নগরের বিকাশ: মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল সুইজি (Paul Sweezy) মরিস ডব-এর এই অভ্যন্তরীণ বিরোধতত্ত্ব মানতে রাজি হননি। তিনি সায়েন্স অ্যান্ড সোসাইটি (Science and Society) পত্রিকায় (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) Feudalism: A Critique প্রবন্ধে সামন্ততন্ত্রের পতনের কারণ হিসেবে বাণিজ্যিকীকরণ (Commercialisation) তত্ত্ব উত্থাপন করেন। সুইজির মতে, বাণিজ্যের অবক্ষয় যেমন সামন্ততন্ত্রের পথ প্রস্তুত করেছিল, তেমনি বাণিজ্যে নতুন জোয়ার সামন্তব্যবস্থাকে ঠেলে দিয়েছিল পতনের দিকে। একাদশ শতকে পশ্চিম ইউরোপে বাণিজ্যবৃদ্ধি ও নগরায়ণের সূত্রে সামন্তপ্রভুরা প্রজাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করলে তারা ম্যানর থেকে বিকল্প জীবনের সন্ধানে পালিয়ে যেতে থাকে। ফলে উৎপাদন ক্রমশ বাজারমুখী হয়ে উঠতে থাকলে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে সামন্ততন্ত্রের অবসান সূচিত হয়।

(3) জনসংখ্যা হ্রাস: ঐতিহাসিক মাইকেল পস্টান (Michael M Postan) মনে করেন, Black Death-এর প্রভাবে ইউরোপের জনসংখ্যা ৪০% হ্রাস পেলে সামন্তপ্রভুরা কৃষি শ্রমিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করতে বাধ্য হন। তাছাড়া জনসংখ্যা হ্রাস পেলে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা দুর্বল হয় এবং সামন্ততন্ত্রের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

(4)  সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি: মার্কিন ঐতিহাসিক রবার্ট ব্রেনার (Robert Brenner) তাঁর এগ্রারিয়ান ক্লাস স্ট্রাকচার অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট ইন প্রি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউরোপ (Agrarian Class Structure and Economic Development in Pre-Industrial Europe) নামক প্রবন্ধে সামন্ততন্ত্রের পতনের জন্য সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের অবস্থানের পাশাপাশি রাজতন্ত্রের আইনগত উপস্থিতি ছিল। অন্যদিকে, পূর্ব ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কোনও শক্তিশালী রাজতন্ত্র ছিল না। রাজ্য বা রাজা থাকলেও তা ছিল দুর্বল। ফলে নিরাপত্তার জন্য সাধারণ মানুষ সামন্তপ্রভুদের উপর নির্ভর করত। এই কারণেই পশ্চিম ইউরোপে সামন্তব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও পূর্ব ইউরোপে চতুর্দশ শতকের পরেও তার অস্তিত্ব বজায় ছিল।

(5) কৃষকদের বিদ্রোহ : সামন্ততন্ত্রের অন্তিম পর্বে ম্যানরকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সামন্তপ্রভুরা তাঁদের অধীনস্থ কৃষকদের উপর তীব্র অত্যাচার চালালে শুরু হয় কৃষক বিদ্রোহ। এই সমস্ত বিদ্রোহগুলি চতুর্দশ শতকের অন্তিম পর্বে তীব্র আকার ধারণ করলে সামন্ততন্ত্রের পতন নিশ্চিত হয়।

(6) ভূমিদাসদের বিদ্রোহ: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভূমিদাসদের উপর সামন্তপ্রভুরা নানারকম অত্যাচার ও কর আদায় করতেন, ফলে কার্যত তাদের কোনও স্বাধীনতা ছিল না। সামন্তপ্রভুদের সীমাহীন শোষণ ও অত্যাচারের দরুন ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ভূমিদাস বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এর ফলে সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে তার পতন ত্বরান্বিত হয়।

আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment