সামাজিক চুক্তি মতবাদের উপর একটি সমালোচনামূলক সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ রচনা করো
সামাজিক চুক্তি মতবাদ
টমাস হবস (Thomas Hobbes), জন লক (John Locke) ও জাঁ জ্যাক রুশো (Jean Jacques Rousseau) প্রবর্তিত সামাজিক চুক্তি মতবাদটি রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা হিসেবে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই মতবাদের মূল বক্তব্য হল- মানব ইতিহাসে এমন এক সময় ছিল যখন মানুষের মধ্যে কোনোরকম রাজনৈতিক বোধ বা চেতনা ছিল না। এসময় মানুষ বাস করত প্রাকৃতিক রাজ্যে (State of Nature) | কিন্তু ক্রমশ নানা কারণে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলে, তা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তির মাধ্যমেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।
সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালোচনা
সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্র গঠনের যতই নির্ভরযোগ্য মতবাদই হোক না কেন, তা পরবর্তীকালে সমালোচকদের সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে যেতে পারেনি। এই মতবাদের বিরুদ্ধে যেসব সমালোচনা উত্থাপিত হয় তা নিম্নরূপ-
(i) অনৈতিহাসিক: সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগটি হল আলোচ্য রাষ্ট্রতত্ত্বটি ইতিহাস-স্বীকৃত নয়। কারণ, চুক্তির মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রের উৎপত্তির বিষয়টি অদ্যাবধি ইতিহাসচর্চায় প্রমাণিত হয়নি। প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক হিউম (David Hume)-সহ অনেকেই মনে করেন, এই তত্ত্বটি অনৈতিহাসিক।
(ii) অবৈজ্ঞানিক: চুক্তি সম্পাদনের জন্য দুটি পক্ষের উপস্থিতি দরকার। কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষদের অভিন্ন স্বার্থ বিবেচনা করে তাদের একটি পক্ষ হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু একটিমাত্র পক্ষের উপস্থিতিতে চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে না। অন্যদিকে সামাজিক চুক্তিতত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রের উদ্ভব দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে হয়নি, মানুষ নিজের ইচ্ছানুযায়ী রাষ্ট্র তৈরি করেছে। আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় যা পাওয়া যায় তা হল- রাষ্ট্র সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে। কাজেই সামাজিক চুক্তিতত্ত্ব অবৈজ্ঞানিক।
(iii) অযৌক্তিক ও অবিশ্বাস্য: যেহেতু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনৈতিক আইন ছাড়া কোনও বৈধ চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে না, তাই এই মতবাদটি অযৌক্তিক। পাশাপাশি, প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষের রাষ্ট্র সম্বন্ধে কোনও ধারণাই ছিল না। তাই রাষ্ট্র, এমনকি সমাজ সৃষ্টিরও পূর্বে চুক্তির কল্পনা করা একটি অবিশ্বাস্য বিষয়।
(iv) বিপজ্জনক: সামাজিক চুক্তিতত্ত্বের একটি বিপজ্জনক দিক আছে। এই তত্ত্বানুযায়ী মানুষ স্বেচ্ছায় রাষ্ট্র তৈরি করেছে। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে সঙ্গতভাবে অনুমান করা যেতে পারে যে, সে যে-কোনো সময়ে নিজের ইচ্ছানুযায়ী রাষ্ট্র ভেঙে দিতে পারে। তাই বার্ক (Burke), ব্লুন্টসলি (Bluntschli) প্রমুখ এই মতবাদটিকে বিপজ্জনক বলে সমালোচনা করেছেন।
(v) প্রাকৃতিক অধিকার বা স্বাধীনতার অস্থিত্ব অসম্ভব: সামাজিক চুক্তি মতবাদে প্রাকৃতিক অবস্থার স্বাভাবিক অধিকার ও স্বাভাবিক স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এই ধারণা ভ্রান্ত। অধিকার হল একটি সামাজিক ধারণা। সভ্য সমাজব্যবস্থার বাইরে অধিকারের প্রশ্ন অকল্পনীয়। তাছাড়া রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ ছাড়া অধিকার বা স্বাধীনতার সৃষ্টি হতে পারে না।
(vi) স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর: সামাজিক চুক্তিবাদীরা মনে করেন যে, প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষেরা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করত। কিন্তু বাস্তবে আইন ছাড়া স্বাধীনতার অস্তিত্ব অসম্ভব। আইনবিহীন প্রাকৃতিক অবস্থায় স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতারই নামান্তর।
(vii) ইতিহাসের বিকৃতিসাধন: সামাজিক চুক্তি মতবাদ অনুযায়ী মানুষ ব্যক্তি হিসেবে চুক্তি সম্পাদন করে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটায়। কিন্তু গেটেলের (Gettell)-এর মতে, মানব ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজের একক ছিল পরিবার ও পরিবারের সবাই যৌথভাবে সম্পত্তি ভোগ করত। তখন সমাজের একক হিসেবে ব্যক্তির গুরুত্ব এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব স্বীকৃত ছিল না। এদিক থেকে বিচার করে অনেকে ইতিহাসের বিকৃতিসাধনের জন্য চুক্তি মতবাদকে দায়ী করেন।
(viii) রাষ্ট্রের আধুনিক ধারণার পরিপন্থী: রাষ্ট্রের সদস্যপদ গ্রহণ করা বা না করা ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু সামাজিক চুক্তি মতবাদ, চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা প্রচার করে বস্তুতপক্ষে রাষ্ট্রের সভ্যপদ গ্রহণ করা বা না-করাকে ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছে। তাই এরূপ মতবাদকে রাষ্ট্রের আধুনিক ধারণার পরিপন্থী বলে মনে করা হয়।
(ix) অবাস্তব: চুক্তি একটি সামাজিক ধারণা। ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটলেই চুক্তির সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশের আদিম অবস্থায় বিনিময়প্রথা ছিল। তখন চুক্তি সম্পাদনের উপযোগী ব্যাবসাবাণিজ্য ছিল না। ইতিহাসের এই পর্যায়ে চুক্তি কোনোভাবে সম্ভব ছিল না।
(x) রাষ্ট্রকে অংশীদারি কারবারের পর্যায়ভুক্ত করা: সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রকে ‘অংশীদারি কারবারে’ পর্যবসিত করেছে। কিন্তু রাষ্ট্র আর অংশীদারি কারবার সমপর্যায়ভুক্ত নয়। অংশীদারি কারবারের সঙ্গে অংশীদারদের সম্পর্ক ও রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক এক নয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বস্তুত অংশীদারদের স্বার্থসিদ্ধি না হলে অংশীদারি কারবারের মতো রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলা যায় না।
(xi) অসম্পূর্ণ মতবাদ: এই মতবাদটি একটি অসম্পূর্ণ মতবাদ। কেন-না, রক্তের সম্পর্ক, ধর্ম, বলপ্রয়োগের মতো রাষ্ট্রসৃষ্টির অন্যান্য উপাদানগুলি এই মতবাদে উপেক্ষিত হয়েছে।
(xii) জনমতের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ: সামাজিক চুক্তি মতবাদে জনমতকে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু জনমত সবসময় বিচারবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয় না। অনেকসময় অজ্ঞ, অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনমতের আধিক্য দেখা যায়। ফলে এদের দ্বারা যে সুন্দর কল্যাণকামী রাষ্ট্র গড়ে উঠবে, তা অকল্পনীয়।
মূল্যায়ন: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে সামাজিক চুক্তি মতবাদের নানাপ্রকার ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও এর গুরুত্বকে কোনোভাবে অস্বীকার করা যায় না। এই মতবাদে দেখানো হয়েছে যে ঈশ্বরসৃষ্ট নয়, রাষ্ট্র একটি মানবীয় প্রতিষ্ঠান। পাশবিক শক্তির পরিবর্তে জনসাধারণের ইচ্ছাকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও অস্তিত্বরক্ষার সর্বপ্রধান উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তত্ত্বের মধ্য দিয়েই সাম্য, মৈত্রী, ন্যায়-এর মতো গণতান্ত্রিক নীতিসমূহ, আধুনিক সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব, রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্যের মতো বিষয়গুলিকে তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া, সামাজিক চুক্তি মতবাদকে ভিত্তি করে শুধু গণতন্ত্র নয়, ব্যোমের হিতবাদ (Utilitarian Theory), মন্তেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (Separation of Power), লকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Individualism) ইত্যাদি মতাদর্শের ভিত রচিত হয়। এ ছাড়া পৃথিবীর তিনটি যুগান্তকারী ঘটনা- গৌরবময় বিপ্লব (Glorious Revolution, ১৬৮৮-১৬৮৯ খ্রি.), আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (American Independence War, ১৭৭৫-১৭৮৩ খ্রি.) এবং ফরাসি বিপ্লব (French Revolution, ১৭৮৯-১৭৯৯ খ্রি.) সামাজিক চুক্তি মতবাদের দ্বারা যে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর