রুশোর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করো

রুশোর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করো

রুশোর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করো
রুশোর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করো

রুশোর রাষ্ট্রদর্শন

জাঁ জ্যাক রুশো (Jean Jacques Rousseau) ছিলেন অষ্টাদশ শতকের রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর The Social Contract (১৭৬২ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থটিতে রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মতামতের সন্ধান পাওয়া যায়। রুশোর রাষ্ট্রদর্শনের বিভিন্ন দিকগুলি হল-

(i) প্রকৃতির রাজ্য: বুশো তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে প্রাক্-রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রকৃতির রাজ্যের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, প্রকৃতির রাজ্য ছিল মর্ত্যের স্বর্গ। প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত এবং তাদের মধ্যে কোনোরকম হিংসার পরিবেশ ছিল না। এখানে মানুষ ছিল সৎ, সহানুভূতিশীল ও স্বাধীন। তারা সকলে সমান সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারত।

(ii) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা: প্রকৃতির রাজ্যে সুখে থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে মূলত তিনটি কারণে, মানুষ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে পা বাড়ায়। যথা-

  • জনসংখ্যা বৃদ্ধি: জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ, সীমিত প্রাকৃতিক সামগ্রীর অধিকার নিয়ে মানুষে সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে মানুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এর ফলে মানুষে তীব্র সংঘাত দেখা দেয়।
  • ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব: ব্যক্তিগত শুরু হয় ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সংঘাত, হত্যা ও যুদ্ধবিগ্রহ।
  • শুভবুদ্ধি ও যুক্তির উন্মেষ: একদিকে প্রকৃতির রাজ্যের স্বর্গসুখ দূর হয়ে অশান্তি নেমে আসে এবং অপরদিকে মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি ও যুক্তির উন্মেষ ঘটে। এই কারণগুলির দরুন মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে।

(iii) সামাজিক চুক্তি: বুশো তাঁর The Social Contract গ্রন্থে যে সামাজিক চুক্তির কথা বলেছেন, সেখানে তাঁর চিন্তার স্বকীয়তা প্রকাশিত হয়েছে। বুশোর মতে, প্রকৃতির রাজ্যে বসবাসকারী মানুষ পরস্পরের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সমস্ত অধিকার কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্পণ করেনি, তারা সমস্ত অধিকার অর্পণ করেছিল সমগ্র সমাজের কাছে। বুশো একেই সামাজিক চুক্তি বলেছেন।

(iv) জনগণের অধিকার: সামাজিক চুক্তির (Social Contract) মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে, সাধারণের ইচ্ছার কাছে নিজস্ব সত্তা ও ক্ষমতা অর্পণ করে মানুষ একদিকে যেমন নিরাপদ জীবনের সম্ভাবনাকে সুনিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে তেমনই সামাজিক ও নৈতিক স্বাধীনতার অধিকারী হয়ে উঠেছে। রুশো শান্তিপূর্ণ দাসত্বের চেয়ে বিপদসংকুল স্বাধীনতাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছেন।

(v) সাধারণ ইচ্ছা বা General Will: রুশোর বিখ্যাত তত্ত্ব হল সাধারণ ইচ্ছা (General Will)-র তত্ত্ব। রুশোর মতে, আদিম মানুষ সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে যে সম্মিলিত শক্তি গড়ে তুলেছিল তাই হল সাধারণ ইচ্ছা। প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ যে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা ভোগ করত, তা সমস্ত সমর্পণ করে সকলের সম্মিলিত শক্তির কাছে। তাই সব কিছু সমর্পণ করেও মানুষ কিছুই হারায় না। আসলে সে ব্যক্তি হিসেবে যা হারাল, সমগ্রের অংশীদার হিসেবে তার সবটাই ফিরে পেল। ফলে সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছার অধীন হয়েও প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন থেকে গেল। রুশো বলেছেন, প্রত্যেক মানুষের দুই ধরনের ইচ্ছা থাকে- প্রকৃত ইচ্ছা (Real Will) এবং বাস্তব ইচ্ছা (Actual Will)।

  • প্রকৃত ইচ্ছা: প্রকৃত ইচ্ছা হল সকল মানুষের মৌলিক, বিশুদ্ধ ও স্বভাবগত ইচ্ছা, যা সব মানুষের ক্ষেত্রে এক। এই ইচ্ছা সকল মানুষের মঙ্গল করার ইচ্ছা বা Common Good.
  • বাস্তব ইচ্ছা: বাস্তব ইচ্ছা হল প্রতিটি মানুষের নিজের নিজের স্বার্থপূরণ করার ইচ্ছা।

রুশোর মতে, সামাজিক চুক্তিজাত সাধারণ ইচ্ছা হল সকল মানুষের Common Good নির্দেশিত প্রকৃত ইচ্ছার গুণফল। ক্ষুদ্র স্বার্থে পরিচালিত ব্যক্তি সাধারণ ইচ্ছার নির্দেশ অমান্য করলে তাকে বলপ্রয়োগ করে সাধারণ ইচ্ছা মান্য করতে বাধ্য করা হবে।

(vi) সার্বভৌমিকতা: বুশো মনে করতেন, সাধারণ ইচ্ছা ও সার্বভৌমের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। তিনি বলতেন, সাধারণ ইচ্ছা সমন্বিত সমাজই হল সার্বভৌম। রুশোর সার্বভৌম কোনও ব্যক্তির মধ্যে আবদ্ধ নয়। তাঁর মতে, কোনও ব্যক্তি বা সরকার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না।

(vii) আইন এবং আইনপ্রণেতা:

  • আইন: সর্বসাধারণের ইচ্ছাকেই বুশো আইন বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, যখন সাধারণের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে সকলের ইচ্ছা, সকল ব্যক্তির উপরেই আদেশ হিসেবে জারি হয়, তখন তাকে আইন বলে।
  • আইনপ্রণেতা: বুশো মনে করেন, যে প্রজারা আইনের আনুগত্য মেনে নেয়, তাদেরই আইনপ্রণেতা হওয়া উচিত। তাঁর মতে, আইনপ্রণেতা এমন এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি শাসকের থেকেও মূল্যবান। ব্যক্তির ইচ্ছা ও বুদ্ধির সঙ্গে সমাজের ইচ্ছাকে যুক্ত করে এবং ব্যক্তির শক্তিকে সমাজের শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সমাজদেহকে অপরাজেয় করে তোলেন আইনপ্রণেতাই।

(viii) শাসনব্যবস্থা বা সরকার: শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গে রুশো বলেছেন যে, রাষ্ট্রদেহে দুটি পৃথক ক্ষমতার অস্তিত্ব বিদ্যমান- আইন-প্রণয়নী ক্ষমতা বা সার্বভৌম ক্ষমতা এবং শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা। জনগণের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকলেও, তা প্রয়োগ করার ক্ষমতা থাকবে সার্বভৌমের নিজস্ব শক্তি অর্থাৎ সরকারের হাতে, যে শাসক ও প্রজাদের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করবে। সরকারের দায়িত্ব হল আইনের প্রয়োগ ও প্রজাদের স্বাধীনতা রক্ষা করা।

শাসনব্যবস্থার আলোচনায় রুশো তিন ধরনের সরকারের কথা বলেছেন, যথা-

  • গণতন্ত্র: এই শাসনব্যবস্থায় সরকার গঠন এবং সরকারি কার্যকলাপে নাগরিকরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
  • অভিজাততন্ত্র: এই ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে সার্বভৌম কর্তৃক শাসনভার অর্পিত হয়।
  • রাজতন্ত্র: এই ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তির হাতে সার্বভৌম সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করে, অর্থাৎ একজনের শক্তিতেই সরকার শক্তিশালী।

রুশো মনে করেন, যে সরকার ব্যক্তিগত সুখসুবিধা, শাসকদের সুযোগসুবিধা প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে শুধুমাত্র গণ-ইচ্ছার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে কাজ করে, সেই সরকারই শ্রেষ্ঠ সরকার। *2

মূল্যায়ন: রুশোর রাষ্ট্রতত্ত্ব ত্রুটিমুক্ত ছিল না। স্বৈরাচারী উপাদানযুক্ত, সংশয়পূর্ণ, যুক্তিহীন বিষয়বস্তু প্রভৃতি দিক থেকে রুশোর তত্ত্ব যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। তবে আলোচ্য সীমাবদ্ধতাগুলি সত্ত্বেও রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে রুশোর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তিনি তাঁর তত্ত্বে সার্বভৌমিকতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সমন্বয় ঘটিয়ে রাষ্ট্র গড়ে তোলার এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরেই সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী প্রচারিত হয়। ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তি এবং ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে রুশোর রাষ্ট্রতত্ত্ব তাত্ত্বিক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment