জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার পরিচয় দাও

জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার পরিচয় দাও

জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার পরিচয় দাও
জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার পরিচয় দাও

জন লকের রাষ্ট্রচিন্তা

টমাস হবসের অব্যবহিত পরেই ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা জন লক এবং তাঁর গ্রন্থ Two Treatises of Government-এর অবদান অবিস্মরণীয়। *1 জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি হল-

(i) লক বর্ণিত প্রকৃতির রাজ্য এবং প্রাকৃতিক আইন: জন লক তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে প্রাক্-রাষ্ট্রীয় জীবনে এক প্রকৃতির রাজ্য (State of Nature) -এর বর্ণনা করেছেন, যেখানে প্রাকৃতিক আইন (Natural Law) ও প্রাকৃতিক অধিকার (Natural Rights) প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সময় মানুষের জীবন ছিল সহজ ও স্বাভাবিক; সমাজ ছিল সাম্যবাদী। সর্বত্র বিরাজ করত শান্তি ও শৃঙ্খলা। স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ ছিল না, প্রাধান্য দেওয়া হত যুক্তি এবং বিচারকে। তবে কালের নিয়মে, প্রকৃতির রাজ্যে নানা সংকট উপস্থিত হয়। সম্পত্তির অধিকার ভোগ করাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পায় বৈষম্য। লকের মতে, মূলত ৩টি কারণে প্রকৃতির রাজ্যে অশান্তি বিরাজ করত, সেগুলি হল-

  • প্রাকৃতিক আইনের সীমাবদ্ধতা: এখানে কোনও লিখিত এবং সর্বজনগ্রাহ্য আইন ছিল না, যাকে ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
  • স্বাভাবিক আইন বলবৎাযাগ্য নয়: তাছাড়া প্রচলিত স্বাভাবিক আইনকে বলবৎ করার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। এমতাবস্থায় প্রকৃতির রাজ্যের সমস্ত সুযোগসুবিধা থাকা সত্ত্বেও জন লকের মতে, মানুষেরা স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ ছিল না।
  • নিরাপণ্ড বিচারব্যবস্থার অভাব: প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধসমূহের মীমাংসা করার জন্য কোনও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ছিল না।

এই সকল সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে মানুষ চুক্তির পথে পা বাড়ায় এবং গড়ে তোলে গণসমাজের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।

(ii) চুক্তি মতবাদ: লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ রাজনৈতিক সমাজগঠনের জন্য দুটি পর্যায়ে চুক্তি করেছিল। সাধারণত এই দুটি চুক্তি হল-

  • সামাজিক চুক্তি: প্রকৃতির রাজ্যের মানুষের নিজেদের মধ্যে সংঘটিত এই চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে এবং
  • সরকারি চুক্তি: মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রশাসকের মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়।

লকের মতে, চুক্তির পর প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তির কাছে যেসকল অধিকারসমূহ সমর্পণ করেছিল, তা হল- আইন প্রণয়নের অধিকার, প্রণীত আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের অধিকার এবং আইনভঙ্গকারীর অপরাধের বিচার করার অধিকার। তবে এমন কিছু অধিকারও ছিল, যা প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ রাষ্ট্রশক্তির কাছে সমর্পণ করেনি, যেমন- ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার।

(iii) জনগণ সার্বভৌম শক্তির আধার: রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কে লক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি, তবে একেবারে যে নীরব ছিলেন তাও নয়। তিনি বলেছেন যে, রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতার জোরে অবাধ ও যথেচ্ছ ক্ষমতার অধিকারী নয়। কারণ, সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হল জনগণ। তারাই রাষ্ট্রের কাছে তাদের ক্ষমতা হস্তান্তরিত করেছিল।

(iv) সীমাবদ্ধ শাসনব্যবস্থা:

  • জনগণের সম্মতি: লকের মতে, রাষ্ট্রের শাসককে তৈরি করা হয়েছে মানুষের স্বাধীনতা, জীবন, সম্পত্তি রক্ষা তথা কল্যাণের জন্য। শাসক যদি অক্ষম, অযোগ্য ও জনকল্যাণে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার অধিকার জনগণের আছে।
  • আইনসভার ক্ষমতাচ্যুতি: লকের মতে, আইনসভাও চরম ক্ষমতার অধিকারী নয়। আইনসভা বা সরকার মানুষের আস্থা হারালে মানুষ আইনসভা বা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার এবং নতুন চুক্তি সম্পাদন করার অধিকারী।
  • হস্তান্তরাযাগ্য নয়: লকের মতে, জনগণ হল আইন প্রণয়ন ক্ষমতার প্রকৃত অধিকারী। যেহেতু জনগণ স্বেচ্ছায় এই ক্ষমতা আইনপ্রণেতার হাতে দিয়েছে, তাই আইনপ্রণেতা এই ক্ষমতা অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করতে পারেন না।

(v) সরকার এবং ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি: লকের মতে, রাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক বা অভিজাততান্ত্রিক সরকার যে ধরনেরই হোক না কেন, তাকে সবসময় রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্দিষ্ট রীতিনীতি অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তিনি সরকার কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করার জন্য ক্ষমতার পৃথকীকরণের পরামর্শ দিয়েছেন।

  • আইন প্রণয়ন ও আইন কার্যকর করা: লক বলেছেন যে, আইন প্রণয়ন ও তা কার্যকর করা দুটি পৃথক কাজ। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে আইন বিভাগের হাতে এবং শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা থাকবে শাসন বিভাগের হাতে।
  • ফেডারেটিভ ক্ষমতা: বহির্দেশীয় কার্যাবলি পরিচালনা করার জন্য লক ফেডারেটিভ ক্ষমতা (Federative Power)-র কথা বলেছেন। তবে এই ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি শাসকের বিচক্ষণতার উপর নির্ভরশীল। এই ক্ষেত্রে তিনি সম্মতি প্রদানকারী সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।

(vi) সম্পত্তির অধিকার: জন লকের রাষ্ট্রতত্ত্বে সম্পত্তির অধিকার তত্ত্বটি (Theory of Property) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লক বলেছেন, প্রকৃতির সম্পদ সকল মানুষই সমানভাবে ভোগ করার অধিকারী। আবার তিনি এও বলেছেন যে, মানুষ তার নিজ বুদ্ধির সঙ্গে কায়িক শ্রমকে মিশ্রিত করে যা অর্জন করে, সেটা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তবে লক মনে করেন যে, ব্যক্তির সেই পরিমাণ সম্পত্তির উপরেই অধিকার থাকবে, যে পরিমাণ সম্পত্তি নষ্ট না করে সে ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। লক ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন।

(viii) বিরোধিতা ও বিপ্লব: জন লক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাগরিকদের বিরোধিতা করার অধিকারকে স্বীকার করেছেন। লকের Two Treatises of Government গ্রন্থের Book-II-এর The Dissolution of Government শীর্ষক অধ্যায়ে সরকারের বিলুপ্তি প্রসঙ্গে জনগণের ভূমিকা উল্লিখিত হয়েছে। লক সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি বিপ্লব বা বিদ্রোহের কথা বলেননি। তাঁর মতে, শাসক বা সরকার যদি নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করে; অবিচার, শোষণ বা নির্বাচনের প্রতীক হিসেবে কাজ করে, তখন তার বিরোধিতা করা নাগরিকদের সহজাত অধিকার।

মূল্যায়ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নানাভাবে লকের মতবাদের সমালোচনা করে থাকেন। যেমন- লকের তত্ত্বের বিষয়সমূহে মৌলিকত্বের অভাব, স্ববিরোধিতা দোষে দুষ্ট, পুঁজিবাদী সমাজের স্বার্থরক্ষা, এলিটিস্ট রাজনীতির সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয়দান করা ইত্যাদি বিভিন্ন ত্রুটির কথা বলা হয়ে থাকে। তবে অধ্যাপক ম্যাক্সি (Maxey)-র মতে, রাষ্ট্রচিন্তার জগতে লকের বিশিষ্ট আসন অধিকার করার কারণ হল, পূর্বের বিক্ষিপ্ত ও অসংলগ্ন তত্ত্বগুলিকে তিনি একসূত্রে বাঁধতে সক্ষম হন। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা, আইনের শাসন, স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও প্রতিফলিত হয়েছে লকের রাষ্ট্রচিন্তায়। সুতরাং, আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে জন লকের ভূমিকা যে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, তা বলাইবাহুল্য।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment