টমাস হবসের রাষ্ট্রদর্শনের সীমাবদ্ধতা ও গুরুত্ব লেখো
টমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন ষোড়শ শতকের একজন প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক, যিনি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক দর্শনের বিষয়ে তাঁর তত্ত্ব ও বিশ্লেষণের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি সামাজিক চুক্তিবাদী (Social Contractualist) নামে সমধিক খ্যাত। ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত লেভিয়াথান (Leviathan) গ্রন্থে তিনি তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বের উপস্থাপনা করেন।
টমাস হবসের রাষ্ট্রদর্শনের সীমাবদ্ধতা
টমাস হবসের রাষ্ট্রদর্শনের বেশকিছু সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়-
(i) কাল্পনিক ও অনৈতিহাসিক মতবাদ: প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে হবসের মতবাদ একটি কাল্পনিক মতবাদ, এর কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। হবসের প্রকৃতির রাজ্যের কোনও ঐতিহাসিক অবস্থান ছিল না, এটি ছিল একটি অনুমানমাত্র।
(ii) সামাজিক চুক্তির অসারতা: হবস বলেছেন, প্রকৃতির রাজ্যে এক সামাজিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে চূড়ান্ত ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সমালোচকদের বক্তব্য হল- চুক্তি কখনো একতরফা হয় না। যে-কোনো চুক্তিতে অন্তত দুটি পক্ষ থাকে। কিন্তু হবসের সামাজিক চুক্তির ক্ষেত্রে কেবল একটি পক্ষেরই অস্তিত্ব ছিল, যা একটি অবাস্তব বিষয়।
(iii) নিন্দুকের দৃষ্টিভঙ্গি: সমালোচকদের মতে, হবসের তত্ত্বের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হল, মানুষের স্বভাব সম্বন্ধে তাঁর একপেশে ধারণা। হবস সর্বদা নিন্দুকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শুধুমাত্র মানুষের ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলিরই উল্লেখ করেছেন। মানুষকে তিনি অহং-সর্বস্ব, স্বার্থপর হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু মানুষের সহযোগিতা, সহানুভূতি প্রভৃতি সদ্গুণগুলি তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
(iv) গণতন্ত্রবিরোধী: হবসের তত্ত্ব গণতন্ত্রবিরোধী হিসেবে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। আইনের ঊর্ধ্বে সার্বভৌম ক্ষমতাকে স্থাপন ও তার বিরুদ্ধে প্রজাদের বিদ্রোহের অধিকারকে খর্ব করায় হবসের তত্ত্ব গণতন্ত্রের মূলনীতির বিরোধী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
(v) পরস্পরবিরোধী মতবাদ: হবসের রাষ্ট্রচিন্তায় বেশকিছু পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়, যেমন- একদিকে তিনি ছিলেন রাজতন্ত্রের সমর্থক। অপরদিকে তিনি ছিলেন ঐশ্বরিক উৎপত্তিতত্ত্বের বিরোধী, যেখানে তিনি ধর্মের বেড়াজাল ছিন্ন করে রাজনৈতিক তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক রূপ দেন। ফলত, হবসের যুক্তিনির্ভর মতবাদের জন্য রাজতন্ত্রের সমর্থকগণ তাঁকে যেমন পছন্দ করতেন না, তেমনই রাজতন্ত্রের সমর্থক হওয়ায় পার্লামেন্টের সদস্যরাও তাঁকে বিশ্বাস করতে পারতেন না। আবার হবস রাষ্ট্র সৃষ্টির মূলে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করলেও, রাষ্ট্র সৃষ্টির পর ব্যক্তির অধিকারকে অস্বীকার করেন।
(vi) দায়িত্ব-কর্তব্য উপেক্ষিত: সামাজিক চুক্তির অংশ না হওয়ায় সার্বভৌম ক্ষমতার দায়িত্ব-কর্তব্যসমূহ হবসের তত্ত্বে উপেক্ষিত হয়েছে।
(vii) রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য: সমালোচকদের মতে, হবস রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আসলে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল রাষ্ট্র, সরকার নয়। সরকার শুধু রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে।
(viii) বিপজ্জনক রাষ্ট্রচিন্তা: হবসের মতে, চুক্তির মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে রাষ্ট্র এবং এক্ষেত্রে চুক্তিকারীদের সকল শর্ত মেনে চলতে হবে। চুক্তির শর্ত লঙ্ঘিত হলে, রাষ্ট্র সৃষ্টির শর্তও লঙ্ঘিত হবে। রাষ্ট্রে নেমে আসবে বিপর্যয়। এই ধরনের রাষ্ট্রচিন্তা ক্ষতিকারক ও বিপজ্জনক হিসেবেই গবেষক মহলে সমালোচিত হয়েছে।
টমাস হবসের রাষ্ট্রদর্শনের গুরুত্ব
টমাস হবসের রাষ্ট্রচিন্তা বিভিন্নভাবে সমালোচিত হলেও এর গুরুত্বকে কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্রবিদ লিও স্ট্রাস (Leo Strauss)-এর মতে হবস হলেন “The originator of modern political philosophy.”
(i) আধুনিক সার্বভৌম তত্ত্ব: রাষ্ট্রচিন্তায় টমাস হবসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব। হবসের পূর্বে সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব বিকাশলাভ করলেও হবস-ই একে আধুনিক রূপদান করেন। আধুনিক কালে আমরা সার্বভৌম তত্ত্ব বলতে যা বুঝি, তাঁর প্রবক্তা ছিলেন হবস।
(ii) ম্যাকিয়াভেলি ও বোঁদার সার্থক উত্তরসূরি: হবসকে ম্যাকিয়াভেলি ও বোঁদার সার্থক উত্তরসূরি বলা হয়। ম্যাকিয়াভেলি পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তায় অনেক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বোদা, ম্যাকিয়াভেলির চেয়ে কিছুটা অগ্রবর্তী ছিলেন, আর হবসের যাত্রা শুরু হয় এরপর থেকেই। হবস রাজনীতিকে বস্তুগত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন।
(iii) বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ও জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা: রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়, মানুষ নিজের স্বার্থে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে- তৎকালীন সময়ে হবসের এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক ছিল। দ্বিতীয়ত, হবস রাজনীতিকে কেবলমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিতেই দেখেননি, তাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠাও করেছেন। ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার হিল (Christopher Hill)-এর মতে, হবসের রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্ব ছিল বৈপ্লবিক। তাঁর তত্ত্বে ইউরোপীয় শক্তিশালী আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
(iv) ধর্মনিরপেক্ষতা: হবস ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রতত্ত্বের আলোচনা করেছেন। ডানিং বলেছেন, ম্যাকিয়াভেলি ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। কিন্তু হবস রাজনীতিকে ধর্মের উপরে স্থান দিয়েছেন। মার্সিলিও (Marsilio) যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রচিন্তার চর্চার কাজটি শুরু করেছিলেন, হবস তাকে পূর্ণতা দেন।
(v) যুক্তিবাদের প্রথম ভাষ্যকার: হবসকে যুক্তিবাদের প্রথম ভাষ্যকার হিসেবে অভিহিত করা হয়। হারশ (Hearnshow) মনে করেন যে, হবসের ধারণাগুলি মেনে নিলে তাঁর সিদ্ধান্তসমূহ যুক্তিবিজ্ঞানের সূত্রানুসারে যতদূর সঠিক হওয়া সম্ভব ততদূরই সঠিক।
(vi) উপযোগবাদের অগ্রদূত: টমাস হবসের চিন্তাধারাকে মিল (James Mill) ও বেথামের (Jeremy Bentham) উপযোগবাদের উৎস বলা হয়। এজন্য হবসকে উপযোগবাদের অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করা হয়।
(vii) নিয়মানুবর্তিতার প্রথম দার্শনিক: সমসাময়িক ইংল্যান্ডে হবসের রাষ্ট্রতত্ত্ব ছিল সময়োপযোগী একটি তত্ত্ব। কারণ, তৎকালীন ইংল্যান্ডের অরাজক পরিবেশে প্রয়োজন ছিল শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার। হবস সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আইভর ব্রাউন (Ivor Brown)-এর মতে, হবস ছিলেন নিয়মানুবর্তিতার প্রথম দার্শনিক (First philosopher of discipline) I
(viii) ঐশ্বরিক তত্ত্বের অবসান: হবসের তত্ত্ব আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছিল। তিনি তাঁর তত্ত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তির ঐশ্বরিক তত্ত্বকে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন যে রাষ্ট্র ঈশ্বর সৃষ্ট কোনও কাল্পনিক প্রতিষ্ঠান নয়, মানুষই হল রাষ্ট্রের সৃষ্টিকর্তা।
হবসের রাজনৈতিক তত্ত্ব সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না। কিন্তু, তা সত্ত্বেও আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনের দিশা দেখানোর ক্ষেত্রে হবসের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। গবেষক স্যাবাইন মনে করেন, ইংরেজ ভাষাভাষী রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে হবস ছিলেন সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর