অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রদর্শনের রূপকার ছিলেন গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। ভারতীয় রাষ্ট্রবিদ কৌটিল্যের সমসাময়িক দার্শনিক অ্যারিস্টটল সর্বপ্রথম রাষ্ট্রনীতিচর্চাকে সমাজ বিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তা
গ্রিক সমাজ, দর্শন ও রাজনীতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং তর্কশাস্ত্র, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিভিন্ন শাস্ত্রে . পাণ্ডিত্য ছিল অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার মৌল উপাদান। দ্য পলিটিকস (The Politics) নামক গ্রন্থে তিনি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি
অ্যারিস্টটলের মতানুসারে, রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক নিয়মে। প্রথমে মানুষ পরিবার গঠন করেছে। তারপর কতকগুলি পরিবার একত্রিত হয়ে গড়ে তুলেছে গ্রাম। কালক্রমে মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন বৃদ্ধি পেতে থাকলে গ্রামগুলির সীমানা প্রসারিত হয়ে অনেকগুলি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে রাষ্ট্র (নগররাষ্ট্র)। তিনি এরূপ মত পোষণ করেছিলেন যে- একটি বীজ থেকে যেমন গাছের সৃষ্টি হয়, তেমনি পরিবার থেকে মানুষের নানাবিধ প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পরিবার হল শুরু এবং রাষ্ট্র হল পরিণতি।
অ্যারিস্টটলের ধারণায় রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
অ্যারিস্টটলের ধারণা অনুযায়ী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- রাষ্ট্র গঠনের মূল কথা হল মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি।
- যুক্তি দ্বারা অ্যারিস্টটল দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে স্বাভাবিকভাবেই, অর্থাৎ রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান।
- অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রের স্থান ব্যক্তি বা পরিবারের আগে।
- অন্যান্য সংগঠন বা সংস্থা অপেক্ষা রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ সংগঠন হিসেবে তুলে ধরতে উদ্যত হয়েছিলেন অ্যারিস্টটল।
- রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্র হল জীবদেহের ন্যায় এক পূর্ণাঙ্গ সত্তা।
সরকারের শ্রেণিবিভাগ
অ্যারিস্টটল The Politics নামক গ্রন্থে বিভিন্ন ধরনের সংবিধান, সরকার ও তার শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে সুসংবদ্ধ আলোচনা করেছেন। তিনি মূলত শাসকের সংখ্যা ও তার গুণ-এই দুটি বিষয়কে সামনে রেখে সরকারের স্তরবিভাজন করেছেন। তাঁর মতে, স্বাভাবিক (Pure) ও বিশুদ্ধ শাসনপদ্ধতি হল- রাজতন্ত্র (Monarchy), অভিজাততন্ত্র (Aristocracy) এবং বহুজনতন্ত্র (Polity)। অন্যদিকে বিকৃত (Perverted) শাসনপদ্ধতি হল- স্বৈরতন্ত্র (Tyranny), গোষ্ঠীতন্ত্র (Oligarchy) এবং গণতন্ত্র (Democracy)। F অ্যারিস্টটল পলিটি-কে সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা আখ্যা দিয়েছেন।
বিপ্লব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমত
অ্যারিস্টটল বিপ্লব অর্থে মূলত সরকার তথা সংবিধানের পরিবর্তনকে বুঝিয়েছেন। তিনি বিপ্লবের উৎস আলোচনা করে তার প্রতিকারও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন।
- (a) উৎস ও কারণ: সাম্যের আবেগই হল বিদ্রোহ বা কোনও বৈপ্লবিক আন্দোলনের উৎস- এই ছিল অ্যারিস্টটলের অভিমত। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন মনে করে যে রাষ্ট্র তথা কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে বা তারা নিপীড়িত হচ্ছে তখন তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটে, যা জন্ম দেয় বিদ্রোহ বা বিপ্লবের। তিনি আরও বলেছেন যে- ঔদ্ধত্য, ভয়, রাষ্ট্রের অসমান বিকাশ, ঘৃণা, নির্বাচনি ষড়যন্ত্র ইত্যাদি নানান কারণেও বিপ্লব ঘটতে পারে। স্বৈরতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণে বিপ্লব ঘটতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।
- (b) প্রতিকার: অ্যারিস্টটল বিপ্লবের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি এর প্রতিকার সম্পর্কেও মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, বিপ্লবের প্রতিকারগুলি হল- সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা আইনভঙ্গ-সহ যে-কোনো নিকৃষ্ট কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, • শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, সম্ভ্রান্ত শ্রেণির মধ্যে সুসম্পর্ক ও ঐক্য বজায় রাখা ইত্যাদি।
অ্যারিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্র
অ্যারিস্টটল মনে করতেন যে, মানুষের এক সুন্দর মঙ্গলময় জীবন ও সুখ নির্ভর করে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর। বস্তুত তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাটি সদগুণের উপর প্রতিষ্ঠিত। এইরূপ রাষ্ট্রের রূপরেখা অঙ্কন করতে গিয়ে তিনি চরম রাজতন্ত্র ও বিশুদ্ধ অভিজাততন্ত্রের কথাও তুলে ধরেছেন। যদিও পলিটি বা মিশ্র শাসনব্যবস্থাকে তিনি এক্ষেত্রে উপযোগী বলে বিবেচনা করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অ্যারিস্টটল বর্ণিত আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা কয়েকটি শর্তের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, যথা- সীমিত জনসংখ্যা, সাহসী ও বুদ্ধিমান জনগণ, মাঝারি আকারের রাষ্ট্র, নাগরিকতা, আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা ও সুদৃঢ় প্রশাসনিক কাঠামো। তবে বলা প্রয়োজন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিচালিত সরকার, ক্রীতদাস প্রথা সমর্থনকে সর্বোপরি একটি কাল্পনিক ধারণারূপে সমালোচনা করা হয়েছে তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের তত্ত্বকে।
মূল্যায়ন
অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রদর্শন নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। অনেকের মতে, তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। তিনি মূলত নগররাষ্ট্রের পরিসরেই তাঁর রাষ্ট্রচিন্তাকে অবাধ রেখেছিলেন। এসকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে অ্যারিস্টটলের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি, সরকারের বিভিন্ন রূপ, ন্যায়বিচার, পরিবার এবং সম্পত্তি-সহ যে ব্যাখ্যাগুলি দিয়েছেন, তা রাষ্ট্রচিন্তার পরবর্তী ধারাকে যথেষ্ট পুষ্ট করেছিল। তাঁর এই রাষ্ট্রদর্শন খ্রিষ্টপূর্বাব্দ কালের হলেও বর্তমান সময়েও তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর