শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞানের অর্থ বড়ো প্রশ্ন উত্তর | Class 11 Second Semester 1st Chapter WBCHSE
১। শিক্ষা মনোবিজ্ঞান কী ধরনের বিজ্ঞান? এর গুরুত্ব বা তাৎপর্য বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করো।
শিক্ষা মনোবিজ্ঞান হল মন সম্পর্কিত বিজ্ঞান। কারণ এটি জড় পদার্থ নিয়ে কাজ করে না। মন, অনুভূতি, আবেগ এইসব নিয়ে এই বিজ্ঞান কাজ করে। আর এর নিজস্ব পদ্ধতি হল শ্রেণিকক্ষ পর্যবেক্ষণ। এটি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকালীন সময়ের আচরণ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে থাকে।করীম ক্যাপার শ্রীকান্ত।
শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা
(i) শিশুদের সম্ভাবনার বিকাশে সহায়তা: শিশু যে সম্ভাবনাগুলি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, সেগুলির প্রকৃতি অনুধাবন করা ও তার বিকাশে সহায়তা করার কাজ করে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান।
(ii) বুদ্ধির পরিমাপ করা: শিখনের সঙ্গে বুদ্ধির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই শিখনের উৎকর্ষ, সহজাত ক্ষমতা বুদ্ধির উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। শিক্ষার্থীদের বুদ্ধির বিষয়টি পরিমাপের জন্য শিক্ষা মনোবিজ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
(iii) শিখন প্রক্রিয়ার আলোচনা: শিখনের উপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলির উপর মনোবিজ্ঞান প্রভাব বিস্তার করে থাকে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানের কাজকে অনেক সহজ ও কার্যকরী করে তুলতে সাহায্য করে শিক্ষা মনোবিদ্যা।
(iv) সুপরিচালনা ও চরিত্রগঠন করা: আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক, ভবিষ্যতে সে যাতে উপযুক্ত জীবিকা গ্রহণ করতে পারে ও যথাযথভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেদিকে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান যথাযথ নজর দিয়ে থাকে। ভবিষ্যতে শিশু যেন উন্নত চরিত্রগঠনের অধিকারী হয়ে ওঠে ও সুষম ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় সেদিকেও এই বিজ্ঞান যথাযথ নজর রাখতে সহায়তা করে।
(v) মূল্যায়নে সাহায্য: আধুনিক শিক্ষা মনোবিদ্যা মূল্যায়নের ধারণা এবং বিভিন্ন ধরনের মানসিক অভীক্ষা ইত্যাদি প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে।
(vi) মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার সমাধান: মানসিক অসুস্থতার কারণ, নিবারণের উপায় ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা থাকলে শিক্ষক সহজভাবে শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারেন। শিক্ষা মনোবিদ্যা সম্পর্কে জানলে শিক্ষকের যে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে, তার দ্বারা সমস্যার সমাধান সম্ভব।
(vii) অবসাদ সম্পর্কে জ্ঞান: কর্মক্ষমতা হ্রাসের কারণ হিসেবে মনোবিদগণ অবসাদ, একঘেয়েমি এবং বিরক্তিকর অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অপ্রয়োজনীয় অবসাদ দূর করা প্রয়োজন। এজন্য শিক্ষকের মনোবিদ্যার জ্ঞান আহরণ করা বিশেষ প্রয়োজন।
(viii) ব্যক্তি বৈষম্য সংক্রান্ত জ্ঞান: প্রতিটি শিক্ষার্থীর মধ্যে দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক দিক থেকে পার্থক্য থাকে। তাই শিক্ষক যদি একই ধাঁচে যন্ত্রের মতো পড়িয়ে যান, তবে তিনি সফলতা লাভ করবেন না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অনুযায়ী শিক্ষক বিচার বিবেচনা করে শিক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন।
শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য প্রয়োজনীয়তাগুলি হল:
(ix) পাঠক্রম রচনা: শিক্ষার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পাঠক্রম। এই পাঠক্রম স্তরভেদে বিভিন্ন হয়। প্রতিটি স্তরের পাঠক্রম তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বয়স, চাহিদা, সামাজিক চাহিদা ও জাতীয় চাহিদার উপর গুরুত্ব প্রদানের প্রয়োজন। এর জন্য পাঠক্রম প্রণেতাদের প্রয়োজন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান। সুতরাং পাঠক্রম রচনায় শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের ব্যাবহারিক প্রয়োগ রয়েছে।
(x) স্বাভাবিক বিকাশ সংক্রান্ত জ্ঞান: জন্মগত সম্ভাবনাগুলির স্বাভাবিক বিকাশ প্রয়োজন। শিশুর ব্যক্তিসত্তা যে বিকাশধর্মী, এ কথা মনোবিদরা জানিয়েছেন। তবে শিক্ষকদের যদি শিক্ষা মনোবিদ্যার জ্ঞান থাকে, তবে শিশুর। যে সম্ভাবনার সঠিকভাবে বিকাশ সম্ভব, সে ব্যাপারে শিক্ষক নির্দেশনা দিতে পারেন।
(xi) পাঠ্যপুস্তক রচনা: প্রতিটি স্তরের পাঠক্রমের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় পাঠ্যপুস্তক। পাঠক্রমে যেমন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগের প্রয়োজন, তেমনই পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাদের শিক্ষা মনোবিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান প্রয়োজন।
(xii) শিশুর প্রকৃতি: শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষার্থীর বয়স, আগ্রহ, সামর্থ্য, মনোভাব ইত্যাদি সম্বন্ধে জানা থাকলে তবেই শিশুকে শেখানো সম্ভব।। আগ্রহ, মনোভাব, সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়গুলি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্তর্গত।। তাই শিক্ষকের কর্তব্য হল শিশুর প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়ে তোলা।। তাই রুশোর বক্তব্য ‘A Child is a book which the teacher has to learn from page to page’ এই বক্তব্যটি শিক্ষাক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
২। একজন শিক্ষকের মনোবিদ্যা সংক্রান্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন কেন?
মনোবিদ্যার জ্ঞান শিক্ষককে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যপালনে কতখানি সাহায্য করে, তা জানতে হলে আধুনিক শিক্ষায় মনোবিদ্যার ভূমিকা পরিষ্কারভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।
(i) শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বিকাশ সম্পর্কে জ্ঞান: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বিকাশের জন্য শিক্ষককে শিশুর মানসিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে সম্যক পরিচয় সংগ্রহ করতেই হবে। এ সম্পর্কে জন অ্যাডামস-এর উক্তি- “The Teacher teaches John Latin” অর্থাৎ শিক্ষক শিক্ষার্থী জনকে ল্যাটিন পড়ানোর জন্য কেবল ল্যাটিন জানলে চলবে না। শিক্ষার্থীদের মনের বিকাশ ঘটাতে হবে। রুশোর উক্তি- “The Child is a book which the teacher has to learn from page to page.” অর্থাৎ শিক্ষার্থী হল বই, যাকে শিক্ষক ভালো করে জানবেন। তাই শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান শিক্ষককে তার পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও পেশাগত বিচার-বিবেচনা, সক্ষমতা ও সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করে।
(ii) শিক্ষণ পদ্ধতি: শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যে আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব কার্যকরী পদ্ধতি হল কর্মকেন্দ্রিক ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতি যেগুলি শিক্ষকদের শিক্ষাদানে সাহায্য করে।
(iii) আগ্রহ ও প্রবণতা অনুযায়ী পাঠদান পদ্ধতি: শিক্ষার্থীদের মানসিক আগ্রহ অনুযায়ী শিক্ষাদান করলে শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক উপকারই হয়। এই জ্ঞান মনোবিজ্ঞানসম্মত, যা শিক্ষককে পাঠদানে সাহায্য করে।
(iv) ব্যক্তি-বৈষম্যের নীতি: পাঠক্রম রচনার জন্য ব্যক্তি-বৈষম্যের নীতি অনুযায়ী বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষার্থীদের উপকারই হয়। এর জন্য মনোবিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।
(v) বিদ্যালয় প্রশাসন: বিদ্যালয় প্রশাসনে দক্ষতা দেখানোর জন্য এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য শিক্ষকের অবশ্যই মনোবিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
(vi) মানসিক স্বাস্থ্য: শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে শিক্ষককে মনস্তত্ত্বনির্ভর ব্যবহার প্রদর্শন করতে হবে। বিশেষ করে ব্যতিক্রমী ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করা প্রয়োজন।
(vii) শিক্ষার নানাবিধ বিষয়: পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষণ প্রণালী অন্তর্ভুক্ত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়ে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ, সময়তালিকা নির্বাচন, এমনকি শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে ব্যবহার, সবক্ষেত্রে শিক্ষককে মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়, যা শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
(viii) শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে, feedback প্রদানে এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ণয়ে একজন শিক্ষকের কাছে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য।
শিক্ষকের মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকার অন্যান্য কারণগুলি হল:
(ix) ব্যস্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে সাহায্যদান: শিক্ষা মনোবিজ্ঞানলবধ জ্ঞান। সরবরাহের মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষার্থীর সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেন।
(x) জীবনবিকাশের ধারা অনুযায়ী শিক্ষাদান করতে: শিশু জীবনবিকাশের কোন্ স্তরে আছে, সেই অনুযায়ী শিশুকে কোন্ ধরনের শিক্ষা দেওয়া উচিত, তা নির্ণয়ের কাজ করে মনোবিজ্ঞান।
(xi) বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে: শিক্ষার লক্ষ্য শিশুর সার্বিক বিকাশ ঘটানো।। এই সার্বিক বিকাশের জন্য কোন্ ধরনের বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে হবে, তা ঠিক করে দেয় মনোবিজ্ঞান।
(xii) বিদ্যালয়ে আদর্শ পরিবেশ রচনা করতে: বিদ্যালয় হল সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। তাই আদর্শ বিদ্যালয় পরিবেশ রচনা করতে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান সহায়তা করে।
৩। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানকে কেন আচরণের বিজ্ঞান বলা হয়?
শিক্ষা মনোবিজ্ঞান হল আচরণের বিজ্ঞান
শিক্ষা মনোবিজ্ঞান তার নিজস্ব গবেষণা ও অনুসন্ধান দ্বারা মানুষের আচরণ সম্পর্কে বহু তত্ত্ব এবং জ্ঞান সংগ্রহ করেছে, যা থেকে মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। তাই বর্তমানে মানুষের শিক্ষাকালীন আচরণ সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহের জন্য সাধারণ মনোবিদ্যার উপর নির্ভরশীল হতে হয় না। শিক্ষাবিজ্ঞানের নিজস্ব পরীক্ষানিরীক্ষার দ্বারা ব্যক্তির শিক্ষাকালীন আচরণ সম্পর্কে যেসব সাধারণ সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করা শিক্ষাবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। শিক্ষাবিজ্ঞানের এই নিজস্বতা ও প্রয়োগমূলক দিকের জন্য একে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান বা আচরণের বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষের মনের প্রকাশ তার আচরণের বিভিন্নতার মাধ্যমে হয়ে থাকে। ম্যাকডুগাল-এর মতে, মনোবিদ্যা হল জীবের আচরণ সম্বন্ধীয় বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান। ওয়াটসন বলেন, “Psychology is the science of human behaviour.”
এ ছাড়া বিদ্যালয়ে শিক্ষাকালীন শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ধরনের অপসংগতিমূলক আচরণ লক্ষ করা যায়। এইগুলি শ্রেণি শিখনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীর এই অপসংগতিমূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেবলমাত্র ভয় দেখিয়ে বা শাসন করে শিক্ষার্থীদের ওই সমস্ত আচরণগুলি দূর করা বা সংযত করা সম্ভব হয় না। শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আবিষ্কৃত নানারকম পদ্ধতি এবং কৌশল প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের ওই সমস্ত অপসংগতিমূলক আচরণ দূর করা সহজ হয়েছে। এইসকল কারণে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানকে আচরণের বিজ্ঞান বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে বা ‘স্বতন্ত্র বিজ্ঞান’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
৪। শিক্ষা মনোবিজ্ঞান কী ধরনের বিজ্ঞান? মনোবিজ্ঞানের নীতি অনুযায়ী পাঠক্রম কীরূপ হওয়া উচিত?
শিক্ষা মনোবিজ্ঞান
শিক্ষা মনোবিজ্ঞান হল ফলিত মনোবিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে এটিকে সাধারণ বিজ্ঞানও বলা যায় না বা মনোবিজ্ঞানও নয়, এটি একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান কারণ শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের নিজস্ব কতকগুলি দিক বর্তমান, যা তাকে স্বতন্ত্রতা দান করেছে। যেমন-
(i) শিক্ষা মনোবিজ্ঞান হল মন সম্পর্কিত বিজ্ঞান। এটি শিক্ষার্থীর মন, আবেগ, অনুভূতি, ক্ষমতা, চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে।
(ii) এর নিজস্ব কিছু পদ্ধতি আছে। যেমন- কেস স্টাডি, মুক্ত অনুষঙ্গ ইত্যাদি।
(iii) শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের গবেষণাগার হল শ্রেণিকক্ষ, এখান থেকে শিক্ষার এবং শিক্ষার্থীর অনেক অজানা তথ্য জানা যায়। মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব, সূত্র, নীতিকে প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীর শিক্ষাকালীন আচরণ বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়, তাই একে প্রয়োগমূলক বিজ্ঞানও বলা হয়।
মনোবিজ্ঞানের নীতি অনুযায়ী পাঠক্রম
আধুনিক শিক্ষার পাঠক্রম নির্ধারণের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। উপযুক্ত পাঠক্রম শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলে, শিক্ষার্থীর জীবনে পূর্ণতা আনে, তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। এই কথা মাথায় রেখে আধুনিক পাঠক্রম রচনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বয়স, মানসিক ক্ষমতা, প্রবণতা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাহিদা প্রভৃতি দিকগুলির প্রতি নজর রাখা হয় অর্থাৎ আধুনিক পাঠক্রম মনোবিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়।
বিদ্যালয় শুধু জ্ঞানের বিকাশ নয়, শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো আধুনিক শিক্ষার মূল উৎস। তাই আধুনিক বিদ্যালয় পাঠক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক বিকাশ ও মানসিক বিকাশের পাশাপাশি শারীরিক ও অন্যান্য দিকের বিকাশ ঘটে।
পাঠক্রমের বহুমুখিতাও মনোবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত। পাঠক্রমের বিষয়সমূহ শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের সহায়ক কি না এবং শিক্ষার্থীর পরিণমনের স্তর অনুযায়ী কোন্ কোন্ বিষয় তাকে অধ্যয়ন করতে হবে তা স্থির করা।
৫। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানকে কি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে-ব্যাখ্যা করো।
শিক্ষা মনোবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে ব্যাখ্যা
শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের একান্ত নিজস্ব কতকগুলি দিক আছে, যা তাকে স্বতন্ত্রতা দান করেছে। যেমন-(i) শিক্ষা মনোবিজ্ঞান হল ‘মন’ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। এটি শিক্ষার্থীর মন, আবেগ, অনুভূতি, চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে। (ii) এর নিজস্ব কতকগুলি পদ্ধতি আছে। যেমন-কেস স্টাডি পদ্ধতি, মুক্ত অনুষঙ্গ পদ্ধতি, প্রকল্প পদ্ধতি ইত্যাদি। (iii) বিজ্ঞান হিসেবে শিক্ষাবিজ্ঞানের গবেষণাগার হল শ্রেণিকক্ষ, যেখান থেকে শিক্ষার এবং শিক্ষার্থীর অনেক অজানা তথ্য জানা যায়। এ ছাড়া আছে-
(i) গবেষণা ও অনুসন্ধান: শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের নিজস্ব গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষার দ্বারা ব্যক্তির শিক্ষাকালীন আচরণ সম্পর্কে যেসব সাধারণ সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, তা হল- ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নীতি, শিখন সঞ্চালন, মূল্যায়ন, নির্দেশনা ইত্যাদি বৃহত্তর মানবকল্যাণের কাজে লাগানো যেতে পারে। শিক্ষাবিজ্ঞানের এই নিজস্বতা ও প্রয়োগমূলক দিকের জন্য একে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
(ii) অপসংগতিমূলক আচরণ দূরীকরণ: বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকালীন নানা ধরনের অপসংগতিমূলক আচরণ লক্ষ করা যায়। যেমন-স্কুল- পালানো, মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা, আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রভৃতি। এগুলি শ্রেণি শিখনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীদের এই সমস্ত অপসংগতিমূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে বা শাসন করে শিক্ষার্থীদের ওই সমস্ত অসংযত আচরণগুলি সংযত করা যায় না। শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আবিষ্কৃত নানা পদ্ধতি এবং কৌশল প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের ওই সমস্ত অপসংগতিমূলক আচরণ দূর করা সম্ভব হয়েছে।
(iii) পদ্ধতি: শিক্ষা মনোবিদ্যায় পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিনির্ভর এবং নৈর্ব্যক্তিক এই দুই ধরনের পদ্ধতি অনুসৃত হয়। এর সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় শিক্ষার্থীর আচরণধারার পরীক্ষা করা যায়। এই শাস্ত্রে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল সম্পর্কে তাৎপর্য নির্ণয়ের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের রীতি চালু আছে। এই সমস্ত কারণে আধুনিক শিক্ষা মনোবিদগণ শিক্ষা মনোবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
৬। শিক্ষার লক্ষ্যের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক কী?
শিক্ষার লক্ষ্যের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক
(i) পাঠক্রম নির্ধারণ: শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের অবদান গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছোনোর উপায় হল পাঠক্রম। অর্থাৎ পাঠক্রম নির্ধারিত রাস্তা দিয়ে শিক্ষা তার লক্ষ্যে পৌঁছোয় আর শিক্ষার লক্ষ্যপূরণের জন্য কী ধরনের পাঠক্রম প্রয়োজন, তা ঠিক করে মনোবিজ্ঞান।
(ii) শিক্ষাদর্শন: শিক্ষাদর্শন (Educational Philosophy) শিক্ষার লক্ষ্য তাত্ত্বিকভাবে স্থির করলেও কীভাবে শিক্ষার এই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যগুলি বাস্তবে প্রয়োগ করা হবে-তা মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। তা ছাড়া দার্শনিক চিন্তাপ্রসূত আদর্শগুলি মানবমনের মৌলিক নীতিগুলিকে লঙ্ঘন করছে কি না তা-ও মনোবিজ্ঞান স্থির করে দেয়।
অর্থাৎ শিক্ষার লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে দর্শন প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করলেও সেই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর পথ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় মনোবিজ্ঞান থেকে। এর অর্থ শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছোনোর উপায় হল মনোবিজ্ঞান। শিক্ষার্থীর প্রকৃতি ও ব্যক্তিগত বৈষম্যের ভিত্তিতে শিক্ষাকে লক্ষ্যমুখী করে মনোবিজ্ঞান।
(iii) শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে মনোবিজ্ঞান: দর্শন শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিলেও সেই লক্ষ্য শিক্ষার্থীর আয়ত্তাধীন কি না তা একমাত্র মনোবিজ্ঞান দ্বারা বোঝা যায়। কোনো লক্ষ্য যতই মহান হোক-না-কেন সেই লক্ষ্য যদি শিক্ষার্থীর আয়ত্তের বাইরে হয়, তবে সেই লক্ষ্যের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। শিক্ষার লক্ষ্য যদি বাস্তবভিত্তিক এবং শিশুর চাহিদাভিত্তিক না হয়, তাহলে সেই লক্ষ্যপূরণে শিশু অনীহা দেখায় এবং ব্যর্থ হয়।
৭। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন সমস্যাসমাধানের ক্ষেত্রে শিক্ষা ‘মনোবিদ্যার ভূমিকা লেখো।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন সমস্যাসমাধানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান
(i) অপসংগতিপূর্ণ আচরণ সংশোধনে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান: শ্রেণিকক্ষে অপসংগতিমূলক আচরণ বলতে চুরি করা, স্কুল পালানো, মিথ্যা কথা বলা, অন্য শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা, প্রতারণা করা, অবাধ্যতা, একগুঁয়েমি প্রভৃতি আচরণকে বোঝায়। এই প্রকার আচরণ সংশোধনের জন্য, এর কারণ অনুসন্ধান করতে শিক্ষককে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান সহায়তা করে।
(ii) শিখন সঞ্চালনগত সমস্যাসমাধানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান: শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের দ্বারা শিখন সঞ্চালন কী, তার নিয়ম কী, তার শর্ত কী- এসব প্রশ্নের উত্তর শিক্ষক খুঁজে পান, এরপর তিনি শিক্ষার্থীদের বোঝাবেন কোন্ প্রকার শিক্ষা বাস্তবে কোন্ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব বা বাস্তবে তারা এই জ্ঞান কীভাবে প্রয়োগ করবে।
(iii) শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি নির্বাচনজনিত সমস্যাসমাধানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান:
শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞান শিক্ষা মনোবিজ্ঞান থেকে সংগ্রহ করেন। আবার শ্রেণিকক্ষে উপযুক্ত মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহার করলে শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি, বিরক্তিবোধ, অবসাদে ভোগার বিষয়গুলি কম হয়।
(iv) মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাসমাধানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান: মানসিক
স্বাস্থ্য কী, মানসিক স্বাস্থ্যের লক্ষণ কী, শিক্ষার্থীদের কীভাবে মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে তোলা যায়-এই সম্পর্কিত জ্ঞান শিক্ষক শিক্ষা মনোবিজ্ঞান থেকে সংগ্রহ করেন।
(v) মূল্যায়নজনিত সমস্যাসমাধানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান: সারাবছর ধরে কোনো শিক্ষার্থী ভালোভাবে পড়াশোনা করা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে বা অন্য কোনো কারণে চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভালো ফল অনেকসময় করে উঠতে পারে না। এটি সঠিক মূল্যায়ন নয়। এই সমস্যাসমাধানের জন্য শিক্ষকের মূল্যায়ন সম্পর্কে আধুনিক জ্ঞান থাকতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষককে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান সহায়তা করে।
(vi) শৃঙ্খলাজনিত সমস্যাসমাধানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান: শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের শৃঙ্খলা সম্পর্কে আধুনিক ধারণা (মুক্ত শৃঙ্খলা, স্বতঃশৃঙ্খলা) শিক্ষক মহাশয়কে সর্বতোভাবে সহায়তা করে।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন সমস্যাসমাধানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য ভূমিকাগুলি হল:
(vii) সঠিক নির্দেশনাজনিত সমস্যাসমাধানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান: শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সার্বিক ধারণা নিয়ে যদি তাদের সঠিক শিক্ষা নির্দেশনা ও বৃত্তি নির্দেশনা দেওয়া যায়, তাহলে শিক্ষার্থীরা সফলতা অর্জন করে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এর জন্য শিক্ষক মহাশয়ের শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।
(viii) সময়তালিকা তৈরি সংক্রান্ত সমস্যাসমাধানে শিল্ডা মনোবিজ্ঞান: কোন্ ধরনের বিষয়কে কোন্ পিরিয়ডে পড়ানো উচিত, কখন বিরাম দেওয়া উচিত,। সপ্তাহের কোন্ দিনগুলিতে বেশি বা কম কাজ পাওয়া যায় ইত্যাদি বিষয়গুলি। না মেনে সময়তালিকা তৈরি করলে শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয়। উক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান শিক্ষক মহাশয়কে সহায়তা করে।
৮। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের নীতি হিসেবে শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের মূলনীতিগুলি কী কী?
ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের মূলনীতিসমূহ
(i) শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ব্যক্তি: শিক্ষার কেন্দ্রে থাকবে ব্যক্তি তথা শিক্ষার্থী। ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই শিক্ষা আবর্তিত হবে।
(ii) ব্যক্তির চাহিদা ও সামর্থ্যকে গুরুত্বদান: ব্যক্তি তার চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষাগ্রহণ করবে। তার উপর জোর করে কোনো বিষয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
(iii) ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ: ব্যক্তি শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, প্রাক্ষোভিক, আধ্যাত্মিক প্রভৃতি দিকের বিকাশ শিক্ষার মাধ্যমে ঘটাতে হবে।
(iv) আত্মোপলব্ধিতে সহায়তা করা: শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তির আত্মোপলব্ধিতে সহায়তা করতে হবে। এর জন্য ব্যক্তির আত্মবিকাশের প্রয়োজন। আত্মবিকাশের জন্য ব্যক্তির স্বাভাবিক প্রবণতাগুলি পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
(v) ব্যক্তি নিয়েই সমাজ: ব্যক্তি নিয়েই সমাজ গঠিত হয়, সমাজের কোনো পৃথক তাৎপর্য নেই। কাজেই ব্যক্তিই প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
(vi) ব্যক্তিবৈষম্যকে গুরুত্ব প্রদান: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে (ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্য) গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রদান করতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তিতান্ত্রিক মতবাদের সমর্থক হলেন ইরাসমাস, লক, কান্ট, রুশো, নান প্রমুখ চিন্তাবিদ।
৯। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের নীতি হিসেবে শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের মূলনীতিগুলি প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে যুক্তিগুলি কী কী?
শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের মূলনীতির সপক্ষে যুক্তি
(i) জীববিজ্ঞানের সমর্থন: জীববিজ্ঞানের বংশগতির ধারানুযায়ী মানুষের দেহের প্রত্যেকটি কোষে বংশগতির ধারক ও বাহক হিসেবে রয়েছে ক্রোমোজোম বা জিন। এগুলি এক একটি একক বৈশিষ্ট্যের নির্ধারক। শিশুর এই জিনগত বৈশিষ্ট্যের স্বকীয়তাকে সংরক্ষণ করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হবে ব্যক্তিকে ঘিরে, সমাজকে ঘিরে নয়।
(ii) প্রকৃতিবাদীদের সমর্থন: প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের মতে, সমাজ একটি কলুষিত প্রতিষ্ঠান। তাই ব্যক্তিজীবনের উন্নতি করতে হলে সমাজের বাইরে যাওয়া উচিত। এই প্রসঙ্গে প্রকৃতিবাদী দার্শনিক রুশো বলেছেন, “শিশু হল সৎ, ভালো। কিন্তু কিছু মানুষই তাকে খারাপ হিসেবে তৈরি করে।”
(iii) মনোবিদ্যার সমর্থন: মনোবিদদের মতে, প্রত্যেক ব্যক্তি দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে অপর ব্যক্তির থেকে পৃথক। এই স্বতন্ত্রতাকে বজায় রেখে শিক্ষার লক্ষ্য হবে ব্যক্তিতান্ত্রিক। ছিল আমার
(iv) ভাববাদের সমর্থন: ভাববাদীদের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তরে যে ব্রহ্মসত্তাটি রয়েছে, তা জাগরিত করা। এক্ষেত্রে শিক্ষা যদি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে রচিত না হয়, তাহলে তার পূর্ণ বিকাশ ও প্রকাশ সম্ভব হবে না। সেজন্য ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ণয় করা উচিত। গ্যামার। মে
(v) প্রয়োগবাদের সমর্থন: প্রয়োগবাদী দার্শনিকদের মতানুযায়ী, মানবসভ্যতার উপর বিশেষ গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের অবদান পড়লে তবেই মানবসভ্যতা বিকাশ লাভ করে। প্রয়োগবাদীদের মতে, নিউটন, আইনস্টাইন, রামকৃষ্ণ প্রমুখ ব্যক্তির দ্বারাই সমাজের উন্নতি ঘটেছে, তাই ব্যক্তির উন্নয়ন করাই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য।
১০। শিক্ষা মনোবিদ্যার সঙ্গে শিশু মনোবিদ্যার সম্পর্কটি লেখো।
শিক্ষা মনোবিদ্যার সঙ্গে শিশু মনোবিদ্যার সম্পর্ক
(i) শিশুর বিকাশ ও মনোপ্রকৃতি: আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর বিকাশ, নিজস্ব ক্ষমতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রবণতা ইত্যাদি বিবেচনা করে শিক্ষা দেওয়া হয়। আর এগুলি জানার জন্য শিক্ষা মনোবিদ্যাকে শিশু মনোবিদ্যার বিভিন্ন পরীক্ষিত তথ্যের উপর নির্ভর করতে হয়।
(ii) উদ্দেশ্য: উদ্দেশ্যগত দিক দিয়ে দুই বিজ্ঞানের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শিশু মনোবিদ্যার উদ্দেশ্য হল শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ, যা আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে হয়। অন্যদিকে শিক্ষা মনোবিদ্যার উদ্দেশ্য হল শিশুর মন বা আচরণ অনুশীলন করা।
(iii) শিক্ষণ পদ্ধতি: বর্তমানে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় (যেমন- কিন্ডারগার্টেন, নার্সারি, মন্তেসরি ইত্যাদি পদ্ধতি) যা মূলত শিশু মনোবিদ্যার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এক্ষেত্রে শিক্ষা মনোবিদ্যাকে শিশু মনোবিদ্যার উপর নির্ভর করতে হয়।
(iv) পাঠক্রম: পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে শিশুর সমগ্র ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটানো যায়। বর্তমানে শিক্ষা মনোবিদ্যায় কর্মকেন্দ্রিক ও সক্রিয়তাভিত্তিক বহুমুখী পাঠক্রমের কথা বলা হয়েছে যা শিশু মনোবিদ্যার নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।
(v) শিখন কৌশল: শিশুদের শিখনে মনোযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহৃত হয়, যা শিশু মনোবিদ্যার জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
(vi) শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য: শিক্ষা মনোবিদ্যায় শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটিও শিশু মনোবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, শিক্ষা মনোবিদ্যার সঙ্গে শিশু মনোবিদ্যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
১১। জানার প্রক্রিয়া কী? ব্যক্তির সক্রিয় আচরণের মাত্রাগুলি আলোচনা করো।
জানার প্রক্রিয়া (Knowing Process)
জ্ঞান বা জানা একটি মানসিক প্রক্রিয়া। এটি সবসময়ই একটি অর্জিত বিষয়। এটি সহজাত নয়, তাই মানুষের সমস্তরকম জ্ঞান অর্জিত হয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
মানবজীবনে জানার প্রক্রিয়া শুরু হয় বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন বস্তুর অভিজ্ঞতা থেকে একটি সামগ্রিক অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে, তারপর সেই সামগ্রিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বিভিন্ন ও খণ্ডিত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেই বিশেষ অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানকে আমাদের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি।
সক্রিয় আচরণের মাত্রা
জন্মমুহূর্তে শিশু একটি মাটির তালের মতো থাকে। মাটির তালকে যেমন নিজের মতো তৈরি করে বিভিন্ন রূপ দেওয়া যায়, তেমনই শিশুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করা হয়। বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করতে হলে শিশুকে পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয়, বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ ইত্যাদির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়নের ফলে শিশুর আচরণের পরিবর্তন ঘটে। মনোবিদগণের মতে, প্রতিটি সক্রিয় আচরণের তিনটি মাত্রা রয়েছে জ্ঞানমূলক মাত্রা (Cognitive Phase), অনুভূতিমূলক মাত্রা (Affective Phase), ক্রিয়াগত মাত্রা (Connative Phase) It
(i) জ্ঞানমূলক মাত্রা: জ্ঞানমূলক মাত্রায় ব্যক্তি বহির্জগতের কোনো ঘটনা বা উত্তেজনা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়।
(ii) অনুভূতিমূলক মাত্রা: অনুভূতিমূলক মাত্রায় শিশু তার বস্তুধর্মী জ্ঞানকে নিজস্ব অনুভূতির দ্বারা আত্মস্থ করে। অনুভূতি বলতে আনন্দ, বেদনা, পছন্দ, অপছন্দ, আগ্রহ ইত্যাদিকে বোঝায়।
(iii) ক্রিয়াগত মাত্রা: শিশু জ্ঞানমূলক মাত্রা ও অনুভূতিমূলক মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে সচেতন হয়ে ওঠে এবং আচরণ সম্পাদন করতে সক্রিয় হয়। একেই বলে ক্রিয়াগত মাত্রা।
মানুষের আচরণ সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রধানত তিনটি মানসিক প্রক্রিয়া রয়েছে। এই তিনটি মানসিক প্রক্রিয়া দ্বারা ব্যক্তি তার জ্ঞানমূলক স্তরকে অর্থাৎ জানার প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করে।
১২। সংবেদন কী? সংবেদনের শ্রেণিবিভাগগুলি আলোচনা করো।
সংবেদন
বাইরের কোনো উদ্দীপক আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়কে উদ্দীপিত করলে, সেই উদ্দীপনা স্নায়ুপথে বাহিত হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং একটি স্থানকে উত্তেজিত করে মস্তিষ্কে যে সরলতম অনুভূতি সৃষ্টি করে, তাকেই সংবেদন বলা হয়। মনোবিদ টিচেনারের মতে, গুণ, তীব্রতা, স্পষ্টতা, স্থিতি-এই চারটি ধর্মের দ্বারা গঠিত মৌলিক মানসিক ক্রিয়াই হল সংবেদন।
সংবেদনের শ্রেণিবিভাগ
(i) ইন্দ্রিয় সংবেদন বা বিশেষ সংবেদন : দেহের বহিঃসংগ্রাহক বা ইন্দ্রিয়গুলি উত্তেজিত হওয়ার ফলে যে সংবেদন হয়, তাকে বিশেষ সংবেদন বলা হয়।
পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের মধ্যে যে-কোনো একটি উদ্দীপিত হলে এবং সেই উদ্দীপনা গুরুমস্তিষ্কে পৌঁছালে, সংবেদন সৃষ্টি হয় বলে একে ইন্দ্রিয় সংবেদনও বলা হয়।
ইন্দ্রিয়ের বিভিন্নতা অনুযায়ী একে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়- দর্শন সংবেদন (Visual Sensation), শ্রবণ সংবেদন (Auditory Sensation), ত্বকজাত বা স্পর্শ সংবেদন (Tactual Sensation), গন্ধ সংবেদন (Olfactory Sensation), স্বাদ সংবেদন (Gustatory Sensation)
(ii) যান্ত্রিক সংবেদন বা দৈহিক সংবেদন: দেহযন্ত্রের অভ্যন্তরে যে-সমস্ত যন্ত্রগুলি আছে, যেমন-হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃৎ ইত্যাদির বিশেষ ক্রিয়ার ফলে শরীরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন-ক্ষুধা, তৃয়া, বেদনা ইত্যাদি যান্ত্রিক সংবেদনের উদাহরণ।
(iii) পেশীয় সংবেদন: বিশেষভাবে কর্মেন্দ্রিয়গুলির সঙ্গে যুক্ত পেশীগুলির নড়াচড়ার জন্য যে ধরনের সংবেদন হয়ে থাকে, তাকে পেশীয় সংবেদন বা Muscular Sensation বলা হয়।
পেশি, অস্থি, মাংস এবং অস্থিসন্ধির সংযোজক পেশিতন্তুর সঙ্গে যে-সমস্ত অন্তর্মুখী স্নায়ু যুক্ত আছে, তাদের পেশীয় সংকোচন বা প্রসারণের জন্য যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় তা মস্তিষ্কে পৌঁছোলে এই প্রকারের সংবেদন সংঘটিত হয়। এই সংবেদনের আবার তিনটি ভাগ আছে। যথা- শক্তি প্রয়োগজনিত সংবেদন, চেষ্টীয় সংবেদন, পার্শ্বীয় সংবেদন।
১৩। সংবেদনের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
সংবেদনের বৈশিষ্ট্যসমূহ
(i) প্রথম স্তর: জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে যে তিনটি স্তর আছে, তার প্রথম স্তর হল সংবেদন। এই সংবেদনকে মনোবিদগণ প্রাথমিক উপাদান হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।
(ii) বহির্জগাত্তর উদ্দীপক: সংবেদনের জন্য বহির্জগতের উদ্দীপক প্রয়োজন। উদ্দীপকের সঙ্গে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটলে উদ্দীপনা অন্তর্মুখী স্নায়ুপথে চালিত হয়ে মস্তিষ্কে উপস্থিত হলে, তবে সংবেদনের সৃষ্টি হয়।
(iii) মন নিষ্ক্রিয়: সংবেদনের সময় মানুষের মন নিষ্ক্রিয় থাকে, অর্থাৎ ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ বা অপছন্দের উপর সংবেদন নির্ভর করে না। ইন্দ্রিয়ের উপর বাইরের জগতের বস্তু-সমূহ যে-সমস্ত ক্রিয়া করে মন সেগুলি কেবলমাত্র নিষ্ক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে। সংবেদন সৃষ্টির পর মানুষের মন সক্রিয় হয়।
(iv) ভাষায় প্রকাশ নয়: সংবেদন কখনও ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না। যখন এটিকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, তখন তা প্রত্যক্ষণে পরিণত হয়।
(v) বিশুদ্ধ সংবেদন: মনোবিদগণ বলেন বিশুদ্ধ সংবেদন বাস্তবে চিহ্নিত করা যায় না। কারণ বাস্তবে মানুষ বিচ্ছিন্ন একক উদ্দীপকের সম্মুখীন হওয়ার সুযোগ পায় না।
(vi) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু: সংবেদনের জন্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর উপস্থিতি বিশেষ প্রয়োজন। কারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু ছাড়া সংবেদন কখনও সম্ভব নয়।
(vii) সংকেত প্রদান: সংবেদন সাধারণত সংকেত হিসেবে কাজ করে। পরিবেশের বিভিন্ন উদ্দীপকের প্রতি উপযোগী প্রতিক্রিয়া করার জন্য সংবেদন সংকেত প্রদান করে থাকে।
(viii) গুণস্থায়ী: সংবেদন সবসময় ক্ষণস্থায়ী। প্রত্যক্ষণ এবং অনুভূতি মুহূর্তের মধ্যেই সংবেদনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
(ix) বস্তুকেন্দ্রিক: সংবেদন সবসময় বস্তুকেন্দ্রিক। কারণ সংবেদন সর্বদা কোনো-না-কোনো বস্তুর গুণ নির্দেশ করে। আকার বা আকৃতি সম্পর্কে সংবেদন এক মানসিক প্রক্রিয়া হলেও এটি মনের বাইরে অবস্থিত কোনো বস্তুর আকার বা আকৃতিকে বর্ণনা করে।
সংবেদনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
(x) জ্ঞানের উপাদান: সংবেদন কোনো জ্ঞান নয়। কোনো রং-কে যতক্ষণ রং। বলে জানি, ততক্ষণই তা সংবেদন। কিন্তু যে মুহূর্তে সেটি কোনো বস্তুর রং,। তখন আর সেটি সংবেদন থাকে না। এটি তখন প্রত্যক্ষণে পরিণত হয়।
(xi) ব্যক্তি নিরপেক্ষ: সংবেদন সৃষ্টির সময় মন নিষ্ক্রিয় থাকায় প্রত্যেক। সংবেদনের উৎস হল বাইরের জগতের কোনো বস্তু বা ঘটনা। তাই এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে কোনো সংবেদন ঘটায় না বরং ব্যক্তির মধ্যে সংবেদন ঘটে।
(xii) অভিযোজনশীলতা: অভিযোজনশীলতা সংবেদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পরিবেশের সমস্ত উদ্দীপকগুলি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। কিন্তু উদ্দীপকগুলির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি দ্রুত কাজ করতে পারে না। তাই ইন্দ্রিয়গুলি যখন উত্তেজনা গ্রহণ করে সেইসময় ইন্দ্রিয়গুলিকে উদ্দীপকের পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে চলতে হয়। সংবেদনের এই বৈশিষ্ট্যটি হল অভিযোজনশীলতা।
১৪। সংবেদনের উপাদানগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
সংবেদনের উপাদানসমূহ
(i) উদ্দীপক: যা ইন্দ্রিয়ের সংবেদীয় বা অন্তর্মুখী স্নায়ুর বহিঃপ্রান্তকে উত্তেজিত বা উদ্দীপিত করে থাকে, তাকে বলা হয় উদ্দীপক। আলো, শব্দ, তাপ ইত্যাদি বাহ্যিক উদ্দীপকের উদাহরণ। হরমোনের ক্রিয়া, ব্যথা ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ উদ্দীপকের উদাহরণ।
(ii) ইন্দ্রিয়ের প্রান্ত যন্ত্র: সংবেদীয় স্নায়ুর বহিঃপ্রান্তে যা উদ্দীপকের দ্বারা উদ্দীপিত হয় তাকে ইন্দ্রিয়ের প্রান্ত যন্ত্র বলে। একে গ্রাহক অঙ্গও বলা হয়ে থাকে। কারণ এটি বহির্জগতের উদ্দীপনা গ্রহণ করে প্রথমে।
(iii) সংবেদীয় স্নায়ু: এই স্নায়ু স্নায়ুপ্রবাহের আকারে উত্তেজনা বহন করে। এটিকে সংজ্ঞাবহ স্নায়ুও বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নিউরোনগুলি গৃহীত স্নায়ু উদ্দীপনাকে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে বহন করে নিয়ে যায়।
(iv) স্নায়ুকেন্দ্র: মস্তিষ্ক বা মেরু মজ্জায় অবস্থিত স্নায়ুকেন্দ্র, যেখানে সংবেদীয় স্নায়ুর সঙ্গে চেষ্টীয় স্নায়ুতন্ত্র যুক্ত থাকে অর্থাৎ সংজ্ঞাবহ স্নায়ু ও চেষ্টীয় স্নায়ুতন্তুর সংযোগস্থলে অবস্থিত স্নায়ুকেন্দ্র।
(v) প্রতিক্রিয়া: অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক উদ্দীপকের প্রভাবে প্রাণীদেহে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় তাই হল সাড়া বা প্রতিক্রিয়া (Response)। যেমন- আমাদের বাড়িতে কেউ দরজায় কলিং বেল বাজালে আমরা দরজা খুলে দিই। এক্ষেত্রে কলিং বেল বাজানোর শব্দটি হল উদ্দীপক আর এর ফলে যে দরজা খুলে দেওয়া হল এটি হল উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া বা প্রতিক্রিয়া।
১৫। সংক্ষেপে সংবেদনের ধর্মগুলি আলোচনা করো।
সংবেদনের ধর্ম
সংবেদনের ধর্ম বা লক্ষণকে ভিত্তি করে সংবেদনের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। এই ধর্মকে তিন দিক থেকে বিচার করা হয়। যথা-
[1] গুণগত ধর্ম: যে ইন্দ্রিয় উত্তেজিত হওয়ার ফলে সংবেদন ঘটে, তার প্রকৃতির উপর গুণগত ধর্ম নির্ভর করে। যা তাকে অন্য একটি সংবেদন থেকে আলাদা করে।
সংবেদনের এই গুণের জন্যই আমরা সঠিক জ্ঞান লাভ করতে পারি। যেমন-শ্রবণ সংবেদনের গুণ হল যে, আমরা শব্দটি শুনতে পাচ্ছি। গুণের দিক থেকে সংবেদনকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়, যথা- জাতিগত সংবেদন (Generic), উপজাতিগত সংবেদন (Specific)।
চোখ ও কানের সংবেদন বিভিন্ন জাতিগত সংবেদন, আবার লাল রঙের সংবেদন ও হলুদ রঙের সংবেদন একই জাতির উপজাতিগত সংবেদন।
[2] পরিমাণগত ধর্ম: পরিমাণগত দিক থেকে সংবেদন চার প্রকারের হতে পারে। যেমন-
তীব্রতা: সংবেদনের পরিমাণগত ধর্ম হল তীব্রতা। বাস্তবে দেখা যায় উদ্দীপকের শক্তির উপর সংবেদনের তীব্রতা নির্ভর করে। যেমন- বজ্রপাতের শব্দ এবং ঘড়ির টিক্টিক্ শব্দ।
স্পষ্টতা: সংবেদনের আর-একটি ধর্ম হল স্পষ্টতা। কোনো সংবেদন বেশি স্পষ্ট আবার কোনো সংবেদন কম স্পষ্ট। যেমন-কুয়াশা ঘন আবহাওয়ার মধ্যে অনেক জিনিস আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই না। কিন্তু রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার মধ্যে ওই একই জিনিস আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই।
স্থিতিকাল: একটি সংবেদন যতক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হয়, তাকে ওই সংবেদনের স্থিতিকাল বা স্থায়িত্ব বলে। যেমন, বিদ্যুতের ঝলক ক্ষণিকের জন্য স্থায়ী হয়। কিন্তু সূর্যের আলো অনেকটা সময় স্থায়ী হয়।
ব্যাপ্তি: সংবেদন যতটুকু জায়গা জুড়ে অনুভূত হয়, তাকেই সংবেদনের ব্যাপ্তি বলে। সাধারণত ইন্দ্রিয়ের কতটা অংশ উদ্দীপকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, তার উপর সংবেদনের ব্যাপ্তি নির্ভর করে। যেমন- ঠাণ্ডা বরফে হাত দিলে যে সংবেদন হয়, কোনো গরম জিনিসে হাত দিলে সংবেদনের ব্যাপ্তি হয় অনেক বেশি।
[3] স্থানীয় ধর্ম: দেহের বিভিন্ন অংশের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের ফলে যে সংবেদন ঘটে, তাকে সংবেদনের স্থানীয় ধর্ম বলে। যেমন-চোখ বুজে থাকা অবস্থায় কেউ হাতের কোনো অংশ স্পর্শ করলে স্পর্শজাত সংবেদনের মাধ্যমে বলে দেওয়া যায় যে, হাতের কোন জায়গায় স্পর্শ করা হয়েছে।
১৬। “সংবেদনের প্রকৃত কারণ উদ্দীপক”- ব্যাখ্যা করো।
সংবেদনের প্রকৃত কারণ উদ্দীপক
ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সৃষ্ট প্রাথমিক স্নায়বিক অনুভূতিকে বলা হয় সংবেদন। যেহেতু ইন্দ্রিয়গুলি আলাদা আলাদা; ফলে স্নায়বিক অনুভূতিগুলিও বিচ্ছিন্ন ও নিরপেক্ষ। আবার ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সৃষ্ট প্রাথমিক সরলতম স্নায়বিক অনুভূতির সঙ্গে – অতীত অভিজ্ঞতা মিশে অর্জিত বস্তুগত জ্ঞান বা ধারণাকে বলে প্রত্যক্ষণ।
সংবেদনের জন্য সবসময় একটা বাইরের উদ্দীপক থাকে। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, সব বস্তুই সবারপক্ষে উদ্দীপক হিসেবে কাজ নাও করতে পারে। যেমন, যে ব্যক্তি চোখে দেখতে পায় না, তার কাছে আলো উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে না। আবার যে ব্যক্তি কানে শুনতে পায় না, তার কান শব্দকে মস্তিষ্কে পাঠাতে পারে না; ফলে শব্দ তার কাছে কোনো উদ্দীপক নয়। অর্থাৎ কোনো বস্তুকে আমরা একটি বিশেষ ক্ষেত্রেই উদ্দীপক বলব যদি সেই বস্তু সেই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে মস্তিষ্কে প্রাথমিক অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। সংবেদন হল এই উদ্দীপক সম্পর্কে জ্ঞান।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়-মনোবিদ টিচেনারের (Titchener) মতে, “গুণ, তীব্রতা, স্পষ্টতা-এই তিনটি ধর্মের দ্বারা গঠিত মৌলিক মানসিক ক্রিয়া হল সংবেদন।”
মনোবিদ সালির (Sully) মতে, “কোনো অন্তর্বাহী স্নায়ুর গ্রাহক অংশ উদ্দীপিত হয়ে উদ্দীপনা মস্তিষ্কে সঞ্চারিত হলে তার দ্বারা যে সহজ মানসিক প্রক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা-ই হল সংবেদন”।
অর্থাৎ সংবেদন বলতে আমরা সেইসব বিচ্ছিন্ন এবং নিরপেক্ষ উদ্দীপক সংক্রান্ত প্রাথমিক স্নায়বিক অনুভূতিগুলিকে বুঝি, যেগুলির উপর ভিত্তি করে অভিজ্ঞতা মিশিয়ে বস্তুধর্মী জ্ঞান অর্জন করতে পারি অর্থাৎ প্রত্যক্ষণ করি। তাই উদ্দীপক ছাড়া যে মস্তিষ্কে স্নায়বিক অনুভূতি ঘটা সম্ভব নয়-সেটা এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই বলা যায় যে, উদ্দীপকই হল সংবেদনের প্রকৃত কারণ।
১৭। জ্ঞানলাভের প্রকিয়া হিসেবে সংবেদনের স্বরূপ বিবৃত করো।
সংবেদনের স্বরূপ
(i) সংবেদন একটি মৌলিক বা প্রাথমিক মানসবৃত্তি, সরলতম মানসিক প্রক্রিয়া। উদ্দীপক অন্তর্মুখী স্নায়ুর বহিঃপ্রান্তকে উত্তেজিত করলে এবং ওই উত্তেজনা স্নায়ুপ্রবাহের আকারে মস্তিষ্কের কেন্দ্রে পৌঁছোলে ওই উদ্দীপক সম্পর্কে যে নিম্নতম চেতনা বা চেতনামাত্র ঘটে, তাকে সংবেদন বলে। সংবেদনের দ্বারাই জ্ঞানলাভের প্রাথমিক প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়।
(ii) আমাদের জ্ঞানলাভের প্রাথমিক প্রক্রিয়া, সংবেদনের মাধ্যমে যা বাস্তবে ঘটে, তা সম্পূর্ণভাবে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই ঘটে থাকে। তা সে দৃষ্টিজাত হোক বা শ্রবণমূলক বা স্পশর্গত বা ঘ্রাণগত বা স্বাদগত যাই-হোক-না কেন তার মাধ্যমেই জ্ঞান লাভের প্রাথমিক পর্যায়টি ঘটে থাকে।
(iii) আমাদের বস্তুর রং, আকার, আয়তন ও অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয় দর্শনজাত সংবেদনের দ্বারা।
(iv) খাদ্যবস্তুর স্বাদ মিষ্টি, তেতো, অম্ল বা লবণাক্ত তার সম্পর্কে সংবেদন ঘটে স্বাদজাত সংবেদনের মাধ্যমে।
(v) শ্বৈত্য সংবেদন, উচ্চতা সংবেদন, বেদনা সংবেদন, চাপ সংবেদন প্রভৃতি সংবেদন ঘটে স্পর্শগত সংবেদনের মাধ্যমে। অর্থাৎ আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রকৃতির ও বস্তুর বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি এই সকল সংবেদনের মাধ্যমে।
(vi) এ ছাড়া ক্ষুধা, তৃয়া, বেদনা ইত্যাদি সংবেদন দেহজ সংবেদন বা যান্ত্রিক সংবেদন নামে পরিচিত, এদের মাধ্যমেও আমরা জ্ঞান লাভ করে থাকি। সঞ্চালনের ফলে একপ্রকার পেশির
(vii) এ ছাড়াও দেহের পেশিগুলির সংবেদন। পার্শ্বীয় ও চেষ্টীয় সংবেদনের দ্বারা আমরা অনেক প্রকার জ্ঞান লাভ করে থাকি।
১৮। জ্ঞানেন্দ্রিয় ও সংবেদনের সম্পর্ক কী? শিক্ষায় সংবেদনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের দায়িত্বগুলি লেখো।
জ্ঞানেন্দ্রিয় ও সংবেদনের সম্পর্ক
জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে উদ্দীপক যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে তার ফলে ইন্দ্রিয়গুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলশ্রুতি হিসেবে সংবেদন সৃষ্টি হয়। সাধারণত সংবেদন সৃষ্টির জন্য একান্তভাবে উদ্দীপকের প্রয়োজন হয়। এই উদ্দীপক জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই জীবদেহে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। তিন প্রকার সংবেদনের মধ্যে ইন্দ্রিয়জাত বা জ্ঞানেন্দ্রিয়জাত সংবেদন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তাই জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংবেদন প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। মানবদেহে যেসকল গ্রাহক-অঙ্গ পরিবেশ থেকে বিশেষ ধরনের উদ্দীপনা সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্নায়ুর মাধ্যমে স্নায়ুকেন্দ্রে পাঠায়, সেই জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলি হল- চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক। এগুলির মধ্যে ত্বককে বলা হয় সাধারণ ইন্দ্রিয় এবং চোখ, কান, নাক ও জিভকে বলা হয় বিশেষ ইন্দ্রিয়।
এই জ্ঞান হল একটি মানসিক প্রক্রিয়া যা আসলে তিনটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ার সমষ্টি। সংবেদন হল সেই তিনটি প্রক্রিয়ার প্রথম এবং সরলতম প্রক্রিয়া।
শিক্ষায় সংবেদনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের দায়িত্ব
শিক্ষাক্ষেত্রে সংবেদনের গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকের দায়িত্বও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সংবেদন প্রক্রিয়াকে কার্যকরী করে তোলার জন্য শিক্ষকগণকে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- বিষয়বস্তু স্পষ্টভাবে ও সরবে উপস্থাপন করতে হবে।
- বোর্ডে লেখা পরিষ্কার ও বড়ো করতে হবে।
- শিখন সহায়ক প্রদীপন ব্যবহার করতে হবে।
- সম্ভব হলে প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষার্থীদের নিয়ে হাতেকলমে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
- শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অধিকসংখ্যক ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করতে হবে।
- জ্ঞান ও দক্ষতা সঞ্চালন শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। এই সঞ্চালনে সংবেদনের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে শিক্ষক বিশেষভাবে অবহিত হবেন।
১৯। জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অবস্থান ও সংবেদনগুলি উল্লেখ করো।
জানেন্দ্রিয়ের অবস্থান ও সংবেদন
[1] চক্ষু (দর্শানন্দ্রিয়): দৃষ্টিগত সংবেদনের ইন্দ্রিয় হল চোখ। এটি করোটির অক্ষিকোটরে অবস্থিত থাকে।
দর্শনজাত সংবেদন: বাহ্যিক পরিবেশের বিভিন্ন বস্তু, বিষয় বা আকৃতি সম্পর্কে আমাদের একটি পরিষ্কার ধারণা সৃষ্টি হয়, একে বলে দর্শন সংবেদন। যেমন-বস্তুর রং, আকার, আকৃতি, আয়তন ও অবস্থান সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা সৃষ্টিই হল এর উদাহরণ। সে চকে এতনি ঢও চালপুর চিপর্কে জতীকৃত
[2] কর্ণ (শ্রবণেন্দ্রিয়): কর্ণ হল শ্রবণ ইন্দ্রিয়। এর মাধ্যমে যে সংবেদন হয়, তা হল শ্রবণজাত সংবেদন। কর্ণ মাথার দু-পাশে অবস্থিত। কর্ণের প্রধান তিনটি অংশ আছে- বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ, অন্তঃকর্ণ।
শ্রবণজাত সংবেদন: বায়ুমণ্ডলের কোনো শব্দতরঙ্গ কর্ণের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছোলে শ্রবণ সংবেদন সৃষ্টি হয়। মাইকের গানের শব্দ সম্পর্কে ধারণা এই সংবেদনের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে।
[3] নাসিকা (ঘ্রাণেন্দ্রিয়): মুখমণ্ডলে দুটি চোখের মাঝখানে নাসিকার অংশগুলি হল দুটি বহিঃনাসারন্দ্র, নাসাগহ্বর এবং অন্তঃনাসারন্দ্র।
ঘ্রাণজাত সংবেদন: নাকের মাধ্যমে ভালো-খারাপ বিভিন্ন ধরনের গন্ধ এই সংবেদনের মাধ্যমে আমরা পেয়ে থাকি।
[4] জিয়া (স্বাদেন্দ্রিয়): স্বাদগ্রহণ করার ইন্দ্রিয় জিভের উপরিভাগ। এটি মুখবিবরে অবস্থিত। এর মাধ্যমে যে সংবেদন হয়, তা হল স্বাদজাত সংবেদন।
স্বাদজাত সংবেদন: বস্তুর মিষ্টি, তেতো, অম্ল, লবণাক্ত প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে সংবেদন হল স্বাদজাত সংবেদন। এটি জিহ্বার মাধ্যমে হয়ে থাকে।
[5] ত্বক (স্পার্শন্দ্রিয়): সংবেদনগুলির মধ্যে আদিম হল ত্বকজাত সংবেদন। ত্বক সারা দেহের উপরিভাগে অবস্থিত। ত্বকের উপরিভাগে বিশেষ উদ্দীপকের জন্য বিশেষ বিশেষ গ্রাহক বা বিন্দু থাকে। এগুলিকে ত্বকগত সংবেদনের গ্রাহক বলে।
স্পর্শজাত সংবেদন: ত্বক হল স্পর্শেন্দ্রিয়। ত্বকের মাধ্যমে আমরা স্পর্শ, চাপ, উন্নতা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা গঠন করতে পারি।
২০। প্রত্যক্ষণ কাকে বলে? প্রত্যক্ষণের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
প্রত্যক্ষণ
সংবেদনের সংব্যাখ্যাত রূপই হল প্রত্যক্ষণ। প্রত্যক্ষণ হল বস্তু সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা বা অর্থপূর্ণ সংবেদন। সংবেদনের দ্বারা বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা লাভ করা যায় না বা ইন্দ্রিয়ের নিকট ধরা পড়ে না। বস্তুর গুণ ও বৈশিষ্ট্য যেসব মানসিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে জানা যায়, তাই-ই হল প্রত্যক্ষণ।
প্রত্যক্ষণ হল সংবেদন+স্মৃতি। অর্থাৎ বস্তু সম্পর্কে প্রাথমিক অনুভূতির সঙ্গে পূর্ব অভিজ্ঞতা যোগ করলে প্রত্যক্ষণ হয়ে থাকে। যেমন-দূরাগত কোনো শব্দ শুনলাম, এটি সংবেদন, কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম এটি গাড়ির হর্ন-এর শব্দ, তখন হল প্রত্যক্ষণ।
পিলসবারির (Pilesbury) মতে, “প্রত্যক্ষণ হল সংবেদন ও স্মৃতির সংমিশ্রণ।”
ক্রো এবং ক্রো-এর মতে, “পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সংবেদনসমূহের সংগঠন এবং সংব্যাখ্যানই হচ্ছে প্রত্যক্ষণ।”
প্রত্যক্ষণের বৈশিষ্ট্য
[1] গুণ: ইন্দ্রিয়গত পার্থক্যের জন্য সংবেদনে যে বিভিন্নতা দেখা দেয় তাকে গুণ বলে। যেমন-ফুল আমরা চোখে দেখি, লাল-নীল রং পার্থক্য করতে পারি। আবার, গন্ধ শুঁকি নাকের সাহায্যে এগুলি হল সংবেদনের গুণ। এই গুণের সম্পর্কে প্রত্যক্ষণ হয়ে থাকে।
[2] অর্থপূর্ণতা: আমরা যে-সমস্ত বস্তু প্রত্যক্ষ করি, তার সঙ্গে বিশেষ কিছু জ্ঞান আরোপিত করে বস্তুটি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করি। অর্থাৎ বস্তুটি কী ধরনের অর্থ বহন করে, তা নির্ভর করে বস্তুটির নিজস্ব প্রকৃতি এবং বস্তুটি কী পরিমাণে আমাদের প্রত্যক্ষণকে প্রভাবিত করে, তার উপর।
[3] জ্ঞানমূলক এ প্রত্যভিজ্ঞামূলক প্রক্রিয়া: জ্ঞানমূলক প্রক্রিয়ার দ্বারা কোনো বস্তুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হওয়া যায়। আর প্রত্যভিজ্ঞার দ্বারা তাকে চিনে নেওয়া যায়।
[4] ব্যক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া: প্রত্যক্ষণ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া। একই বস্তুর প্রত্যক্ষণ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষণ ব্যক্তির দৈহিক, মানসিক কারণ, যেমন-মনোযোগ, আশা, অতীত অভিজ্ঞতা প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়।
[5] সক্রিয়তামূলক প্রক্রিয়া: প্রত্যক্ষণ তখনই সম্ভব হয়, যখন মন সক্রিয়ভাবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান সংবেদনের অর্থ অনুধাবন করতে সমর্থ হয়।
[6] সংবেদন নির্ভর: প্রত্যক্ষণ সবসময় সংবেদনের উপর নির্ভরশীল। কারণ সংবেদনের মাধ্যমে বস্তুজগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হলেই একমাত্র প্রত্যক্ষণ সম্ভব।
প্রত্যক্ষণের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি
[7] নির্বাচনধর্মী: প্রত্যক্ষণ একটি নির্বাচনধর্মী প্রক্রিয়া। এই নির্বাচনধর্মিতার জন্যই অনেক বিষয়বস্তুর মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট একটি উদ্দীপককে বেছে নিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি।
[৪] মনোযোগ নির্ভর: মনোযোগ ছাড়া সংবেদনকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তা ছাড়া মনোযোগের সঙ্গে প্রত্যক্ষণের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান।
[9] পুনরুৎপাদনমূলক প্রক্রিয়া: প্রত্যক্ষণ হল একটি পুনরুৎপাদনমূলক মানসিক প্রক্রিয়া। এখানে স্মৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
[10] সুসংগঠিত প্রক্রিয়া: প্রত্যক্ষণ হল একটি সুসংগঠিত ও জটিল প্রক্রিয়া।
২১। প্রত্যক্ষণের কয়েকটি কার্যাবলি লেখো। প্রত্যক্ষণের স্তর বা পর্যায়গুলি আলোচনা করো।
প্রত্যক্ষণের কার্যাবলি
- প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে বিষয়বস্তু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ হয়।
- প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে জানা ও চেনার মধ্যে সংযোগ সাধিত হয়।
- প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে বিষয়বস্তু নির্বাচিত হয়ে প্রতিক্রিয়ায় সাহায্য করে।
প্রত্যক্ষণের পর্যায়
প্রত্যক্ষণকে বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি পর্যায় বা স্তর লক্ষ করা যায়। কয়েকটি স্তরের মধ্য দিয়ে সংবেদন প্রত্যক্ষণের স্তরে উন্নীত হয়। এই স্তরগুলি হল-
[1] পৃথকীকরণ (Discrimination): প্রত্যক্ষণের প্রথম স্তরটি হল পৃথকীকরণ। এই স্তরে কোনো বস্তুকে প্রত্যক্ষ করার জন্য অপর বস্তু থেকে তাকে পৃথক করা হয়। অর্থাৎ বিজাতীয় বস্তুগুলি থেকে ওই বিশেষ বস্তুটিকে পৃথক করে দেখা হয়। যখন কোনো কণ্ঠস্বর কানে এসে পৌঁছায়, তখন ওই শ্রবণ সম্বন্ধীয় সংবেদনটিকে দৃষ্টিগত, ঘ্রাণগত, স্বাদগত এবং স্পর্শগত সংবেদন থেকে পৃথক করা যায়
[2] সদৃশকরণ (Assimilation): দ্বিতীয় স্তরে পৃথকীকৃত বস্তুকে অন্যান্য সদৃশ সংবেদনের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ অতীতে এ ধরনের যেসব শব্দ সংবেদন পাওয়া গেছে, সেগুলির সঙ্গে এই সংবেদনটির সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন- রাস্তায় পড়ে থাকা বিশেষ কৌশলে প্রস্তুত বস্তুটিকে ‘কলম’ বলে জানতে হলে অতীতে যেসব কলমের অভিজ্ঞতা আছে, তার সঙ্গে বর্তমান ‘কলমের’ যে সাদৃশ্য আছে, তা অনুধা
[3] অনুষঙ্গ ও পুনরুৎপাদন (Association and Reproduction): তৃতীয় স্তরে প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়া তখনই সংঘটিত হয়, যখন মানুষের মনে একাধিক অভিজ্ঞতার পুনরুৎপাদন ঘটে এবং বর্তমান অভিজ্ঞতার সঙ্গে লব্ধ অভিজ্ঞতার অনুষঙ্গ স্থাপিত হয়। অর্থাৎ এই স্তরে শ্রবণগত সংবেদনটির সঙ্গে অন্যান্য সংবেদনের পূর্ব অভিজ্ঞতার অনুষঙ্গ স্থাপিত হয়। যেমন-‘কলমের’ প্রত্যক্ষণের জন্য পূর্বে কলমকে দেখে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতার যেমন পুনরুৎপাদন প্রয়োজন, তেমনই অনুষঙ্গ স্থাপনের মাধ্যমে তাকে চিনে রাখাও প্রয়োজন।
[4] স্থান-কাল নির্দেশ (Localisation in space and time): চতুর্থ স্তরে সংবেদনটির স্থান ও কাল নির্দেশ করা হয়। অর্থাৎ সংবেদন যা থেকে সৃষ্টি হয়, সেটি যে বাহ্যিক জগতের একটি বস্তু এবং ওই বস্তুটি যে একটি নির্দিষ্ট স্থান ও কালে অবস্থিত, তা প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে নিরূপণ করা হয়।
[5] বিশ্বাস (Belief): যে বস্তুর জন্য সংবেদনটি সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রত্যক্ষণের স্তরে উন্নীত করতে হলে বিশ্বাসের প্রয়োজন। কারণ, প্রত্যক্ষণের ফলে যে বস্তুটি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ হল তা যে একটি যথার্থ বস্তু-সেই বিষয়ে প্রত্যয়ই হল ‘বিশ্বাস’ বা Belief সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে এ কথা বলা যায়, যে মানসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বস্তু সম্বন্ধের অতীত অভিজ্ঞতার পুনরুৎপাদনের ফলে ওই অভিজ্ঞতার সঙ্গে বৈসাদৃশ্যযুক্ত সংবেদনগুলির পৃথকীকরণ, বর্তমান অভিজ্ঞতার সদৃশকরণ এবং সদৃশকৃত অভিজ্ঞতাকে অনুষঙ্গবদ্ধ করার পর ওই সংবেদনটির স্থান-কাল নির্দিষ্ট করে তার প্রতি বিশ্বাস পোষণ করা হয়, তাকেই প্রত্যক্ষণ বলা হয়।
২২। প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ করো।
প্রত্যক্ষণকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। সেগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-
[1] সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণ: আমাদের পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মধ্যে যে-কোনো একটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বস্তুর কোনো বিশেষ গুণকে নির্ধারণ করাকে বলা হয় ‘সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণ’। যেমন, আমরা যখন কোনো পানীয় পান করি, তখন তা শীতল না উন্ন-তা অনুভব করে থাকি। এটি সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণের জন্য ঘটে থাকে।
[2] সং প্রত্যক্ষণ: সঞ্চিত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে আমরা নতুন ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করে থাকি। যেমন-আমরা যখন একটি প্রাণীকে দেখি, তখন সাধারণ মানুষ হিসেবে সেটিকে একটি প্রাণী হিসেবেই দেখি। কিন্তু যদি একজন প্রাণীবিজ্ঞানী প্রাণীটিকে দ্যাখেন, তবে তিনি প্রাণীটির বৈশিষ্ট্যগুলিই দেখবেন, একেই বলা হয় সং প্রত্যক্ষণ।
[3] অর্জিত প্রত্যক্ষণ: কোনো সংবেদন বিশেষে কোনো ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেও কোনো প্রত্যক্ষণ ঘটে, তবে তাকে অর্জিত প্রত্যক্ষণ বলা হয়। যেমন- অতীতে বরফে হাত দিয়ে দেখেছি, তা ঠান্ডা। বর্তমান বরফের দিকে তাকালেই আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা মনে পড়ে।
২৩। ইন্দ্রিয়ের উপর ভিত্তি করে প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ করো।
প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ
সংবেদনের উপর নির্ভর করে
প্রত্যক্ষণ হয়। চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বকের সাহায্যে বাইরের বস্তুর সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং সংবেদনও সেইমতো পাঁচ ধরনের ভাবা যায়। যেহেতু প্রত্যক্ষণ সংবেদননির্ভর, তাই প্রত্যক্ষণ পাঁচ প্রকার হয়। যথা-
[1] দর্শনজনিত প্রত্যক্ষণ (Visual Perception): এই প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে কোনো দর্শনজাত বস্তু সম্পর্কে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি।
[2] শ্রবণজনিত প্রত্যক্ষণ (Auditory Perception): শ্রবণজনিত প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আমরা পরিবেশ থেকে আগত বিভিন্ন শব্দকে বুঝতে পারি। যেমন- কোন্টি কাকের ডাক বা কোনটি কোকিলের ডাক।
[3] স্পর্শজনিত প্রত্যক্ষণ (Tactual Perception): এই ধরনের প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের স্পর্শ অনুভব করতে পারি। যেমন- কোন্ পদার্থটি গরম বা কোন্ পদার্থটি ঠান্ডা ইত্যাদি।
[4] স্বাদজনিত প্রত্যক্ষণ (Gustatory Perception): খাদ্যবস্তু ঝাল বা টক অথবা মিষ্টি তা বোঝা যায় এই প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে।
[5] গন্ধলব্ধ প্রত্যক্ষণ (Perception of Smell): কোনো বস্তুর গন্ধ যেমন- গোলাপের গন্ধ, রান্নার গন্ধ ইত্যাদি আমরা গন্ধলব্ধ প্রত্যক্ষণের মাধ্যমেই বুঝতে পারি।
২৪। প্রত্যক্ষণের ধর্মগুলি লেখো।
প্রত্যক্ষণের ধর্ম
[1] গুণ: আমাদের দর্শনগত, শ্রবণমূলক, ত্বকগত, ঘ্রাণজ প্রত্যক্ষণের মধ্যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে। আমরা চোখ দিয়ে দেখি, কান দিয়ে শুনি, জিভ দ্বারা স্বাদ অনুভব করি। এই সকল প্রত্যক্ষণের মধ্যে ‘গুণগত’ পার্থক্য রয়েছে।
[2] তীব্রতা : এখানে তীব্রতা বলতে গুণের তীব্রতাকে বোঝায়। একটি শব্দ খুব জোরে বা খুব আস্তে হতে পারে। এই দুটি শব্দের প্রত্যক্ষণ পৃথক হবে।
[3] স্থানব্যাপ্তি: কোনো জিনিসকে আমরা ছোটো দেখি, আবার কোনো জিনিসকে আমরা খুব বড়ো দেখি। প্রত্যক্ষণের এই ধর্মকে বলা হয় স্থানব্যাপ্তি। ত্বক বা অক্ষিপটের উপর প্রত্যেক বিন্দুর এক-একটি বিশেষ গুণ আছে যার দ্বারা কোনো বিস্তৃত উদ্দীপকের প্রত্যেক বিন্দুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞান পাওয়া যায়। এই বিশেষত্বকে বলা হয় স্থানীয় সংকেত।
[4] কালব্যাপ্তি: আবার কোনো প্রত্যক্ষণ অল্পসময়ের জন্য হতে পারে, অথবা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এই যে উদ্দীপকের অবস্থান কাল নির্ণয়, একেই বলা হয় কালব্যাপ্তি।
[5] ব্যাপ্তিনির্ভর: প্রত্যক্ষণ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। একই বস্তুর প্রতি প্রত্যক্ষণ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষণ ব্যক্তির দৈহিক ও মানসিক কারণ যেমন- মনোযোগ, আশা, অতীত অভিজ্ঞতা প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়।
[6] মনোযোগ নির্ভর: প্রত্যক্ষণের সঙ্গে মনোযোগ গভীরভাবে সম্পর্কিত। মনোযোগ ছাড়া প্রত্যক্ষণের অর্থ উপলব্ধি ঘটানো সম্ভব নয়। মই ম্যাচ
[7] চেষ্টা নির্ভর: প্রত্যক্ষণের মধ্যে একটা ক্রমাগত চেষ্টা ও ভুলের ক্রিয়া থাকে। প্রত্যক্ষণের জন্য প্রাণী নানারকম অঙ্গ সঞ্চালন করে যতক্ষণ না পর্যন্ত সে কৃতকার্য হয়।
২৫। প্রত্যক্ষণ সম্পর্কে গেস্টাল্টের মতবাদ ব্যাখ্যা করো।
প্রত্যক্ষণ সম্পর্কে গেস্টাল্টবাদীদের মত
প্রত্যক্ষণ সম্পর্কে গেস্টাল্টবাদীদের মূল বক্তব্য হল কোনো একটি বিষয় বা বস্তুকে আমরা কখনোই খণ্ড খন্ড হিসেবে প্রত্যক্ষ করি না। যে-কোনো বিষয় বা বস্তুকে আমরা সর্বদা সমগ্র হিসেবে দেখি। আবার সমগ্রতাবাদীরা প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে Insight বা অন্তর্দৃষ্টি কথাটির উপর জোর দিয়েছেন। মনোবিজ্ঞানী Kohler সর্বপ্রথম এই Insight কথাটির ব্যবহার করেন 1925 সালে। সমগ্রতাবাদীরা অন্তর্দৃষ্টি বলতে বুঝিয়েছেন, কোনো বিষয়ে বা কোনোরকম সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে সমস্যাসমাধানের সময় ব্যক্তির হঠাৎ করে সেই বিষয় সম্পর্কে প্রত্যক্ষণ হওয়াকে।
প্রত্যক্ষণের সময় কোনো বস্তুকে সমগ্রভাবে দেখার যে প্রবণতাগুলি আমাদের মধ্যে আছে তার কারণগুলি হল-
[1] নৈকট্য (Proximity): যে বস্তুগুলি খুব কাছাকাছি থাকে, তাদের আমরা একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করে থাকি। যেমন-পাশের চিত্র দেখে বলা যায় যে, প্রথম একটি লাইন (A) ও তারপর এক জোড়া লাইন (B, C) অবস্থান করছে। কিন্তু আমরা এটা বলতেই পারতাম যে, এখানে পরপর তিনটি লাইন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তা আমরা বললাম না। অর্থাৎ শেষের দুটি লাইনকে আমরা একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি।
[2] সাদৃশ্য (Similarity): বিভিন্ন ধরনের বস্তু একসঙ্গে অবস্থান করলে আমরা সদৃশ বস্তুগুলিকে এক একটি শ্রেণি তৈরির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করে থাকি। যেমন- পাশের চিত্রে একইরকম দেখতে ত্রিভুজগুলিকে আমরা একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করি আবার একইরকম দেখতে বৃত্তগুলিকে একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করে থাকি।
[3] অবিচ্ছিন্নতা (Continuity): উপাদানের অবিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও কোনো চিত্রকে সম্পূর্ণ বলে মনে হয়। পাশের চিত্রের বিন্দুগুলি একে অপরের থেকে পৃথক হওয়া সত্ত্বেও তাদের আমরা অবিচ্ছিন্ন রূপে প্রত্যক্ষ করে থাকি।
[4] গতিশীলতা (Movement): গতিও সংবেদনের একটি সংগঠিত রূপ। পরপর কোনো আলো জ্বলে ওঠা ও নিভে যাওয়ার মধ্য দিয়ে গতিশীলতার একটি অনুভূতি সৃষ্টি হয়। একে মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে “ফাই- ফেনোমেনন”। সামগ্রিকভাবে কোনো বস্তুকে দেখার প্রবণতাই এর মূল কারণ।
[5] পরিচিতি (Identity): কোনো একটি বিষয় সম্পর্কে আমরা পূর্বে যে জ্ঞান অর্জন করি, তা পরবর্তী প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে সহায়তা করে থাকে। যেমন, পাশের ছবিতে অনেকগুলি বিন্দুকে পরপর সাজিয়ে একটি আকার দেওয়া হয়েছে যেটি একটি গ্লাসের অবয়ব। গ্লাস সম্পর্কে একটি পূর্বজ্ঞান থাকার জন্য এটি আমাদের কাছে গ্লাস বলে মনে হয়েছে।
২৬। স্থান বা দূরত্ব ও গভীরতা (Distance and Depth Perception) প্রত্যক্ষণের গৌণ কারণগুলি লেখো।
স্থান বা দূরত্ব ও গভীরতা প্রত্যক্ষণের গৌণ কারণ
আমাদের বস্তুজগৎ সম্পর্কে অতীত অভিজ্ঞতা দূরত্ব ও গভীরতা প্রত্যক্ষণে সাহায্য করে। বস্তুজগৎ সম্পর্কে কিছু মৌলিক ধারণার জন্য আমরা বস্তুকে বিশেষভাবে প্রত্যক্ষণ করে থাকি। যেসব পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা আমাদের এই দূরত্ব ও গভীরতার প্রত্যক্ষণে সাহায্য করে, সেগুলিকে ‘গৌণ কারণ’ বলা হয়। নিম্নে কয়েকটি গৌণ কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
[1] একটি বস্তুর উপর আর-একটির অবস্থান (Superposition): একটি বস্তু অপর একটি বস্তুকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে আড়াল করলে, যেটি আড়াল করছে, সেটি নিকটের বস্তু এবং যেটিকে আড়াল করছে, সেটি দূরের বস্তু বলে মনে হয়। সুতরাং একটি বস্তুর উপর অপর একটি বস্তুর অবস্থিতি থেকে আমরা তাদের দূরত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারি।
[2] বস্তুর আকৃতি (Size): সাধারণত দূরের জিনিসকে ছোটো দেখায় এবং কাছের বস্তুকে বড়ো দেখায়। এই ধারণা আমাদের বস্তুর দূরত্ব প্রত্যক্ষণে সাহায্য করে।
[3] আলোছায়া (Light and shade): স্বাভাবিক পরিবেশে নীচু জায়গা থেকে উঁচু জায়গায় আলো বেশি পড়ে। এই আলোছায়া আমাদের গভীরতার বা উচ্চতার ধারণা দিয়ে থাকে। শিল্পী তার ছবিতে সাদা বা হালকা রং উঁচু জায়গা বোঝানোর জন্য এবং গাঢ় রং নীচু জায়গা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করে থাকেন।
[4] স্পষ্টতা (Clarity): কোনো বস্তুর স্পষ্টতা দূরত্বের প্রত্যক্ষণে সাহায্য করে। দুটি বস্তুর মধ্যে যেটি স্পষ্ট, সেটি কাছের এবং যেটি অস্পষ্ট সেটি দূরের জিনিস বলে মনে করি। এইভাবে আমাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা দূরত্বের প্রত্যক্ষণে সাহায্য করে।
[5] ফাঁকা আর ভরতি জায়গা (Filled and Empty space): কোনো ফাঁকা • জায়গা থেকে ভরতি জায়গার দূরত্ব সবসময় বেশি মনে হয়। দুটো ছবির মধ্যে একটিকে কালি দিয়ে ভরতি করে দিলে দেখা যাবে সেটা বেশি দূরের মনে হচ্ছে। তাই এই কৌশল দূরত্ব প্রত্যক্ষণে সাহায্য করে।
প্রত্যক্ষণের সময় বা প্রত্যক্ষণের জন্য সর্বদা অতীত অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। তাই এই গৌণ কারণগুলিকে অনেক মনোবিদ ‘প্রত্যক্ষণের প্রাথমিক স্বয়ংক্রিয় কৌশল’ নাম দিয়েছেন।
২৭। ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ বলতে কী বোঝো? ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের কারণগুলি লেখো।
ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ (Ilusion)
সংবেদনের ভ্রান্ত ব্যাখাই হল ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ বা অধ্যাস। ব্যক্তি যখন অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর উদ্দীপকের শিকার হয়ে উদ্দীপকের সংকেতগুলির ভুল ব্যাখ্যা করে, তখন তাকেই ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ বলা হয়। যেমন-রাত্রিবেলা আবছা অন্ধকারে রাস্তায় পড়ে থাকা দড়িকে দড়ি বলে মনে না করে সাপ মনে করে ভয় পাওয়া হল ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের উদাহরণ। মরুভূমির মরীচিকাও ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের জন্যই ঘটে।
ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের কারণ
[1] দৈহিক সমস্যা (Physical Problem): আয়নার সামনে দাঁড়ালে প্রতিবিম্ব দেখে অনেকের মনে হয় যে, সে আয়নার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। এই ধরনের ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের কারণ দৈহিক বা শারীরিক।
[2] ভীতি ও দুশ্চিন্তা (Fear and Tension): গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে অনেকের মনে হয়, ছাদে কেউ হাঁটছে বা কেউ যেন হেঁটে চলে যাচ্ছে। এই ধরনের ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের কারণ হল দুশ্চিন্তা বা ভীতি।
[3] অভ্যাস ও পরিচিতি (Habit and known): ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের অপর একটি কারণ হল অভ্যাস ও পরিচিতি। নিজের হাতের লেখা, নিজে সংশোধন করার সময় অনেকক্ষেত্রে এই কারণে ভুল ধরা পড়ে না।
[4] হিংসা ও অবিশ্বস্বাস (Envy and Mistrust): ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের অপর একটি কারণ হল হিংসা ও অবিশ্বাস। সন্দেহের বশে অনেকসময় আমরা স্বাভাবিক কোনো আলোচনাও ষড়যন্ত্র বলে মনে করি। একে অবিশ্বাসের কারণে ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ বলা হয়।
[5] জ্যামিতিক ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ (Geometrical Illusion): সেনডোর এক প্রকার জ্যামিতিক ভ্রম দেখান। একে বলা হয় সামন্তরিক ভ্রম। যেমন, নীচের ছবিতে AF ও FC সমান কিন্তু সামন্তরিক দুটোর ভূমিরেখার পার্থক্যের জন্য একটি কর্ণকে ছোটো ও অপর কর্ণটি বড়ো দেখাচ্ছে।
[6] মূলার-লায়ার ভান্ত প্রত্যক্ষণ (Muller-Lyer Illusion) : উল্লিখিত ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ ছাড়াও মুলার-লায়ার ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণটি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দেখানো হচ্ছে একই লাইনের উপর বিভিন্ন রেখার সমন্বয় কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে মানুষের মনে ভ্রম সৃষ্টি করে। যেমন, নীচের ছবিতে দেখানো হচ্ছে একই দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট দুটি রেখার শেষ প্রান্তে দুরকমভাবে দাগ টানা হয়েছে। একটি তিরের ফলার মতো, অপর একটি পালকের মতো দাগ। এর প্রথমটিকে ছোটো এবং দ্বিতীয়টিকে বড়ো দেখাচ্ছে। এখানে, BB’ রেখাটি AA’ রেখার চেয়ে ছোটো, আদতে দুটোই সমান। একে মুলার-লায়ার ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ বলেছেন।
[7] স্কিৎসোফ্রেনিয়া (Schizophrenia): যদি কারও মধ্যে স্কিৎসোফ্রেনিয়া নামক মানসিক রোগ থাকে, তবে তাদের ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ হতে পারে।
[৪] অতিরিন্দ্র রং, আলো: কোনো বস্তুর উপর অতিরিক্ত পরিমাণে আলো ও রং থাকে, তাহলে ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ হয়। শেষে আসল বস্তুটি বোঝা যায় না।
[9] তথ্যের অভাব: প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে মস্তিষ্কে সঠিক তথ্য পাঠাতে পারলে তখন ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ ঘটবে মস্তিষ্কে।
[10] প্রত্যাশা: প্রত্যাশা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের একটি অন্যতম কারণ। অনেকসময় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া মাত্রই কোনো একটি প্রশ্নের প্রত্যাশা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ সৃষ্টি করে। ফলে তারা প্রশ্নটিকে ভুল পড়ে এবং সেই ভুল প্রশ্নেরই উত্তর দেয়।
[11] ইন্দ্রিয়জনিত অসংগতি: ইন্দ্রিয়ের অসংগতিও ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন-বর্ণান্ধতা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের একটি উদাহরণ।
২৮। দূরত্ব প্রত্যক্ষণে উপযোজন বলতে কী বোঝো? অর্জিত প্রত্যক্ষণ কী?
দূরত্ব প্রত্যক্ষণে উপযোজন
কোনো বস্তু দেখার ফলে ব্যক্তির রেটিনায় একটি প্রতিকৃতি তৈরি হয়। এই প্রতিকৃতিটি দ্বিমাত্রিক (Bi-dimensional) অথচ বস্তুটিকে ত্রিমাত্রিক (Tri-dimensional) হিসেবেই দেখা যায়। স্বাভাবিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক প্রত্যক্ষণ ঘটে দর্শনের ক্ষেত্রে। এই দর্শনের ক্ষেত্রে কিছু স্বাভাবিক নিয়মকানুন আছে। আমরা জানি যে-কোনো বস্তু থেকে আলোকরশ্মি আমাদের চোখের লেন্স, চোখের অভ্যন্তরে অবস্থিত তরল পদার্থ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে গিয়ে রেটিনায় মিলিত হয় এবং তখনই আমরা বস্তুটির ছবি দেখি। রেটিনায় যাতে বস্তুটির সঠিক ছবি আসে, তার জন্য লেন্সের ঘনত্ব কমাতে ও বাড়াতে হয়। যেমন-দূরের জিনিস দেখার সময় চোখের মধ্যবর্তী লেন্সটি সংলগ্ন পেশিগুলির চাপে সমতল হয়ে ওঠে এবং কাছের জিনিস দেখার সময় লেন্সটি গোলাকার হয়ে ওঠে। লেন্সের ঘনত্ব কমানো বা বাড়ানোর ক্ষেত্রে যে পেশিগুলি সংকোচন ও প্রসারণের কাজ করে, সেগুলিকে বলে সিলিয়ারি পেশি। এই পেশিগুলির কাজকে বলা হয় উপযোজন।
এককথায় বলা যায়, চক্ষুলেন্সের ফোকাস দূরত্বের পরিবর্তন ঘটিয়ে বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত বস্তুর প্রতিবিম্বকে রেটিনায় গঠন করার ক্ষমতাকে উপযোজন বলা হয়।
অর্জিত প্রত্যক্ষণ (Acquired Perception)
কোনো একটি সংবেদন বিশেষ কোনো ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভূত হওয়ার কথা কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে যদি অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেও তার প্রত্যক্ষণটি ঘটে থাকে, তবে ওই ধরনের প্রত্যক্ষণকে অর্জিত প্রত্যক্ষণ বলা হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বলা যায়, যখন আমরা কোনো কিছু প্রত্যক্ষ করি, তখন সেই বস্তুটির কতকগুলি গুণকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে ওই বস্তুর অন্যান্য গুণকেও পরোক্ষভাবে জানা যায়।
যেমন-একটুকরো তুলো স্পর্শ করে নরম অনুভব হওয়ার পর তুলোর সাদা রং-এর গুণটি দর্শন সংবেদনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষণ করা যায়। অর্থাৎ তুলোর নরম গুণটি দর্শন সংবেদনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষণ করা যায়। অর্থাৎ তুলোর নরম গুণটির সঙ্গে সঙ্গে অপর আর-একটি গুণ রং অর্থাৎ তার সাদা রং প্রত্যক্ষণ করা হল অর্জিত প্রত্যক্ষণ।
২৯। প্রত্যক্ষণমূলক প্রশিক্ষণ সম্পর্কে লেখো। সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণ কী?
প্রত্যক্ষণমূলক প্রশিক্ষণ (Perceptual Training)
আধুনিক মনোবিদ ও শিক্ষাবিদগণ অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে পুথিগত জ্ঞানের পাশাপাশি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের উপর জোর দিয়েছেন।
রুশো (Rousseau), পেস্তালৎসি (Pestalozzi), ফ্রয়েবেল (Froebel), মন্তেসরি (Montessori), জন ডিউই (John Dewey) এনারা প্রত্যেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রত্যক্ষণের প্রশিক্ষণকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন, ফ্রয়েবেল তাঁর কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতিতে Gift and Occupation-এর কথা বলেছেন। আবার মন্তেসরি তাঁর শিক্ষাপদ্ধতিতে Didactic apparatus-এর কথা বলেছেন। তাই শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষণ আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য বর্তমান শিক্ষকরা Smart Class-এ বিভিন্ন ধরনের শ্রুতির্নিভর (Hearing aid), দর্শননির্ভর (Visual aid), শ্রাব্য-দৃশ্যনির্ভর (Hearing and Visual aid) উপকরণের সাহায্য নিয়ে থাকেন। তবে প্রত্যক্ষণ ত্রুটিপূর্ণ বা অসম্পূর্ণ হলে শিক্ষার্থীদের সাফল্য ব্যাহত হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো মিথ্যা বা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের শিকার না হয়, তার জন্যও শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সতর্ক থাকতে হবে ও উপযুক্ত প্রত্যক্ষণমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণ (Direct Perception)
আমরা পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক) মাধ্যমে বাহ্য পরিবেশ থেকে জ্ঞান অর্জন করি। যে প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মধ্য থেকে যে-কোনো একটির সাহায্য নিয়ে বস্তুর কোনো বিশেষ গুণকে নির্ধারণ করার প্রক্রিয়াটি সাধিত হয়, সেই প্রকার প্রত্যক্ষণকেই সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণ বলা হয়। যেমন-খুব ঠান্ডা জলে হাত দিয়ে স্পর্শ করলে ঠান্ডা ভাবটি সম্পর্কে সরাসরি জানা যায়। অর্থাৎ স্পর্শের মাধ্যমে জলটি যে ঠান্ডা সে বিষয়ে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণ ঘটে। এই ধরনের প্রত্যক্ষণকে মৌলিক প্রত্যক্ষণও বলা হয়।
আরও পড়ুন – শিক্ষামনোবিজ্ঞান প্রশ্ন ও উত্তর