জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর (Marks 2) Class 11 Second Semester
১। মার্কসবাদীরা কোন্ জাতীয়তাবাদকে ‘প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার বিরোধী’ বলে অভিহিত করেছেন এবং কেন?
মার্কসবাদীরা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদকে ‘প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার বিরোধী’ বলে অভিহিত করেছেন।
কারণ মার্কসবাদীদের মতে, বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ জাতিগত সংকীর্ণতা, বিদ্বেষ ও বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
২। জাতীয়তাবাদ গঠনের পথে দুটি সহায়ক উপাদানের নাম লেখো।
জাতীয়তাবাদ হল একটি ভাবগত ধারণা, যা বিচ্ছিন্ন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে।
জাতীয়তাবাদ গঠনের সহায়ক উপাদান: জাতীয়তাবাদ গঠনের পথে দুটি সহায়ক উপাদান হল- সাধারণ বাসস্থান এবং ঐতিহাসিক পটভূমি।
৩। জাতীয়তাবাদ গঠনের পথে দুটি অন্তরায় উল্লেখ করো।
জাতীয়তাবাদ হল এমন এক মতাদর্শ যা জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবিকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করে।
জাতীয়তাবাদ গঠনের অন্তরায়: জাতীয়তাবাদ গঠনের পথে দুটি অন্তরায় হল- আবেগিক সংহতির অভাব এবং সাম্প্রদায়িকতা।
৪। বিকৃত জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝো? বিকৃত জাতীয়তাবাদের দুজন প্রবক্তার নাম লেখো।
বিকৃত জাতীয়তাবাদ: যে জাতীয়তাবাদ মিথ্যা জাত্যভিমান সৃষ্টি করে অন্যান্য জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অবজ্ঞার মনোভাব পোষণ করে ও দেশকে পররাজ্য আক্রমণে ইন্ধন জোগায় তাকে বিকৃত জাতীয়তাবাদ বলা হয়।
বিকৃত জাতীয়তাবাদের অন্যতম দুজন প্রবক্তার নাম হল- মুসোলিনি (ইতালীয় জাতীয়তাবাদ) এবং হিটলার (জার্মান জাতীয়তাবাদ)।
৫। আদর্শ জাতীয়তাবাদ কাকে বলে? আদর্শ জাতীয়তাবাদের একজন সমর্থকের নাম লেখো।
আদর্শ জাতীয়তাবাদ: আদর্শ জাতীয়তাবাদ বলতে সেই জাতীয়তাবাদকে বোঝায়, যা জাতিকে সবরকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি যে-কোনো এক বা একাধিক কারণে ঐক্যবদ্ধ হতে প্রেরণা জোগায়, তাকে আদর্শ জাতীয়তাবাদ বলে।
আদর্শ জাতীয়তাবাদের একজন প্রবক্তা হলেন ম্যাৎসিনি।
.৬। জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্র কী?
জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্র: জাতীয়তাবাদ হল একটি মহান রাজনৈতিক আদর্শ। জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্র হল- ‘নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও’ জাতীয়তাবাদের এই মহান আদর্শ যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং এই নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে জাতির মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত ও সংঘর্ষের অবসান ঘটেছে।
৭। জাতীয়তাবাদ কীভাবে জাতির আত্মবিকাশের পথ প্রশ্বস্ত করে তা লেখো।
জাতির আত্মবিকাশে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা: পরাধীন দেশগুলির কাছে জাতীয়তাবাদ মুক্তির দিশারিরূপে কাজ করে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ পরাধীন জনগণকে স্বাধীনতা অর্জনে অনুপ্রাণিত করে। যার ফলে জাতির আত্মবিকাশের পথ প্রশ্বস্ত হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার জন্য ভারতবাসীরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ স্বাধীন ভারতের আবির্ভাব ঘটে।
৮। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ কাকে বলে?
বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ: যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দেশের ধনিক শ্রেণির হাতে রাষ্ট্রের সমগ্র উৎপাদন এবং মূলধন কেন্দ্রীভূত থাকে এবং মিডিয়া বা গণমাধ্যম শাসকের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় এবং দেশের অর্থনীতি তাদের স্বার্থবাহী হয়। এছাড়া ধনী শ্রেণি সমাজের সকল স্তরের মেহনতি মানুষের উপর শোষণ ও অত্যাচার চালায় তাকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ বলে।
৯। প্রলেতারীয় জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝায়?
প্রলেতারীয় জাতীয়তাবাদ: যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দেশের সর্বহারা শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিকানা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো থাকে এবং দেশের মেহনতি মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্রের সমগ্র উৎপাদন, সম্পদ ও মূলধন ব্যবহৃত হয় এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে প্রলেতারীয় জাতীয়তাবাদ বলে।
১০। কীভাবে জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে?
জাতীয়তাবাদ যেমন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে। জাতীয়তাবাদ অন্য দেশ বা জাতিকে ঘৃণা করতে উৎসাহিত করে। জাতীয়তাবাদ একটি অশান্তকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। যার ফলে ঘৃণা-বিদ্বেষের উদ্ভব ঘটে থাকে, যা বিশ্ব শান্তির বিরোধী।
১১। জাতীয়তাবাদের উদ্ভব সম্পর্কে লেখো।
জাতীয়তাবাদের উদ্ভব: জাতীয়তাবাদ হল একটি ভাবগত ধারণা। র্যামসে ম্যুর-এর মতে, জাতীয়তাবাদের অনুভূতি সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে লক্ষ করা যায়। এরপর চতুর্দশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের ধারণা অপ্রত্যক্ষ ও অস্পষ্ট ছিল। অন্যদিকে ষোড়শ শতাব্দীতে নিকোলো মেকিয়াভেলি ইতালির জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণা সঞ্চারিত করার চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। তা সত্ত্বেও অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীকে জাতীয়তাবাদের সুবর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করা হয়।
.১২। জাতীয়তাবাদকে একটি পরিবর্তনশীল ধারণা বলা হয় কেন?
জাতীয়তাবাদ একটি পরিবর্তনশীল ধারণা: জাতীয়তাবাদ কোনো স্থিতিশীল ধারণা নয়, এটি চলমান পরিবর্তনশীল ধারণা। আদিম সমাজের গোষ্ঠীগত চেতনাই ক্রমে ক্রমে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহায্য করেছে। মধ্যযুগে নানা বাধাবিপত্তির মধ্যে (যেমন- ভৌগোলিক যোগাযোগের বাধা, মধ্যযুগীয় কুসংস্কার প্রভৃতি) শিথিলতা সৃষ্টি হলেও ক্রমশ রেনেসাঁস, সার্বভৌমিকতা, আমেরিকার বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লবের উৎকৃষ্ট ফল হিসেবে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছে।
.১৩। জাতীয়তাবাদ কীভাবে গণতন্ত্রের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে?
সুশাসন সম্ভব: জাতীয়তাবাদ দেশের শাসনব্যবস্থাকে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল করে তোলে। এর ফলে দেশে শাসক-শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে বলেই আইনের নির্দেশ ও আইন মান্য করার মধ্যে সমতা বজায় থাকে।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক: জাতীয়তাবাদের আদর্শ কালক্রমে উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার আদর্শের জন্মদাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এইরূপ জাতীয়তাবাদী আদর্শ বিভিন্ন জাতিকে নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে, অপরদিকে তাদের গণতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে।
১৪। উগ্র জাতীয়তাবাদ কীভাবে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়?
উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে হেয় করে, তাদের উপর প্রভুত্ব কায়েমের চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে জাতির আত্মস্বার্থ ও অহংবোধ থেকে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম হয়। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার জার্মান জাতিকে উগ্র ও বিকৃত জাতীয়তাবাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ করে, তার সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন।
১৫। জাতীয়তাবাদকে মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে কীভাবে সাহায্য করে?
মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা: জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার বিকাশে সহায়ক, কারণ এর মাধ্যমেই পরাধীন জাতির মুক্তির মন্ত্র ধ্বনিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে (উদাহরণস্বরূপ-এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা, মালয়েশিয়া প্রভৃতি) জাতীয়তাবাদই তৃতীয় বিশ্বের জাতিগুলিকে নতুন চেতনা ও শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে মানবসভ্যতার উন্নতিতে সাহায্য করে।
১৬। জাতীয়তাবাদকে ‘আন্তর্জাতিকতায় উপনীত হওয়ার রাজপথ’ বলে জিমার্ন কেন মন্তব্য করেছেন?
জিমার্ন এর অভিমত: বংশ, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি যে-কোনো এক বা একাধিক কারণে একটি জনসমাজের মধ্যে গভীর একাত্মবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই একাত্মবোধের জন্য ওই জনসমাজের প্রত্যেকে সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায় ও মান-অপমানের সমান অংশীদার বলে নিজেকে মনে করে, তখন জাতীয়তা বোধের জন্ম হয়। এর সঙ্গে দেশপ্রেম মিলিত হয়ে সৃষ্টি করে, জাতীয়তাবাদের। জাতীয়তাবাদের দুটি রূপের মধ্যে আদর্শ রূপটি বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে সাম্য, সহযোগিতা, সৌভ্রাতৃত্বের পথ প্রশস্ত করে। এর ফলে খুব সহজেই এই পথ ধরে আন্তর্জাতিকতাবাদে পৌঁছোনো যায়। এ প্রসঙ্গে জিমার্ন বলেছেন, জাতীয়তাবাদ হল আন্তর্জাতিকতাবাদে পৌঁছোনোর রাজপথ।
১৭। গণসংযোগ কীভাবে জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে?
গণসংযোগ জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধির সহায়ক: গণসংযোগ বা যোগাযোগ ব্যবস্থার যত প্রসার ঘটবে, জনগণের সঙ্গে সরকারের বা সরকারের সঙ্গে জনগণের ততই সংযোগ বা সম্পর্ক বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে। এই কারণেই গণসংযোগ ব্যবস্থা গণসচেতনতা ও জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে কাজ করে, যা বিচ্ছিন্ন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করে।
১৮। কোন্ ধরনের জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তির বিরোধী এবং কেন?
জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তির বিরোধী: উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তির বিরোধী। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদ মিথ্যা জাত্যাভিমান সৃষ্টি করে অন্যান্য জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অবজ্ঞার মনোভাব পোষণ করে ও দেশকে পররাজ্য আক্রমণে ইন্ধন যোগায়। এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯। তৃতীয় বিশ্বে জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের কারণ কী?
তৃতীয় বিশ্বে জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের কারণ: সুদীর্ঘকাল যাবৎ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং নিপীড়নের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই কারণে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদকে অনেকে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতা বিরোধী জাতীয়তাবাদরূপে অভিহিত করেন। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে আর্থ- সামাজিক দমনপীড়ন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পশ্চিমি আধুনিক শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির সহায়ক অনুকূল প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলায় সচেষ্ট থাকে। এই পটভূমিকায় উপনিবেশগুলিতে পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা জাতীয়বাদী ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকরা এ ধরনের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন মোকাবিলার জন্য বিভিন্নরকম ব্যবস্থা নেয়। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি অবশ্য সামরিক তৎপরতা ও দমনপীড়নের মাধ্যমে এ ধরনের আন্দোলনকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের উন্মাদনা দমন করা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির পক্ষে একসময় কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তার জন্মলগ্নে কখনও প্রকাশ্যে, কখনও গোপনে পরিচালিত হয়। কোথাও সশস্ত্র, কোথাও অহিংস অসহযোগ আন্দোলন গড়ে ওঠে। ক্রমশ তা গণআন্দোলনের রূপ গ্রহণ করে।
২০। তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি আলোচনা করো।
তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি: সাধারণভাবে তৃতীয় বিশ্ব বলতে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলিকে বোঝায়। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগই হল তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসী। পাশ্চাত্যের ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ থেকে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ জোসেফ ফ্যাঙ্কেল-এর মতে, এই নতুন রাষ্ট্রগুলির মধ্যে কোনোটিই পশ্চিমি ইউরোপীয় ঐতিহ্যের জাতীয়তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এরা প্রত্যেকেই গোষ্ঠীগত, জাতিগত, ধর্মীয় এবং আঞ্চলিক দিক থেকে ভিন্নধর্মী। এদের ভূখণ্ডগত সীমানা কোনো অর্থপূর্ণ জাতীয় সীমানার সঙ্গে মানানসই নয়। সর্বোপরি স্বাধীনোত্তর যুগে এই সব দেশের সরকার জাতি গঠনের শ্রমসাধ্য কাজকে যে প্রাথমিক গুরুত্ব দিয়ে শুরু করেছিল, তা সাফল্য লাভ করতে পারেনি।
২১। তৃতীয় বিশ্বে জাতীয়তাবাদের দুটি বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের দুটি বৈশিষ্ট্য হল-
[1] ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী শক্তি: তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে। তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য জনগণের মনে এক সংগ্রামী স্বদেশ চেতনার জন্ম দিয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে খণ্ডিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতি গঠনের উদ্যোগ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়া, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা প্রভৃতি দেশের কথা উল্লেখ করা যায়।
[2] নেতিবাচক বৈরী মনোভাব: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এক নেতিবাচক বৈরী মনোভাবের মধ্য দিয়ে। ঔপনিবেশিক শক্তির অপশাসন ও নিপীড়নের ফলে জনগণের মধ্যে প্রবল বিরোধী মানসিকতা গড়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জনগণের নেতিবাচক শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে এই জাতীয়তাবাদ আত্মপ্রকাশ করে। জাতি গঠনের পক্ষে ইতিবাচক উপাদানগুলি তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ততটা সক্রিয় ছিল না। শ্রমিক, কৃষকের মতো সমাজের তৃণমূলস্তরের জনগণের আর্থ-সামাজিক বিকাশ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, সমাজসংস্কার, জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়গুলি নিয়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা সফল উদ্যোগ নিতে পারেননি।
২২। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কাকে বলে? এই তত্ত্বের বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, এমন প্রবক্তাদের নাম লেখো।
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার: প্রত্যেক জাতীয় জনসমাজেরই একটি নিজস্ব পৃথক সত্তা রয়েছে। একমাত্র পৃথক রাষ্ট্র গঠনের মধ্যেই সেই সত্তা পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। প্রত্যেক জাতিসত্তার নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের অধিকার ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে স্বাভাবিক অধিকারের স্বীকৃতি লাভ করে। জাতিসত্তার নিজস্ব রাষ্ট্রনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের এই অধিকারই হল তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার।
বিপক্ষে যুক্তি প্রদানকারী প্রবক্তাগণ: আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকারের সপক্ষে যেমন বহুতাত্ত্বিক মতামত দিয়েছেন, তেমনি লর্ড কার্জন এবং লর্ড অ্যাক্টন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন।
২৩। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে উইলসনের বক্তব্যটি কী?
প্রতিটি আত্মসচেতন জাতির স্বতন্ত্র সত্তা ও বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলা হয়। জাতীয়তার ভিত্তিতে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের এই অধিকার এক জাতি এক রাষ্ট্র (“One Nation, One State”) বা জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্ব দ্বারা সমর্থিত।
উইলসন এর বক্তব্য: প্রতিটি জাতিকে যদি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা হয়, তাহলে যুদ্ধের অন্যতম কারণকে সমূলে উৎপাটিত করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার সত্তা হিসেবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে আহবান জানিয়েছেন।
২৪। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সুফল সম্পর্কে লর্ড অ্যাক্টন কী বলেছেন? আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলতে বার্ট্রান্ড রাসেল কী বুঝিয়েছেন?
লর্ড অ্যাক্টন-এর অভিমত: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সুফল সম্পর্কে লর্ড অ্যাক্টন বলেছেন, একটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন জাতির উপস্থিতি সেই রাষ্ট্রের সভ্যতা, সংস্কৃতি প্রভৃতিকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
বার্ট্রান্ড রাসেল-এর বক্তব্য: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলতে গিয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল খুব সুন্দর একটা উপমা প্রয়োগ করেন। তাঁর মতে, “কোনো জাতীয় জনসমাজকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য একটি সরকারের অধীনে থাকতে বাধ্য করা আর যে নারী কোনো একটি পুরুষকে ঘৃণা করে, তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা- একই কথা।”
২৫। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলতে জন স্টুয়ার্ট মিল কী বুঝিয়েছেন? অথবা, জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে কেন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করা উচিত?
জন স্টুয়ার্ট মিল এর অভিমত: জন স্টুয়ার্ট মিল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্যের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখান। মিলের মতে, বহুজাতিক রাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্ভাব ও সম্প্রীতি থাকে না। এ ধরনের রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু জাতীয় জনসমাজ অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতীয় জনসমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে। সরকার গঠনে সংখ্যালঘুদের কোনো ভূমিকা থাকে না বলে তাদের অধিকার উপেক্ষিত হয়। তাই বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে স্বাধীন রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
২৬। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বের মূল স্লোগান কি? এই তত্ত্বের সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, এমন প্রবক্তাদের নাম লেখো।
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বের মূল স্লোগান হল- ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ (One Nation, One State) I
এই তত্ত্বের সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন এমন দুজন প্রবক্তা হলেন-জন স্টুয়ার্ট মিল এবং উড্রো উইলসন।
২৭। মার্কসবাদ অনুসারে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কী?
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে মার্কসবাদীদের বক্তব্য: জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সম্পর্কে যে তত্ত্বগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল, তার মধ্যে মার্কসবাদ অন্যতম। মার্কসবাদ অনুসারে, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হল জাতীয় শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে এক আন্তর্জাতিক বন্ধন তৈরির পক্ষে বিভিন্ন দেশের সর্বহারাদের আন্দোলন, মার্কসবাদে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রগতিশীল আন্দোলন বলে অভিহিত করা হয়েছে।
২৮। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রসঙ্গে লর্ড কার্জন কী বলেছেন? আত্মনিয়ন্ত্রণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এমন দুটি রাষ্ট্রের নাম লেখো।
লর্ড কার্জন এর অভিমত: লর্ড কার্জনের মতে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্ব হল এমন একটি অস্ত্র যার দু-দিক ধার আছে। যেমন একদিকে এই নীতিটি একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন করে তুলতে সাহায্য করে, অন্যদিকে তেমনি বিভিন্ন জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, বিদ্বেষ ও সন্দেহের সৃষ্টি করে বৈরী মনোভাবের জন্ম দেয়।
আত্মনিয়ন্ত্রণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দুটি রাষ্ট্র হল-ভারত, বাংলাদেশ।
২৯। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে লর্ড অ্যাকটনের বক্তব্য কী?
লর্ড অ্যাক্টন এর অভিমত: লর্ড অ্যাক্টনের মতানুসারে, ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইতিহাসের পশ্চাৎগতির লক্ষণ’ (“The Theory of Nationality is a retrograde step in history”)। এই সভ্য সমাজে মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে থাকার বদলে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চাইলে তা মানবসমাজে পশ্চাৎগতির সূচনা করে। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে লর্ড অ্যাক্টন আরও বলেন যে, শক্তির যেসব উপাদান একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে দেখা যায়- বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে তা অনুপস্থিত থাকে। এই কারণেই রাষ্ট্রীয় সীমারেখার মধ্যে শুধুমাত্র একটি জাতি বাস করলে সেই জনসমাজ কখনোই উন্নত হতে পারে না বলেই বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন দেখা দেয়।
৩০। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রেণের অধিকার নীতির সপক্ষে যুক্তি লেখো।
অথবা, ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র নীতির সপক্ষে দুটি যুক্তি লেখো।
জাতির আত্মনিরন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে দুটি যুক্তি হল-
[1] গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে উপযুক্ত: জন স্টুয়ার্ট মিল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্যের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখান। মিলের মতে, বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্ভাব ও সম্প্রীতি থাকে না। এ ধরনের রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু জাতীয় জনসমাজ অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতীয় জনসমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
[2] বিশ্বসভ্যতার বিকাশে সহায়ক: জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নীতির প্রবক্তারা একে জাতীয় গুণাবলির বিকাশের সহায়ক বলে দাবি জানান। তাঁদের মতে প্রতিটি জাতির নিজস্ব কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এসব বৈশিষ্ট্যের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ শুধুমাত্র জাতীয় সরকারের মাধ্যমেই ঘটা সম্ভব নয়। এর ফলে জাতীয় অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
৩১। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে দুটি যুক্তি দাও? অথবা, এক জাতি এক রাষ্ট্র নীতির বিপক্ষে দুটি যুক্তি দাও।
জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে দুটি যুক্তি হল-
[1] সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলি বহু বিভক্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হবে: ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ নীতি স্বীকৃত হলে পৃথিবীর সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলি বহু বিভক্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তার ফলে বিশ্বজুড়ে বিশৃঙ্খলা ও জটিল রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র যে শুধু আকৃতিতে ক্ষুদ্র হবে তাই নয় প্রকৃতিতেও এই রাষ্ট্রগুলি দুর্বল হয়ে পড়বে। এসব ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র কখনও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারবে না। এরা বৃহৎ সম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির শিকারে পরিণত হবে।
[2 বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে উন্নত: ইংরেজ দার্শনিক লর্ড অ্যাক্টনের অভিমত হল, বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে উন্নততর পর্যায়ে যেতে সমর্থ হয়। কারণ অনগ্রসর জাতির সান্নিধ্যে বসবাস করে উন্নত হয়ে ওঠার সুযোগ পায়, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সীমারেখার ভিতরে যেখানে শুধু একটিমাত্র জাতি বাস করে সেই সমাজ অনগ্রসর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩২। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রসঙ্গে লেনিন ও স্তালিনের মতামত আলোচনা করো।
লেনিন ও স্তালিন এর অভিমত: লেনিনের মতানুসারে, ‘জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলতে কেবল রাজনীতিক অর্থে স্বাধীনতার অধিকারকে; অত্যাচারী জাতির বন্ধন থেকে অবাধ রাজনীতিক পৃথকীকরণের অধিকারকেই বোঝায়’। স্তালিনের মতানুসারে, ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলতে প্রতিটি জাতির নিজস্ব ভাগ্য নির্ধারণের অধিকারকে বোঝায়। কোনো জাতির জীবনে জোর করে হস্তক্ষেপ করার অথবা তার বিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার কিংবা তার আচার ব্যবহারের অন্যথা করার অথবা তার ভাষাকে দমন করার বা তার অধিকারকে সংকুচিত করার কোনো অধিকার কারও নেই। এই হল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অর্থ।
৩৩। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের উদ্ভবের ইতিহাস (History of Emergence) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উদ্ভবের ইতিহাস: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বস্তুত একটি প্রাচীন মতবাদ। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের বিভক্তিকরণের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বল জাতির অধিকার সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাতে এই ধারণার জন্ম হয় এবং উনিশ শতকের মধ্যভাগে তা প্রবল আকার ধারণ করে। পরবর্তীকালে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা কংগ্রেসে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি ওঠে। ইতালীয় দার্শনিক ম্যাৎসিনি প্রচার করেন যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজের স্বাভাবিক অধিকার। লেনিন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে জার-শাসিত জাতিগুলির জাতীয় স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সপক্ষে দাবি জানান। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ১৪ দফা প্রস্তাবের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সমর্থনে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপিত করেন।
৩৪। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সভ্যতা বিকাশের সহায়ক বলে কেন মনে করা হয়?
সভ্যতা বিকাশের সহায়ক: প্রতিটি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র ও সরকার থাকলে সেই জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির দ্রুত বিকশিত হয়। বিশ্বব্যাপী সভ্যতার বিকাশে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বসংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি সম্ভব হতে পারে। কাজেই বিশ্বসভ্যতার বিকাশের স্বার্থে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করা দরকার। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, “বৈচিত্র্য এবং অনেক সময় বিরোধী প্রবৃত্তির দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন নেশন সভ্যতা বিস্তারকার্যে সহায়তা করিতেছে।” এইভাবে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার বিশ্বসভ্যতার বিকাশে সহায়ক হিসাবে কাজ করে।”
৩৫। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কীভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সমন্বয় করে?
ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সমন্বয়সাধন: একটি জাতির নিজস্ব সরকার থাকলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার সুষ্ঠু সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়। অনেকে ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বার্থে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে যুক্তির অবতারনা করেন। তাছাড়া একটি রাষ্ট্রে শুধুমাত্র একটি জাতি থাকলে কোনো অভ্যন্তরীণ বিবাদ বিসংবাদ না থাকায় প্রত্যেকে নিজের দেশকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে সক্ষম হয়। এই দেশপ্রেম বহুজাতি সমন্বিত রাষ্ট্রে দেখা যায় না, সেখানে বিভিন্ন জাতির নিরন্তর পারস্পরিক বিরোধে দেশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩৬। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দুটি বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বৈশিষ্ট্য দুটি নিম্নে আলোচনা করা হল-
[1] জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের মাধ্যমে জাতির সুষ্ঠু গুণাবলি, চেতনা, সংগঠন প্রভৃতির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
[2] স্বাভাবিক অধিকারের মর্যাদা পায়: এই অধিকারটি স্বাভাবিক অধিকারের মর্যাদা পায়। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার না থাকলে জাতিগত বিরোধ, হিংসা, সংঘর্ষ ইত্যাদি অনিবার্য হয়ে উঠত।
৩৭। উদ্দ্বাস্তু সমস্যার মূলে কোন্ তত্ত্ব দায়ী এবং কেন দায়ী?
উদ্বাস্তু সমস্যার মূলে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বটি দায়ী।
কারণ: বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলিকে জাতীয়তার ভিত্তিতে পৃথক করতে গেলে এমন সব অভিনব সমস্যার সৃষ্টি হবে, যার ফলে পৃথক্করণের মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যাবে। উদাহরণ হিসাবে উদ্বাস্তু সমস্যার কথা বলা যায়। অবিভক্ত ভারতকে ভাগ করার পর অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর অগণিত হিন্দু পরিবার ছিন্নমূল হয়ে ভারতে চলে আসে। ফলে ভারতীয় অর্থনীতি অন্তত সাময়িকভাবে হলেও সংকটের মুখে পড়েছিল।
৩৮। আত্ম সংকল্প বলতে কী বোঝো?
আত্ম সংকল্প: আত্ম সংকল্প বলতে একটি জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক সত্তা গঠনের অধিকারকে বোঝায় এবং অভ্যন্তরীণ স্ব-সংকল্পপূর্ণ ভোটাধিকারসহ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের অধিকার, আন্তর্জাতিক আইনে এটি একটি প্রধান নীতি হিসাবে স্বীকৃত হয়।
৩৯। রবীন্দ্রনাথের মতে, জাতীয়তাবাদ কখন সভ্যতার শত্রুতে পরিণত হয়?
জাতীয়তাবাদ সভ্যতার শত্রু ব্যাখ্যা: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, ইউরোপ তথা পশ্চিমের যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি হল জাতীয়তাবাদ। তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ (Nationalism) গ্রন্থে তিনি পশ্চিমি বা ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ শুধু ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিরোধ আর বিভেদের জন্ম দেয়। এই কারণে পশ্চিমি দেশগুলিতে মারামারি-হানাহানি নিরন্তর ঘটে চলেছে। নিজের দেশ, নিজের জাতি বড়ো আর অন্য সব দেশ, অন্য সব জাতি ছোটো ও নীচ- জাতীয়বাদের এই ধারণা সংকীর্ণ মানসিকতার জন্ম দেয় এবং তা ক্রমশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। তিনি আরও বলেন যে, জাতীয়তাবাদ যখন আদর্শচ্যুত হয়ে ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ স্বাদেশিকতায় পরিণত হয়, তখন তা সভ্যতার শত্রুতে পরিণত হয়। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ওই ধ্বংসকারী উগ্র রূপ দেখেই রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, জাতীয়তাবাদ সভ্যতার শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
৪০। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বৈশ্যরাজকতন্ত্র’ বলতে কী বুঝিয়েছেন?
বৈশ্যরাজকতন্ত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য: পশ্চিমি ধাঁচের জাতীয়তাবাদ রবীন্দ্রনাথকে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। ইউরোপের জাতীয়তাবাদ ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিরোধ প্রভৃতির মাধ্যমে যে সাম্রাজ্যবাদের বীজ বপণ করেছিল তা ক্রমশ দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে গ্রাস করে। সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তাঁর এরূপ বিরাগ আসলে সাম্রাজ্যবাদের রূপ ধারণকারী সেই ধনতান্ত্রিক সভ্যতার প্রতীক, যাকে তিনি ‘বৈশ্যরাজকতন্ত্র’ নামে অভিহিত করেছেন এবং তিনি পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের আধিপত্যকারী রূপকে তীব্র নিন্দা করেছেন।
৪১। শিক্ষার মিলন প্রবন্ধটি কার লেখা? শিক্ষার মিলন প্রবন্ধে তিনি কী বলেছিলেন?
‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত।
শিক্ষার মিলন প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য: রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষার মিলন প্রবন্ধে উগ্র জাতীয়তাবাদের স্বরূপকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, জাতি (Nation) গঠিত হয়েছে সত্যের জোরে কিন্তু জাতীয়তাবাদ (Nationalism) সত্য নয়। তাঁর মতে, জাতীয়তাবাদ এমন এক ধরনের দুর্বুদ্ধি যেখানে দেশের আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পায়। এ এমন এক প্রবণতা যেখানে সকলের দিকে নয়, নিজের দিকেই টান বেশি থাকে।
৪২। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, জাতীয়তাবাদ কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ধারণা নয়, এটি একটি কৃত্রিম বন্ধন, যার ভিত্তি হল অর্থ ও ক্ষমতা। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা মূলত পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়ারূপে প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভাবনার তিনটি ধারা রয়েছে, যথা- ইংরেজ শাসনের অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শগত বিরোধকে তুলে ধরা এবং স্বদেশিকতার গঠন মূলক ভাবনা প্রকাশ করা।
৪৩। জাতীয়তাবাদ হল মানবসভ্যতার শত্রু- এই উক্তিটি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করো।
জাতীয়তাবাদ হল মানবসভ্যতার শত্রু ব্যাখ্যা: জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার শত্রু না মানবসভ্যতার কাছে আশীর্বাদস্বরূপ তা মূলত নির্ভর করে জাতীয়তাবাদকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার উপর। জাতীয়তাবাদ যদি উগ্র রূপ ধারণ করে তবে তা সকল জাতির কাছে বিভীষিকার মতো, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ যদি দেশপ্রেমের সমার্থক হয়ে ওঠে তবে তা মানবজাতির কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।
একদা মানব জাতির কল্যাণে এবং ঔপনিবেশিক পরাধীন জাতির মুক্তি আন্দোলন বা স্বাধীনতা সংগ্রামে যে জাতীয়তাবাদের প্রেরণা সমগ্র ইউরোপে জাতি রাষ্ট্রের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, সেই জাতীয়তাবাদই উগ্ররূপ ধারণ করে বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সমগ্র পৃথিবীকে বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে, সেই কারণে অনেকে জাতীয়তাবাদকে মানবসভ্যতার শত্রু বলে অভিহিত করেছেন।
৪৪। ‘জাতীয়তাবাদ হল মানবসভ্যতার শত্রু- এই উক্তিটির সমর্থনে যুক্তি দাও।
‘জাতীয়তাবাদ হল মানবতার শত্রু’-উক্তিটির সমর্থনে দুটি যুক্তি হল-
[1]. সাম্রাজ্যবাদের আশঙ্কা: ঐতিহাসিকভাবে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের উদ্ভব হয় উদীয়মান মধ্যবিত্ত এবং বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশকে ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনে, যা অভ্যন্তরীণ বাজার দখল সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আবশ্যক। তাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে বাজার দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যার ফলস্বরূপ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
[2]. অগণতান্ত্রিক: জাতীয়তাবাদের উগ্র রূপটি গণতন্ত্রের বিরোধী। জাতীয়তাবাদের উগ্র, হিংস্র, বীভৎস প্রকাশ গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার ও সমস্ত মানবিক চেতনার পরিপন্থী। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘জাতীয়তাবাদ হল সভ্যতার সংকটস্বরূপ’।
৪৫। ন্যাশনালিজম গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ন্যাশনালিজম গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য: জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি প্রবেশ করেছেন তাঁর ন্যাশনালিজম (Nationalism) সংক্রান্ত বক্তৃতা সংকলনে। তিনি প্রধানত জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ভাবনার সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতার ঐক্যবদ্ধ ধারণার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি ন্যাশনালিজম গ্রন্থে লিখেছেন যে, জাতীয়তাবাদ (উগ্র) মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার মনুষ্যত্বকে অবরুদ্ধ করে। অর্থাৎ কাল্পনিক এক সমষ্টির কাছে ব্যক্তিকে বলি দিয়ে মানুষের সৃজনশীল সত্তার বিকাশকে ব্যাহত করে।
৪৬। জাপানের জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ধারণা আলোচনা করো।
জাপানের জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য : জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা মূলত পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘জাতিই জাতির বড় শত্রু’। জাপান পাশ্চাত্য সভ্যতাকে অনুসরণ করে নেশনে পরিণত হয়েছিল, বর্তমানে সেই জাপানই পাশ্চাত্য দেশগুলির বড়ো শত্রুতে পরিণত হয়েছে। জাপানের এই বিরোধের – মনোভাবকে রবীন্দ্রনাথ ধিক্কার জানিয়েছেন। জাপান ইউরোপের ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করতে পারেনি, তার নেতিবাচক সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়।
৪৭। পশ্চিমি বা ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আলোচনা করো।
ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা: রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমি সভ্যতার মনোভাব ও তার তাগিদে পররাজ্যগ্রাস প্রবৃত্তিকে ধিক্কার জানান। যদিও তিনি পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু জাতীয়তাবাদের নামে পাশ্চাত্যে যে সংঘবদ্ধ দানব শক্তি প্রদর্শিত হয়, তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কলমের মাধ্যমে তীব্র কশাঘাত হেনেছিলেন। তদানীন্তন ইউরোপীয় রাষ্ট্রদার্শনিকগণ যখন জাতীয়তাবাদকে একটি মহান আদর্শ হিসেবে সাদরে গ্রহণ করেছেন ও জাতীয় রাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ মানবিক সংস্থা হিসেবে পুজো করার পরামর্শ দিয়েছেন, তখন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে জাতীয়তাবাদকে সেইরূপ আশীর্বাদ হিসেবে ভাবা সম্ভব ছিল না। এই কারণেই তিনি তাঁর জাতীয়তাবাদী তত্ত্বে এই আদর্শের নগ্ন, বীভৎস ও অন্যায় রূপটিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
৪৮। ভারতের জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন?
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ-এর বক্তব্য : রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ন্যাশনালিজম্ ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও সংস্কৃতি যেমন ভারতের মঙ্গলসাধন করেছে, অন্যদিকে তেমনি তার সভ্যতার দানবীয় রূপ যে বিষাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, তা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছে। ভারত কখনই পাশ্চাত্যের ধারণায় ‘নেশন’ বা ‘জাতি’ ছিল না। ভারতের ‘জাতি’ সম্পর্কিত সমস্যা থাকলেও তা রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল না, ভারতের সামাজিক ব্যবস্থা তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। ভারতের কাম্য হল মহত্তম মানবিক ও আধ্যাত্মিক ঐক্যে উদ্বুদ্ধ এক বিশ্বজনীন আদর্শের দেশে পরিনত হওয়া।
তিনি তাঁর ‘আত্মশক্তি’ নামক গ্রন্থে ভারতবাসীর আত্মোন্নতির কথা বলেছেন। ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদ ভারতীয় জাতীয়বাদের বিকাশে নানান অন্তরায় সৃষ্টির প্রচেষ্টা করত, যাতে ভারতের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়। তাঁর মতে, ভারতের ঐতিহ্য হল বিভিন্ন গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও মতের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা।
৪৯। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত আলোচনা করো।
পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য: জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরনের। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ নামক প্রবন্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব থেকে পশ্চিমি জাতীয়তাবাদের ধারণা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ ঐক্য, সংহতি, সৌভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী নয়। পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদ ধর্ম, নৈতিকতাবোধ, মানবতাবাদ ও মূল্যবোধবর্জিত বলেই আজ পশ্চিমি দেশগুলিতে মারামারি ও হানাহানি দেখা যাচ্ছে। তিনি প্রত্যক্ষ করেন ইউরোপীয় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি নিজেদের ক্ষমতার দাম্ভিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যেই পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটিয়েছিল এবং নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতিসহ সবকিছুই এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশসমূহের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। জাপান ও আমেরিকা এই জাতীয়য়বাদকে উগ্র পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। জাতীয়তাবাদের এই উগ্র রূপটিকে রবীন্দ্রনাথ তীব্র ধিক্কার জানায়।
৫০। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত আলোচনা করো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ন্যাশনালিজম্ ইন দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থে বিশেষত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের বিষাদরূপ রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে ব্যথিত করে। পাশ্চাত্য সভ্যতার এই আগ্রাসী মনোভাব বিকৃত দানবে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথের চোখে এরূপ জাতীয়তাবাদ ‘মানবতার শত্রু’। নিজের দেশ, নিজের জাতি বড়ো আর অন্য সব দেশ অন্য জাতি ছোটো ও নীচ জাতীয়তাবাদের এই ধারণা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে উঠে আসে এবং দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে গ্রাস করে সমগ্র বিশ্বে আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা করে।
৫১। রবীন্দ্রনাথ জাতিপূজার বিরোধিতা করেছিলেন কেন? অথবা, রবীন্দ্রনাথ মানবতাবাদের আদর্শকে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন?
জাতিপূজার বিরোধিতা অথবা মানবতাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে মানবধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসাবে পূজিত হত। অর্থাৎ মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের কাছে মানুষই ছিল বড়ো। তাই জাতি-পূজার তিনি কঠোর বিরোধিতা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, জাতীয়তাবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তাতে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে। ব্যক্তিমানুষ ‘নেশনের’ অধীনে যন্ত্রে পরিণত হয়। জাতীয়তাবাদের জাতীয় গরিমার আবেগ মানুষের মনে বিভেদের সৃষ্টি করে তা ক্রমশ মানুষকে দানবে পরিণত করে। যার ফলে মানুষের যাবতীয় শুভচিন্তা, শুভ চেতনা সব ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার সংকট ডেকে আনে।
৫২। কে, কেন পশ্চিমি সভ্যতাকে ‘জন্তুর সভ্যতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন?
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পশ্চিমি সভ্যতাকে ‘জন্তুর সভ্যতা’ বলে চিহ্নিত করেছে।
পশ্চিমি সভ্যতাকে জন্তুর সভ্যতা বলার কারণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নৈবদ্য’ নামক কাব্য গ্রন্থে পশ্চিমি সভ্যতার বিকৃত, উগ্র এবং স্বার্থান্বেষী দিকটির স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছিলেন। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা মূলত পাশ্চাত্য জাতীয়বাদ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়ারূপে প্রকাশিত হয়েছে। পশ্চিমি ধাঁচের জাতীয়তাবাদ যন্ত্রনির্ভর এবং এটি শুধু ঘৃণা, বিদ্বেষ বিরোধ আর বিচ্ছেদের জন্ম দেয়। এর ফলস্বরূপ জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক ইর্ষানল প্রজুলিত হয়ে একটি জাতি অপর এক জাতির শত্রুতে পরিণত হয়। তাই, তিনি পশ্চিমি সভ্যতাকে ‘জন্তুর সভ্যতা’ বলেছেন।
৫৩। রবীন্দ্রনাথের মতে, জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক না পরিপন্থী?
রবীন্দ্রনাথের মতে, জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী।
জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী কারণ: তদানিন্তন ইউরোপীয় রাষ্ট্রদার্শনিকগণ যখন জাতীয়তাবাদকে একটি মহান আদর্শ হিসাবে সাদরে গ্রহণ করছে ও জাতীয় রাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ মানবিক সংস্থা হিসাবে পূজা করার পরামর্শ দিয়েছেন, তখন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে জাতীয়তাবাদকে সেইরূপ আশীর্বাদ হিসাবে ভাবা সম্ভব ছিল না। এই কারণেই তিনি তাঁর জাতীয়তাবাদী তত্ত্বে এই আদর্শের নগ্ন, বীভৎস ও অন্যায় রূপটি তুলে ধরতে চেয়েছেন। জাতীয়তাবাদের নামে পাশ্চাত্যে যে সংঘবদ্ধ দানব শক্তি প্রদর্শিত হয়, তার প্রতি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কলমের মাধ্যমে তীব্র কশাঘাত হেনেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশ্বমানবতাবাদী, আন্তর্জাতিকতাবাদী বিশ্বজনীন ব্যক্তিত্ব এবং তিনি বিশ্বমৈত্রীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকতার ও মানবতার প্রকৃত বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।
৫৪। বঙ্কিমচন্দ্র ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকে কী বলেছেন এবং কেন বলেছেন?
বঙ্কিমচন্দ্র ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকে ‘ঘোরতর পৈশাচিক পাপ’ বলে ধিক্কার জানিয়েছেন।
মন্তব্যের কারণ: ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের অসহিষুতা, গোঁড়ামি, বর্ণবিদ্বেষ, সংকীর্ণতা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে যে বিকৃত জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে, তার ফলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক হিংসা ও হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। প্রকৃতপক্ষে, জাতির আত্মস্বার্থ ও অহংবোধ থেকে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম হয়। তাই, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকে অন্যায় ও অমঙ্গল প্রতিষ্ঠাকারী হিসাবে চিহ্নিত করে বঙ্কিমচন্দ্র একে ‘ঘোরতর পৈশাচিক পাপ’ বলে ধিক্কার জানিয়েছেন।
৫৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন্ গ্রন্থটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়? রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করে কোন্ ফরাসি মনীষী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করে ফরাসি মনীষী রোমাঁ রোলাঁ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন।
৫৬। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সমালোচনা করো।
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সমালোচনা:
[1] সাম্রাজ্যবাদ, রাষ্ট্রবাদ, ধনতন্ত্র, সর্বনিয়ন্ত্রণবাদ, প্রভৃতি ধারণার সঙ্গে জাতীয়তাবাদকে এক সারিতে এনে রাষ্ট্রতত্ত্বের ক্ষেত্রে সুবিচার করেননি।
[2] ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত রাষ্ট্রনেতাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
আরও পড়ুন – ছুটি গল্পের প্রশ্ন ও উত্তর