মৌলানা আবুল কালাম আজাদের শিক্ষা সম্পর্কিত ধারণা আলোচনা করো
মৌলানা আবুল কালাম আজাদের শিক্ষা সম্পর্কিত ধারণা
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত মানুষ হিসেবে তিনি মনে করতেন, খাদ্য-বস্ত্রের পরেই শিক্ষার স্থান। স্বাধীনতার পরে নেহরু মন্ত্রীসভায় শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব তিনি দীর্ঘ দু-দশকের বেশি সময় জুড়ে আমৃত্যু পালন করে গেছেন। সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের শিক্ষার উন্নতি ও সংস্কারের জন্য যেসব কর্মসূচি ও পদক্ষেপ মৌলানা আজাদ নিয়েছিলেন, তা এককথায় যুগান্তকারী। মৌলানা আজাদের শিক্ষা কর্মসূচি ও নীতির উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল-
[1] শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ: মৌলানা আজাদ ভারতীয় সমাজের জাতপাতভিত্তিক কুসংস্কার, বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদ ব্যবস্থার অস্তিত্ব দেখে এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, অসাম্যের শিকড় অনেক গভীরে থেকে গেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র শিক্ষাই পারে এসব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এজন্য তিনি প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগসুবিধার মধ্যে একটা সমতা আনতে চেয়েছিলেন।
বয়স্ক শিক্ষা (Adult Education)-এর ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন। বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমে তিনটি উদ্দেশ্যকে রূপায়িত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল-(i) নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও সাক্ষরতার প্রসারণ, (ii) নাগরিক সচেতনতা বিশেষ করে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানের সঞ্চার (iii) শিক্ষিত মানসিকতার বিকাশ।
[2] বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ: মৌলানা আবুল কালাম আজাদ দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপরে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল উচ্চতর প্রযুক্তিগত শিক্ষায় ভারতকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা, যাতে কারিগরি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কোনো দেশের উপরে আমাদের নির্ভর না করতে হয়। সেই সঙ্গে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক দিনের যখন বিদেশের মানুষরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে ছুটে আসবে। ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব টেকনোলজি (আই আই টি) খড়গপুরের উদ্বোধনে (1951 খ্রিস্টাব্দে, আগস্ট) তাঁর এই প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছিলেন মৌলানা আজাদ।
[3] জাতীয় সংহতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা: মৌলানা আজাদ মনে করতেন শিক্ষার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হবে ভারতের জাতীয় সংহতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। এজন্য ইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সাহিত্যের পাঠ্যবইগুলিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বিষয়টিকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এতে ছাত্রছাত্রীদের মনে প্রথম থেকেই নিজেদের দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি প্রগতিশীল মানসিকতা গড়ে উঠবে।
[4] পাঠক্রম ও শিক্ষা: মৌলানা আবুল কালাম আজাদের অভিমত ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষার পাঠক্রম থেকে স্বাধীন ভারতের শিক্ষার পাঠক্রম সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির হবে। এজন্য স্বাধীন ভারতে প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব হাতে নিয়ে তিনি ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শিক্ষার পুরানো পাঠক্রমকে বর্জন করেছিলেন। মৌলানা আজাদ শিক্ষা পাঠক্রমকে নতুনভাবে যে রূপ দিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল-
- i . প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম: শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে ‘কাজের মাধ্যমে শিখি’ বা ‘Learning by doing’-এর নীতিকে গ্রহণ করা হয়েছিল, যাতে করে ছাত্রছাত্রীরা হাতেকলমে বাস্তব শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে।
- ii. মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম: স্বাধীনতার পরে শিক্ষামন্ত্রী আজাদের নির্দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন (1952) স্বাধীন ভারতে মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমকে নতুনভাবে সাজিয়েছিল।
- iii. উচ্চ শিক্ষার পাঠক্রম: উচ্চ শিক্ষার পাঠক্রমকে বাস্তবসম্মত করে গড়ে তোলার জন্য বিশেষীকরণের ক্ষেত্রগুলিকে (specialized fields) জোর দেওয়া হয়।
- iv. বয়স্ক শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার পাঠক্রম: বয়স্ক শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার পাঠক্রমকে এমনভাবে সাজানো হয় যাতে বয়স্ক শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে জাতীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং সেই সঙ্গে দেশের সামাজিক উন্নয়নে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখা যায়।
- v. গ্রামীণ শিক্ষার পাঠক্রম: মৌলানা আবুল কালাম আজাদ গ্রামীণ ক্ষেত্রে কৃষি ও অন্যান্য বিষয়-সহ বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
- vi. শারীরিক শিক্ষার পাঠক্রম: শারীরিক শিক্ষায় (Physical education) বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, শরীরচর্চা ইত্যাদি বিষয়কে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে ছাত্রছাত্রীরা সুস্থ ও সবল দেহ- মনের অধিকারী হতে পারে। এভাবে নিছক জ্ঞান অর্জনের মধ্যে শিক্ষার পাঠক্রমকে সীমিত করে না রেখে তার মধ্যে বৈচিত্র্যের প্রসার ঘটানো হয়।
[5] শিক্ষার মাধ্যম: শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষার উপরে মৌলানা আজাদ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষামন্ত্রক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তা হল-
- i. প্রাথমিক শিক্ষায় স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষাকে গুরুত্ব দান।
- ii. আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষায় ইংরেজিকে গুরুত্ব দান।
[6] শিক্ষকের ভূমিকা: আবুল কালাম আজাদ শিক্ষকের ভূমিকাকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে রোল মডেল বা আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজে যা শেখাবেন তা যেন নিজের জীবনেও অনুশীলন করেন। আজাদ মনে করতেন ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র গঠনে শিক্ষকের বড়ো ভূমিকা রয়েছে। শুধু তা-ই না ছাত্রছাত্রীদের অন্তর্নিহিত প্রতিভার বিকাশে, সৃজনশীল কাজে, ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায়, জাতীয় সংহতি ও একতা রক্ষায় এবং নিজের দেশ ছাড়াও বাইরের দেশ তথা পৃথিবীর নানান দেশের বিষয়ে জানা অজানা নানা তথ্য নিয়ে ‘Global Knowledge’-এর ক্ষেত্রেও শিক্ষকের কার্যকরী ভূমিকা আছে।
[7] নারী শিক্ষা: ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নারীদের শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর স্পষ্ট অভিমত ছিল, “জাতীয় শিক্ষার কোনো কর্মসূচি সফল হতে পারে না যদি সমাজের অর্ধেক অংশকে গুরুত্ব না দেওয়া হয়।” আজাদ মনে করতেন, স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে শিক্ষা মেয়েদের মৌলিক অধিকার। সেইসঙ্গে তিনি এও মনে করতেন ভারতের মতো দেশে নারী শিক্ষার প্রসার সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে মস্ত বড়ো ভূমিকা নিতে পারে। আজাদ বলতেন, পরিবারে মা যদি শিক্ষিত হয় তাহলে ছেলেমেয়েরাও শিক্ষিত হবে।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর