ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের পক্ষে যুক্তি দাও
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র: পক্ষে যুক্তি
সুলতানি আমলে ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা শাসনতন্ত্র ইসলাম ধর্মতত্ত্বের অনুসারী ছিল বলে ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ, আর পি ত্রিপাঠী, এ এল শ্রীবাস্তব, ড. রামশরণ শর্মা, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ অভিমত দিয়েছেন। এই বক্তব্যের সমর্থনে তাঁদের যুক্তিগুলি হল-
ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থের ভাষ্য
সুলতানি শাসনপর্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন জিয়াউদ্দিন বারানি। বারানির গ্রন্থ ফতোয়া-ই জাহান্দারির মূল বিষয় ছিল সুলতানি শাসনব্যবস্থার আদর্শ ও লক্ষ্য সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান। এই গ্রন্থে বারানি লিখেছেন যে, ধর্ম ও রাজনীতি পরস্পরের সহায়ক। মন্দ জগতকে কেবল ধর্মীয় পথেই শুদ্ধ করা যায়। সুলতান এমনভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করবেন যাতে কোনও বিধর্মী কোনও বিষয়ে মুসলমানদের উপর প্রভুত্ব করতে না পারে। বারানির মতে, ইসলামের বিধানকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠা করা শাসকের কর্তব্য।
খলিফাতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য
বিশিষ্ট আরব পণ্ডিত ইবন খালদুন-এর মতে, অনুশাসনিক প্রয়োজনে খিলাফৎ-এর সৃষ্টি। তাই প্রতিটি মুসলমানের খলিফার প্রতি আনুগত্য বাধ্যতামূলক। খলিফা একনিষ্ঠভাবে কোরানের আইন ও শরিয়তের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপরিচালনা করতে দায়বদ্ধ। ভারতের সুলতানি আমলের প্রায় সব শাসকই খলিফাতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতেন। যেমন- (১) ইলতুৎমিস খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতিপত্র (মনসুর) সংগ্রহ করেন। (২) বলবন তাঁর মুদ্রায় খলিফার নাম উৎকীর্ণ করেন এবং নিজেকে খলিফার সহকারী বলে প্রচার করেন। মহম্মদ বিন তুঘলক আব্বাসীয় খলিফার বংশধরের কাছ থেকে স্বীকৃতি নেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক নিজে খলিফার নায়েব উপাধি নেন, খলিফার নামে খুতবা পাঠ এবং মুদ্রা খোদাই করেন। খলিফাতন্ত্রের প্রতি এই আনুগত্য ও মান্যতা সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মকেন্দ্রিকতার প্রমাণ দেয়।
উলেমাতন্ত্রের প্রভাব
মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণি উলেমাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও কর্তৃত্ব সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী করেছিল।
- সুলতানি শাসনকালে উলেমাদের এক বৃহৎ অংশ সরকারি কাজে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। বিচার, আইন, ভূমিরাজস্ব ইত্যাদি প্রশাসনিক বিভাগের উচ্চপদে বহু উলেমা নিযুক্ত হন। এঁরা ধর্মীয় আইনের ভিত্তিতে প্রশাসনকে চালিত করতে প্রয়াসী হন।
- সামাজিক ক্ষেত্রেও উলেমাদের বিশেষ প্রভাব ছিল। তাই সুলতানেরা প্রকাশ্যে উলেমাদের রাজনৈতিক খরবদারিতে বাধা দিতেন না। আলাউদ্দিন খলজির আগে পর্যন্ত আগত সুলতানেরা উলেমাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে ভয় পেতেন।
- রোমিলা থাপার লিখেছেন যে, ‘ধর্ম ও রাজনীতির মিলনের ফলে রাজ্যশাসনে উলেমাদের প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। উলেমাদের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য সুলতানরা তাঁদের ভূমিদান করতেন, . মাঝে মাঝে দেবমূর্তি ও হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে অমুসলমান-বিরোধী ভাবমূর্তি তুলে ধরতেন।’
- ধর্মান্ধ, হিন্দুবিদ্বেষী উলেমাশ্রেণি প্রভাবিত সুলতানি শাসনব্যবস্থা ধর্মাশ্রয়ী বা পুরোহিততান্ত্রিক হওয়া ছিল স্বাভাবিক পরিণতি।
ধর্মকেন্দ্রিক আইনবিধি
ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, সুলতানি আমলের আইনগুলি ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রের ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছিল। রাজকীয় অনুশাসনের ভিত্তি ছিল শরিয়তের ভাষ্য। রাজস্ব আইনের ভিত্তি ছিল ধর্মের বিধান। অমুসলমান হিসেবে হিন্দুরা জিজিয়া কর দিতে বাধ্য ছিলেন। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, শরিয়তের বিধান অনুযায়ী সুলতানি করব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। অমুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত।
আরও পড়ুন – ভারতে প্রচলিত ভাষা পরিবার MCQ