১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো
অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ (Mehmed II) কর্তৃক ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে রোমান সম্রাট একাদশ কনস্ট্যানটাইন (Constantine XI)-কে পরাজিত করা এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের ঘটনাকে ইউরোপের ইতিহাসে মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের আবির্ভাবের সীমান্তরেখা বলে গণ্য করা হয়। সমগ্র ইউরোপে যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের তাৎপর্য
(1) বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অবসান এবং অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান: কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ইউরোপের অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটায়, যা দীর্ঘ ১০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আসীন ছিল। অন্যদিকে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অটোমান তুর্কিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
(2) সাংস্কৃতিক এবং বৌদ্ধিক পরিবর্তন: কনস্ট্যান্টিনোপলের মতো এত জনবহুল একটি শহরের পতন ঘটলে সেখানকার ভীতসন্ত্রস্ত অধিবাসীরা ইউরোপের নানা শহরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিশেষত, গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যের পণ্ডিতরা ইটালিতে চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তাঁদের মহার্ঘ জ্ঞানভান্ডার, পুথি-পুস্তিকাসমূহ। ফলে ইটালিতে প্রবলভাবে গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য দর্শনের চর্চা শুরু হয়। এর থেকেই নবজাগরণ নতুন মাত্রা ও গতিবেগ লাভ করে।
(3) বাণিজ্যক্ষেত্রে পরিবর্তন ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি: কনস্ট্যান্টিনোপল তুর্কিদের দখলে চলে গেলে ইউরোপের অর্থনীতিতে, বিশেষত বাণিজ্যে পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এযাবৎ ভূমধ্যসাগরের উপর রোমান সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। কিন্তু কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর তুর্কিরা ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে প্রচলিত বাণিজ্য বাধাপ্রাপ্ত হয়। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক কেন্দ্ররূপে ভেনিসের গুরুত্ব হ্রাস পায়। ইউরোপীয় পণ্যবাহী জাহাজগুলি তুর্কি আক্রমণের ফলে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। ফলে ইউরোপীয় বণিকরা এশিয়া মহাদেশে পৌঁছোনোর জন্য বিকল্প সমুদ্রপথ অনুসন্ধানে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এইভাবে নানা সামুদ্রিক অভিযানের মাধ্যমে এশিয়া মহাদেশে যাওয়ার নতুন পথ এবং আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়।
(4) ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রভাব: নতুন নতুন দেশ ও মহাদেশ আবিষ্কার এবং যোগাযোগের সূত্রে মানুষের প্রচলিত চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন আসে। ধর্ম, সমাজ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। এই সময় থেকে গির্জা-নিয়ন্ত্রিত মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থায় ভাঙন পরিলক্ষিত হয়। ইটালির নানা শহরে ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদী জীবনচর্যা বিকাশলাভ করে।
(5) সামরিক কলাকৌশল এবং জাতিরাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ: কনস্ট্যান্টিনোপল দখলের সময় তুর্কিদের দ্বারা বারুদ ও কামান ব্যবহারের সাফল্য ইউরোপীয় সামরিক ক্ষেত্রকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। এ ছাড়া ইউরোপে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়। রোমের পতনের ফলে নতুন করে রোমান প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্রভাবনার সুযোগ আসে। গড়ে উঠতে শুরু করে স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্রের ধারণা।
মূল্যায়ন
এইভাবে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের অবসান ঘটায় এবং ইউরোপে এক নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনা গড়ে দেয়। মধ্যযুগীয় সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতির স্মৃতি বহন করে ইউরোপ অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ (Dark Age) থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের পথ খুঁজে পায়।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর