স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ বিশ্লেষণ করো
স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ
স্বাধীনতার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এর বিভিন্ন রূপ নির্দেশ করেছেন। মোটামুটিভাবে স্বাধীনতার যে রূপগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য, সেগুলি হল-
[1] স্বাভাবিক স্বাধীনতা: সামাজিক চুক্তি মতবাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রুশো বলেছিলেন, মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন; কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ (Man is born free, but everywhere he is in chains)। যখন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়নি, তখন যে স্বাধীনতা বিরাজ করত তা ছিল স্বাভাবিক স্বাধীনতা।
[ 2] সামাজিক স্বাধীনতা: সামাজিক রীতিনীতি, ঐতিহ্য, নৈতিকতার দ্বারা সংরক্ষিত স্বাধীনতাকে সামাজিক স্বাধীনতা বলা হয়। তবে সামাজিক স্বাধীনতার ধরন এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে পরিবর্তিত হয়। অনেক সময় সামাজিক স্বাধীনতা অমানবিক স্বাধীনতায় পর্যবসিত হয়েছে। যেমন- হিন্দুসমাজে এককালের সতীদাহ প্রথা, প্রাচীন গ্রিসের দাসপ্রথা ইত্যাদি।
[3] সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা: প্রাচীন গ্রিসের স্বাধীনতার ধারণাকে সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা বলে আখ্যা দেওয়া হয়। গ্রিকরা ব্যক্তিগত জীবনের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির আস্বাদ পেতে নিজেদের সম্প্রদায় দ্বারা নিজেরাই শাসিত হতে চাইতেন। অনেকে মনে করেন, এর থেকেই আধুনিককালের জাতীয় স্বাধীনতার ধারণার সৃষ্টি হয়।
[4] নৈতিক স্বাধীনতা: যে স্বাধীনতা ব্যক্তির নীতিবোধ ও নৈতিক চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাকে নৈতিক স্বাধীনতা বলা হয়। আদর্শবাদী চিন্তাবিদরা নৈতিক স্বাধীনতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।
[5] জাতীয় স্বাধীনতা: কোনো পরাধীন দেশ যখন মুক্তি লাভ করে, তখন তা জাতীয় স্বাধীনতার স্বাদ পায়। ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বাধীনতা। ভারত 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট জাতীয় স্বাধীনতা লাভ করে।
[6] আইনসংগত স্বাধীনতা: আধুনিক রাষ্ট্রে যে স্বাধীনতা নাগরিকরা ভোগ করেন তাকে আইনসংগত স্বাধীনতা বলা হয়। অর্থাৎ, এই ধরনের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সংবিধান ও আইনের অনুমোদন থাকে। আইনসংগত স্বাধীনতার প্রকৃতি অপেক্ষাকৃত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। আইনসংগত স্বাধীনতার তিনটি প্রধান দিকের মধ্যে রয়েছে- (i) ব্যক্তিগত বা পৌর স্বাধীনতা (Civil Liberty), (ii) রাজনৈতিক স্বাধীনতা (Political Liberty) ও (iii) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা (Economic Liberty)।
- i. ব্যক্তিগত বা পৌর স্বাধীনতা: ব্ল্যাকস্টোনের মতে, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত গতিবিধির স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বাধীনতা হল ব্যক্তিগত বা পৌর স্বাধীনতার মুখ্য উপাদান। বস্তুতপক্ষে, যে স্বাধীনতা না থাকলে ব্যক্তিগত জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব নয়, তাকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলা যায়।
- ii. রাজনৈতিক স্বাধীনতা: রাজনৈতিক স্বাধীনতা নাগরিকদের, রাষ্ট্রপরিচালনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে। সরকার গঠন এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণের কাজ করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। ল্যাস্কি রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে বুঝিয়েছেন।
- III. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে সেই স্বাধীনতাকে বোঝায় যা ব্যক্তির দৈনন্দিন খাদ্যসংস্থানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সমসুযোগের সৃষ্টি করে। কর্মের অধিকার, বার্ধক্যে ও অক্ষম অবস্থায় আর্থিক নিরাপত্তা, সমস্ত রকম শোষণের হাত থেকে মুক্তি ইত্যাদি হল অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মূল উপাদান। বস্তুতপক্ষে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে ব্যক্তিগত বা পৌর স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বলে অনেকে মনে করেন।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর