দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র বসু প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর জীবন সংগ্রামের, ত্যাগের পরাধীন ভারতবর্ষকে দাসত্ব-শৃঙ্খল মোচনের, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনির্বাণ প্রদীপ-শিখার কণ্ঠরোধ করার জন্য যেন তিনি জন্মেছেন। ব্রিটিশ শক্তির সমস্ত দূরভিসন্ধি ও চক্রান্ত ব্যর্থ করে সুভাষচন্দ্রের উদাত্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল বার্লিনে, সিঙ্গাপুরে, ভারতের পূর্ব সীমান্তে ইম্ফলে। তিনি হলেন ভারতের জনগণ-মন-অধিনায়ক, মুক্তিপথের বিজয়-পথিক, ভারতবাসীর আকাঙ্খিত প্রিয় নেতাজী।
জন্ম ও পিতৃ পরিচয়
সুভাষচন্দ্রের জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী ওড়িশার কটক শহরে। পিতা বিশিষ্ট সরকারি উকিল জানকীনাথ বসু ও মাতার নাম প্রভাবতী দেবী। জানকীনাথের পৈতৃক নিবাস ছিল চব্বিশ পরগণা জেলার কোদালিয়া গ্রামে। সুভাষচন্দ্রের জন্মের মধ্য দিয়ে যেন বিদ্রোহের নবজন্ম।
ছাত্রজীবন
সুভাষচন্দ্রের শিক্ষারম্ভ হয় ওড়িশার কটকের মিশানারী স্কুলে। পরে র্যাভেনশ কলিজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিয়া পরীক্ষায় তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানলাভ করেন। তিনি ভর্তি হলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। ছোটোবেলা থেকে তাঁর মধ্যে দেশাত্মবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। দেশাত্মবোধ ছিল তাঁর অন্তরের চালক-শক্তি। তাই অধ্যাপক ওটেন যখন ক্লাসে ভারতীয়দের প্রতি অপমানকর উক্তি করেন তখন সুভাষচন্দ্র তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। পরিণামে তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। কিন্তু পরে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন এবং বি. এ. পরীক্ষায় দর্শন-শাস্ত্রে অনার্স সহ পাশ করে এম. এ পড়তে থাকেন।
পরে ১৯১৯ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ায় পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯২০ সালে আই সি এস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করায় স্বদেশে ফিরে আসেন। স্বামী বিবেকানন্দের লেখা তাঁর মনে দেশপ্রেমের অগ্নিশিখাকে তীব্রভাবে উজ্জিবিত করল। চাকুরির গোলামির সমস্ত প্রলোভন ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভারতের মুক্তি সংগ্রামে, যুক্ত হলো যৌবনের প্রজ্ঞা-দীপ্ত চিন্তার সঙ্গে যৌবনের আবেগ।
কর্মজীবন
শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। তাই দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র বসু, দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল প্রমুখ নেতাগন জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হন। সুভাষচন্দ্র জাতীয় বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষপদে যোগ দেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের যুবরাজ ভারতে এলেন। ব্রিটিশ শোষণের প্রতিবাদে হরতাল ডাকলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র প্রভৃতি নেতা গ্রেফতার হন এবং বিচারে ছমাস কারাবাস হয়। ফরোয়ার্ড পত্রিকার ডিরেক্টার বীরেন্দ্রনাথ ও সহসম্পাদক হিসাবে সুভাষচন্দ্র দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের চিপ্ এক্সজিকিউটিভের পদ ও অলংকৃত করেন।
ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য তাঁকে বার বার কারার অন্তরালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে। ভগ্ন স্বাস্থ্যের চিকিৎসার জন্য তিনি ইউরোপে যেতে বাধ্য হন। দেশে ফিরলে তাঁকে আবার অন্তরীণ করা হয়। সেখান থেকে মুক্তিলাভ করে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি ও ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরী কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। কংগ্রেসের মধ্যে চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের মধ্যে বিরোধ বাধে। সুভাষচন্দ্র ছিলেন চরমপন্থী।
নিরুদ্দেশ ও আজাদহিন্দ ফৌজ গঠন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। ব্রিটিশ সরকার আবার তাঁকে গ্রেফতার করল ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তাঁকে স্বগৃহে অন্তরীন করে রাখা হল। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী। খবর ছড়িয়ে পড়ল সুভাষচন্দ্র নিরুদ্দেশ হয়েছেন। জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি কাবুল, বার্লিন হয়ে সিঙ্গাপুরে পৌঁছালেন, সেখানে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে গঠিত হল আজাদ-হিন্দ ফৌজ। সুভাষচন্দ্র হলেন সর্বাধিনায়ক। তখন তিনি অভিহিত হলেন নেতাজী নামে, ভারত মুক্তির রূপকার।
দেশমুক্তির সংগ্রাম
নেতাজী উদাত্ত কণ্ঠে ভারতবাসীকে আহ্বান জানালেন, “তুমি আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেবো।” ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সে এক গৌরবময় অধ্যায়। গঠিত হল আজাদ হিন্দ সরকার ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে। প্রবল শক্তিশালী ইংরেজ ও আমেরিকার বিরুদ্ধে শুরু হল যুদ্ধ। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই মার্চ আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের মাটিতে উত্তোলন করলেন জাতীয় পতাকা। তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে নেতাজী ডাক দিলেন “দিল্লী চলো।” শুরু হলো অভিযান। জয় হলো দুর্দমনীয় আত্ম প্রচেষ্টার, জয় হলো অদম্য আকাঙ্খার। কিন্তু ব্রহ্মদেশ পুর্নদখল করায় ও জাপান প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করায় এবং প্রকৃতি বিমুখ হওয়ায় আজাদ হিন্দ সরকার বাধ্য হল পিছু হটতে। পরাজয়ের দুঃসহ বেদনা নিয়ে নেতাজী নতুন পথের সন্ধানে বিমানে জাপান যাত্রা করলেন। খবর প্রকাশিত হল তিনি নাকি বিমান দুর্ঘটনায় তাই হোকুতে নিহত হয়েছেন।
উপসংহার
ভারতবাসী কিন্তু বিশ্বাস করেন না যে বীরযোদ্ধা, দেশপ্রেমের অগ্নিশিখা এভাবে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। যে অগ্নিশিখা অপ্রতিহত ব্রিটিশ শক্তিকে নিশ্চিত থাকতে দেয়নি, বার বার পর্যুদস্ত করে তুলেছিল তাঁকে ভারতবাসীর মন থেকে মুছে দিতে কেউ পারেনি, পারবেও না। নেতাজী ভারতবাসীর মনে চিরকাল সমুজ্জ্বল থাকবে, তিনি হৃয়দ-সিংহাসনে চির-প্রতিষ্ঠিত। এই অমর বীরের প্রত্যাবর্তনের জন্য কোটি কোটি ভারতবাসী আজও অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছেন। তাইতো বার বার মনে হয়, “তোমাকে না পেয়ে দুঃখ ও বেদনায় করি আপশোষ। এসো ফিরে তুমি, চির উন্নত শির নেতাজী সুভাষ বোস।”
আরও পড়ুন – মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা