সাম্যের সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও ধরন বিশ্লেষণ করো
সাম্যের সংজ্ঞা
সাধারণভাবে সাম্য বলতে সব মানুষের সমতাকে বোঝায়। কিন্তু, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘সাম্য’ বা ‘Equality’ কথাটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য বলতে সব মানুষের ব্যক্তিত্ববিকাশের উপযোগী যাবতীয় সুযোগসুবিধার সমতাকে বোঝায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য সম্পর্কিত সংজ্ঞা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ল্যাস্কি প্রদত্ত সংজ্ঞা: অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্যের অর্থ সব বিষয়ে সমতা বা অভিন্নতা নয়। দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত শক্তিসামর্থ্যের নিরিখে সব মানুষ কখনও সমান হতে পারে না। ল্যাস্কির বক্তব্য অনুসারে সাম্য হল- [1] কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিশেষ সুযোগসুবিধা প্রদান না করা এবং [2] সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা।
বার্কার প্রদত্ত সংজ্ঞা: সাম্য হল অধিকার বণ্টনের সেই পদ্ধতিগত নিয়ম, যা ন্যায়ের অনুসরণে ন্যায় থেকে উদ্ভূত।
মার্কসীয় সংজ্ঞা: সাম্য হল শ্রেণিহীন শোষণহীন এক সামাজিক ব্যবস্থার পরিকল্পনা।
সাম্যের প্রকৃতি
সাম্যের প্রকৃতি বিষয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
[1] বিশেষ সুযোগসুবিধার অনুপস্থিতি: বস্তুত দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত শক্তি-সামর্থ্যের বিচারে সব মানুষ কখনও সমান হতে পারে না। মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগত বৈষম্য রয়েছে। সব মানুষের ক্ষমতা, চাহিদা ও প্রয়োজন একই রকমের নয়। ল্যাস্কির বক্তব্য হল যতদিন মানুষের অভাব, যোগ্যতা ও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকবে ততদিন সবার জন্য সমান সুযোগসুবিধা সম্ভব নয়। ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্র যদি একজন গণিতজ্ঞ ও রাজমিস্ত্রিকে একই মূল্য দেয় তাহলে প্রতিভার বিকাশ ঘটবে না। ফলে সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হবে। কাজেই সাম্য বলতে কখনোই সমস্ত মানুষের জন্য একই ব্যবস্থা বোঝায় না।
[2] সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা সুনিশ্চিতকরণ: ল্যাস্কির মতে, সাম্য বলতে বোঝায় সব মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের উপযোগী পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা। বস্তুত, সমস্ত নাগরিককে সমান সুযোগসুবিধা দিলে সবাই যে সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সমানভাবে ব্যক্তিত্বের উন্নতি ঘটাতে পারবে, তা কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই। রাষ্ট্র শুধু সকলের জন্য সমান সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা গড়ে তুলবে যাতে প্রত্যেকে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে।
[3] মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্য: মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, ধনবৈষম্যমূলক ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রকৃত সাম্যের অস্তিত্ব কখনোই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ না ঘটলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। লেনিনের মতে, এক শ্রেণির দ্বারা অন্য শ্রেণিকে শোষণের সমস্ত রকম সম্ভাবনা যতক্ষণ পর্যন্ত না বিনষ্ট হচ্ছে ততক্ষণ কোনো প্রকৃত বা বিশুদ্ধ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না (… there can be no real, actual equality until all possibilities of exploitation of one class by another has been totally destroyed)।
সাম্যের ধরন বা প্রকারভেদ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের সাম্যের উল্লেখ করেছেন। যেমন-
[1] স্বাভাবিক সাম্য: স্বাভাবিক সাম্যের তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীন। প্রতিটি মানুষ সমানাধিকারসম্পন্ন। ফরাসি দার্শনিক রুশো বলতেন, মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ (Man is born free, but everywhere he is in chains)। প্রাচীন গ্রিসে স্টোয়িক দার্শনিকরা এবং রোমান চিন্তাবিদ সিসেরো ও পলিবিয়াস প্রমুখ স্বাভাবিক সাম্যের ধারণা প্রচার করেছিলেন।
[2] সামাজিক সাম্য: সামাজিক সাম্য বলতে বোঝায়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বংশমর্যাদা-স্ত্রী-পুরুষ-ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব মানুষের সামাজিক ক্ষেত্রে সমমর্যাদা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, দাসসমাজ ও সামন্তসমাজে সামাজিক সাম্যের অস্তিত্ব ছিল না। পরবর্তীকালে আইনের অনুশাসনের (Rule of Law) প্রসারলাভের ফলে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
[3] রাজনৈতিক সাম্য: রাজনৈতিক সাম্য বলতে সব নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার ভোগের সমতাকে বোঝায়। রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভোট দেওয়ার অধিকার, ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার, রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের অধিকার প্রভৃতি। রাজনৈতিক সাম্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলভিত্তি।
[4] আইনগত সাম্য: আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারকে আইনগত সাম্য বলে অভিহিত করা হয়। ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’র অর্থ হল সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। অন্যদিকে, আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারের অর্থ হল, আইনের মাধ্যমে সব নাগরিককে সমান সুরক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা।
[5] অর্থনৈতিক সাম্য: অর্থনৈতিক সাম্য বলতে বোঝায় সব নাগরিকের আর্থিক সুযোগসুবিধা ভোগের সমতা। মার্কসীয় দর্শনে অর্থনৈতিক সাম্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ল্যাস্কির মতে, অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক সাম্যের কোনো মূল্য নেই। অর্থনৈতিক অসাম্যের কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পত্তিবান শ্রেণির হাতে থাকার সম্ভাবনা থাকে।
[6] আন্তর্জাতিক সাম্য: আন্তর্জাতিক সাম্য বলতে প্রতিটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমমর্যাদার ধারণাকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক সাম্যের মূল বক্তব্য হল ক্ষুদ্র-বৃহৎ নির্বিশেষে সমস্ত জাতীয় রাষ্ট্রের মর্যাদা ও গুরুত্ব সমান। প্রসঙ্গত বলা যায়, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের 2[1] নং ধারায় সব সদস্যরাষ্ট্রের সমান সার্বভৌমত্বের নীতিকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর