সাধারণ মানুষ কেন দলে দলে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিল
১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে ইসলামবিরোধী অভিযান ছিল রোমান ধর্মগুরু পোপের পার্থিব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করার প্রচেষ্টা মাত্র। যে উদ্দেশ্যসাধনের জন্য পোপ অস্ত্র, যুদ্ধ, রক্তপাতের আশ্রয় নিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। পোপের আহ্বানে এই ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিল অসংখ্য সাধারণ মানুষ, যারা ক্রুসেডার (Crusader) নামে পরিচিত।
ক্রুসেডে সাধারণ মানুষের যোগদানের কারণ
সাধারণ জনগণের দলে দলে ক্রুসেডে যোগদানের পিছনে একাধিক কারণ ছিল। যেমন-
(1) খ্রিস্টান ধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: ক্লুনির সংস্কার আন্দোলনের ফলে দশম শতাব্দীতে খ্রিস্ট ধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, যে কারণে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানরা তীর্থস্থানগুলি প্রত্যক্ষ করার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে। এর মধ্যে জেরুজালেম ছিল প্রধান। কিন্তু সেলজুক তুর্কিদের দ্বারা অধিকৃত জেরুজালেমে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা নানাভাবে হেনস্তার স্বীকার হলে সাধারণ মানুষ মনে করে ক্রুসেডের মাধ্যমে জেরুজালেম অধিকারই একমাত্র পথ।
(2) সামাজিক চাহিদা : পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চলে প্রাইমোজেনিচার বিধান অনুসারে, পরিবারের সম্পত্তির (ফিফ) উপর কেবল জ্যেষ্ঠ পুত্রের অধিকার স্বীকৃত ছিল। পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রদের সম্পত্তির অংশ পাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত এই সকল ব্যক্তিদের বিকল্প জীবিকা ছিল যাজকবৃত্তি কিংবা অসৎ উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করা। এই সামাজিক সমস্যাসমাধানের অন্যতম উপায় হিসেবে পোপ এই শ্রেণির মানুষদের ক্রুসেডে অংশ নিয়ে ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন দেখান। ভাগ্যান্বেষণ এবং ধর্মীয় কর্তব্যপালনের দ্বৈত প্রেরণা অসংখ্য মানুষকে ক্রুসেড জাতীয় আন্দোলনে শামিল করে।
(3) উন্নত জীবনের স্বপ্ন: ক্রুসেডে সক্রিয় যোগদানের জন্য পোপ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়েছিলেন, যথা- সার্ফদের বলা হয়েছিল, তারা সামন্তপ্রভুর অধীনতামুক্ত হয়ে প্রাচ্যে জমি লাভ করে স্বাধীন কৃষকের মতো কৃষিকাজ করতে পারবে। বেকার, ভবঘুরেদের কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেওয়া হয়। চোর, ডাকাত ও সমাজবিরোধীদের প্রাচ্যে স্বাধীন নাগরিকের অধিকার দানের কথা বলা হয়।
(4) স্বর্গলাভ ও পাপের মার্জনা লাভ: পোপ ঘোষণা করেন, ধর্মযোদ্ধারা ক্রুসেডে শহীদ হলে স্বর্গলাভ করবে এবং ক্রুসেডারদের সমস্ত পাপ মার্জনা করা হবে। এর ফলে সাধারণ খ্রিস্টান জনতা উৎসাহিত হয়ে ক্রুসেডে যোগদান করে। এইভাবে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিল নানা পেশার, নানা স্তরের খ্রিস্টান ধর্মালম্বী মানুষ। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক পি কে হিট্রি-র মতে, ক্রুসেড ছিল মুসলিম প্রাচ্যের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান পাশ্চাত্যের তীব্র ঘৃণা ও প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ।
আরও পড়ুন –
১। সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়?
২। ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?
৩। ‘ফিফ’ ও ‘শিভালরি বলতে কী বোঝো?
৪। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো।
৫। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৬। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৭। পোপতন্ত্রের বিকাশের কারণগুলি লেখো।
৮। ইউরোপে মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ (Dark Age) বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
১০। সেন্ট বেনেডিক্ট-এর সংস্কারসমূহ সম্পর্কে লেখো।
১২। টীকা লেখো- ক্লুনির সংস্কার আন্দোলন।
১৩। ওয়ার্মস-এর চুক্তির তাৎপর্য লেখো।
১৪। ক্রুসেড’ কী?
১৫। ক্রুসেডের ধর্মীয় কারণ আলোচনা করো।
১৬। ক্রুসেড সংগঠনে খ্রিস্টান চার্চের ভূমিকা কী ছিল?
১৭। ক্রুসেডের অর্থনৈতিক কারণ আলোচনা করো।
১৮। ক্রুসেডের সামাজিক কারণ আলোচনা করো।
১৯। সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ক্রুসেডের অন্যতম কারণ ছিল- ব্যাখ্যা করো।