সমাজে শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাবোধের প্রয়োজনীয়তা
ভূমিকা
দেহের সৌন্দর্য অলংকার, কিন্তু আত্মতৃপ্তির সৌন্দর্য শিষ্টাচার। অলংকার বাইরের বস্তু, শিষ্টাচার অন্তরের এবং তার মার্জিত প্রকাশ হল সৌন্দর্যবোধ। মানুষ বনজঙ্গলে বাস করত, তখন তার মধ্যে ছিল আরণ্যক ভাব তার আচার-আচরণও স্বভাব চরিত্রে। মানুষ যখন বন্য ছিল তখন তারা সভ্য ছিল না,তাদের ছিলনা সমাজ, শিষ্টাচার বা সৌজন্যতাবোধ শিক্ষার ও প্রকাশের প্রয়োজন ও বোধ করেনি। শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাবোধ বা ভদ্রতাবোধের প্রয়োজন হল যখন তারা সমাজবদ্ধ হল। সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সুখে-শান্তিতে বাস করতে হলে সকলের আচার-আচরণ সংযত ও মার্জিত হওয়া প্রয়োজন। সামাজিক জীব হিসাবে দলবদ্ধ জীবনে শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাবোধ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক সম্পর্ক যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক ঐশ্বর্য।
আত্মীয়তা ও সামাজিকতার সেতুস্বরূপ শিষ্টাচার
মানুষ যুক্ত পরিবার ও সমাজের সঙ্গে। মানুষের আত্মীয়তা আন্তরিক এবং সামাজিকতা আনুষ্ঠানিক। পরিবার ও সমাজের প্রতি মানুষের কর্তব্য গভীর ও ঘনিষ্ট। তাকে প্রীতিময়তার আত্মীয়তা ও সুমার্জিত সামাজিকতা রক্ষা করে চলতে হয়। সৌজন্যতাবোধ বা ভদ্রতা আত্মীয়তার মতো সুগভীর সামাজিকতার মতো আনুষ্ঠানিক নয়।
সামাজিক রীতিও শিষ্টাচার
যে সমাজ যত সভ্য তার লোক-ব্যবহার তত মার্জিত, সুরুচিপূর্ণ। অনেকসময় মানুষের ব্যবহারকে বাহ্যিকরীতি বা আন্তরিকতা হীন আচরণবলে মনে ভ্রম হয়। সমাজে বাস করতে হলে কতকগুলি সার্বজনীন রীতি মেনে চলতে হয় সৌজন্য ও সৌষ্ঠব রক্ষার জন্য। ভদ্রতা মানুষের বাইরের আচরণীয় রীতি শুধু নয়। শিষ্টাচার বা ভদ্রতা অন্তরের অমূল্য সম্পদ যার সাথে আছে অন্তরের স্পর্শ।
স্পষ্টবাদিতা ও শিষ্টাচার
শৈশব থেকে আত্ম-সংযম ও মার্জিত প্রকাশভঙ্গি র অনুশীলনের ফসল হল শিষ্টাচার। স্পষ্টবাদিতার সাথে শিষ্টাচারের কিছু পার্থক্য আছে। অপ্রিয় সত্য কখনও আদরণীয় হয় না। অনেকে স্পষ্টবাদিতার দোহাই দিয়ে রূঢ় ব্যবহারের মাধ্যমে শালীনতাবোধকে পীড়িত করে। স্পষ্টবাদিতার মধ্যে থাকে আত্ম-প্রতিষ্ঠার ব্যাকুলতা। স্পষ্টবাদীরা তাৎক্ষণিক প্রশংসা পায়, কিন্তু সামাজিক শিষ্টাচারের গন্ডি পেরিয়ে যায় বলে পরবর্তীকালে অনেকের কাছে অপ্রিয় হয়। সেই সত্যটিকে মার্জিত ভঙ্গিতে শিষ্টাচারের সৌষ্ঠব রক্ষা করে প্রকাশের মাধ্যমে হয় আত্মিক সমুন্নতি।
শিষ্টাচার ও খোশামোদ
তবে কি ভদ্রতা ও খোশামুদি-শিষ্টাচার ও চাটুকার বৃত্তি এক? ভদ্রতা হলো সকল মানুষের প্রতি সমান দৃষ্টি এবং খোশমুদির দৃষ্টি কেবল নিজের প্রতি নিবদ্ধ। শিষ্টাচার ও সৌজন্য বোধ নিজের অসুবিধা করেও অপরের সুবিধা করে দিতে উৎসুক হওয়া, চাটুকারবৃত্তি বলতে বুঝায় শুধু নিজের সুখ, আত্মসমৃদ্ধির খোঁজ করা, শিষ্টাচার বা সৌজন্যতাবোধ সৌষ্টব মন্ডিত সরল ও সুন্দর। চাটুকার বৃত্তি হল সৌষ্টবহীন ও কুটিল। শিষ্টাচারে আছে বিশ্বমুখীনতা, চাটুকার বৃত্তিতে আছে আত্মানুশীলনতা।
চক্ষুলজ্জ ও শিষ্টাচার
শিষ্টাচারের সাথে ‘চক্ষুলজ্জা’ নামে দুরপনেয় সামাজিক প্রথাজাত শব্দ প্রায়ই লোকে বলে। অনেকসময় অসত্যকে চক্ষুলজ্জার ভয়ে মানুষ সত্য বলে মেনে নেয় যা এক ধরনের সামাজিক অপসংস্কৃতির অঙ্গ।
শিষ্টাচারহীন বর্তমান সমাজ
শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাবোধ অমূল্য এক সামাজিক অলংকার, সমাজের গর্ব, সুসামাজিক সম্পর্কের বন্ধন শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাবোধ মানুষকে করে গ্রহনীয়, আদরণীয়, বিনম্র। যাদের মধ্যে শিষ্টাচারের অভাব, সৌজন্যতাবোধের অভাব তাদের কথাবার্তা আচার আচরণে রূঢ়তা প্রকাশ পায় যা সংস্কৃতির বিপরীতধর্মী। অনেকে নিজের দূর্বলতা ঢাকতে দূর্ব্যবহার, দুর্বাক্য ব্যবহার করে। নিজের আচরণ, চলন-বলন, আলাপ- আলাপনে তার সৌজন্যতা বোধের প্রকাশ ঘটে। সদ্ব্যবহার, সুশোভন আচরণই শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাবোধের পরিচায়ক।
কারণও প্রতিকার
সমাজের নানা সমস্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার মূল্যবোধ, ধনীসম্প্রদায় নিম্নবৃত্তদের ওপর প্রভুত্ব করার জন্য সৌজন্যতাবোধের ধার ধারে না। যন্ত্রসভ্যতা মানুষের হৃদয়কেও করছে রূঢ়, হারিয়ে যাচ্ছে হৃদয়ের কোমল অনুভূতি। সমাজকে এই অশোভনীয় শিষ্টাচারহীনতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে গৃহে, স্কুল-কলেজে, অফিস-আদালতে, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাবোধ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা খুবই প্রয়োজন।
উপসংহার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাড়ছে জটিলতা, জীবনযাত্রায়, সংসারচক্রের অনিবার্য বাস্তবতার নিরিখে চারদিকে প্রতিনিয়ত শ্বাসরোধকারী পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে যে তা শিষ্টাচার সৌজন্যতাকে শান্তিবারি সিঞ্চনে জীবনের -বেলাভূমিতে গড়ে তুলতে পারে সুমধূর সম্পর্কের উদ্যান, যন্ত্রদানব আমাদের সুকুমার বোধগুলি কেড়ে নিয়েছে ধবংস হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ, শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাবোধই তার একমাত্র প্রতিকার। শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাবোধ ধূলিম্লান পৃথিবীর রুক্ষতাকে কোমলতা দান করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে শ্রীশোভামন্ডিত করে তুলবে।
আরও পড়ুন – তোমার জীবনের লক্ষ্য রচনা