সত্যাগ্রহের অর্থ লেখো। সত্যাগ্রহের প্রধান উপাদানসমূহ আলোচনা করো
সত্যাগ্রহের অর্থ
সত্যাগ্রহ শব্দটি দুটি সংস্কৃত শব্দ সত্য (Truth) + আগ্রহ (Holding firmly)-এর সমন্বয়ে গঠিত। যার আক্ষরিক অর্থ হল সত্যের প্রতি আগ্রহ। এটি সত্য প্রতিষ্ঠার নৈতিক সংগ্রামে এক নিরস্ত্র প্রতিরোধ। পন্ডিতদের মতে, এটি হল ব্রিটিশদের বিপক্ষে অহিংস উপায়ে যুদ্ধ করার পথ, এক প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
গান্ধিজি তাঁর হিন্দ স্বরাজ-এ সত্যাগ্রহের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, সত্যাগ্রহ হল ব্যক্তির আত্মপীড়নের মাধ্যমে স্বাধিকার অর্জনের এক প্রচেষ্টা। গান্ধিজির কাছে সত্যাগ্রহ ছিল সত্য, অহিংসা ও আত্মত্যাগের যোগফল। তাঁর মতে, সত্যাগ্রহ বলতে বোঝায় সকল অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে পবিত্র আত্মশক্তির প্রতিরোধ।
গান্ধিজর মতে সত্যাগ্রহ ব্যক্তির এক সহজাত বা জন্মগত অধিকার। এ শুধু পবিত্র অধিকার নয়, পবিত্র কর্তব্যও। বন্ধুর্যান্ট (Joan Bondurant) বলেছেন যে, ইতিবাচক উদ্দেশ্য ও মৌলিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হল সত্যাগ্রহ।
অহিংস পদ্ধতিতে বিদ্রোহ করার পথকে নির্মল কুমার বসু ‘সত্যাগ্রহ’ বলে মনে করেছেন। আবার, ড. বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও বলেছেন, অশুভ-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি পদ্ধতি এবং বিরোধ মীমাংসার একটি অবলম্বন হিসেবে সত্যাগ্রহকে গ্রহণ করা যায়। এ ছাড়া কৃয়ালাল শ্রীধরনি-র মতে, সত্যাগ্রহ হল অহিংস প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
সত্যাগ্রহ কোনো নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয়। এটি আবার কোনো প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসামূলক কার্যকলাপকে সমর্থন করে না। সত্যাগ্রহ একটি দৃঢ়চেতা মানসিকতা, যা শুধু প্রেম-প্রীতি, ধৈর্য-সহিষুতা, আত্মিকশক্তির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব।
সত্যাগ্রহের প্রধান উপাদানসমূহ
গান্ধিজি সত্যাগ্রহের পরিচালনায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। এগুলি হল –
- সত্য: সত্যাগ্রহ ধারণাটির প্রথম ভিত্তি হল সত্য। তাঁর কাছে সত্যই অন্তিম লক্ষ্য। পরবর্তী সময়ে সত্যকেই তিনি ঈশ্বর বলে উল্লেখ করেছিলেন। এই সত্যের পথে পৌঁছানোর উপায় হিসেবে অহিংস পদ্ধতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাঁর কাছে সত্য ও অহিংসা একটি দাগহীন মুদ্রার দুটি পীঠ। যদিও ১৯১৯ সালে তিনি বলেছিলেন, একজনের কাছে যা সত্য, অন্যের কাছে তা মিথ্যা বলে গণ্য হয়। সত্যাগ্রহের ধারণাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গান্ধিজি সত্যকে আপেক্ষিক রূপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
- অহিংসা : গান্ধিজির ‘সত্যাগ্রহ’ সম্পর্কিত ধারণাটি অহিংসা নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাঁর মতে অহিংসা হল এমন এক রাজনৈতিক আদর্শ, যার প্রভাবে মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে মনের দিক থেকে কোমল এবং হৃদয়বান হয়ে উঠবে ফলে একজন সত্যাগ্রহী তার আচরণের মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের মনে চেতনার বিকাশ ঘটাবে।
- আত্মনিগ্রহ বা আত্মপীড়ন: গান্ধিজি মনে করেন প্রতিশোধ নয়, ভালোবাসা সর্বদা আত্মত্যাগের মাধ্যমেই সাধিত হয়। আত্মনিগ্রহের গুরুত্ব অনুধাবন করে মরিস জোন্স (Morris Jones) বলেছেন যে, অহিংসা যদি একটি ইতিবাচক মানসিক অবস্থা হয়, তাহলে আত্মনিগ্রহ হল অহিংসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কার্যসংক্রান্ত একটি নীতি। গান্ধিজি আত্মনিগ্রহ ও হিংসাকে পরস্পরবিরোধী বিষয় বলেই চিহ্নিত করেছেন। কারণ, সত্যাগ্রহী যখন আত্মপীড়ন বা দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করবে, সাহস অর্জন করবে, তখনই সে বিপক্ষ শক্তিকে স্বমতে আনতে পারবে।
যদিও গান্ধিজির সত্যাগ্রহের কৌশল ও উপাদানগুলি অতিমাত্রায় কাল্পনিকতার দোষে দুষ্ট বলে সমালোচিত হয়েছে।
আরও পড়ুন – সরকারের বিভিন্ন রূপ বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর